ঢাকা: জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যায় জড়িতদের বিচার কার্যক্রমের পাশাপাশি সংবিধান, জনপ্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতের সংস্কার কাজে হাত দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরইমধ্যে ৬টি সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে।
বিএনপি, জামায়াতসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠী শুরু থেকে এ সরকারকে সমর্থন জানিয়ে আসছে। বিএনপির পক্ষ থেকে সংস্কারকাজের পাশাপাশি সরকারকে নির্বাচনেরও তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিনিয়োগ, সামাজিক অস্থিরতাসহ নানান কারণে বিএনপির নেতারা বলছেন, সংকট সমাধানে নির্বাচনের মাধ্যমে দ্রুত রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা দরকার।
সম্প্রতি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বিক্ষুব্ধ জনতা আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনার পৈতৃক বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর নতুন করে দেশে অস্থিরতা ছড়িয়েছে। এর পেছনে অবশ্য পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উসকানিকেই দায়ী করছে অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি, জামায়াতসহ অভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রাখা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠী। তারা বলছে, অভ্যুত্থানের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও অভ্যুত্থানে শত শত মানুষকে হত্যার জন্য শেখ হাসিনা বা তার দল আওয়ামী লীগের মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনার প্রকাশ দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু তারা আন্দোলনকারীকের কটাক্ষ ও বিদ্রুপের পাশাপাশি হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। সেই ধারাবাহিকতায় ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের একটি ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে বক্তব্যের প্রচারণা চালালে ছাত্র-জনতা ক্ষুব্ধ হয় এবং ধানমন্ডির ওই বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেয়।
এমন প্রেক্ষাপটে গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি। বৈঠকে দলটির তরফ থেকে দ্রুত নির্বাচনের দাবি তোলা হয়। জবাবে প্রধান উপদেষ্টাও আশ্বস্ত করেছেন, অতি দ্রুত তারা নির্বাচনের ব্যবস্থা করছেন।
শুধু প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতেই দাবি জানিয়ে থেমে থাকছে না বিএনপি। দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণাসহ কয়েকটি দাবিতে বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) থেকে সারা দেশে নয় দিনের কর্মসূচিতে নেমেছে। দলের নেতারা বলছেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচন চান।
বিএনপির হাইকমান্ড বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে নির্বাচন নিয়ে যে লক্ষ্যের কথা জানানো হয়েছে, সেটি এখনো সুনির্দিষ্ট নয়। ফলে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শঙ্কা এখনো কাটেনি। একই সঙ্গে দেশের সার্বিক পরিস্থিতিও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এমন অবস্থায় একটি গ্রহণযোগ্য অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনই হতে পারে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ।
বিএনপি মনে করে, কেবল নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারই দেশের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারে।
বিএনপি যে দাবিতে ৯ দিনের সভা-সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে আছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সহনীয় পর্যায়ে রাখা, অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, দ্রুত গণতান্ত্রিক যাত্রাপথে উত্তরণের জন্য নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা এবং রাষ্ট্রে পতিত ফ্যাসিবাদের নানা চক্রান্তের অপচেষ্টা মোকাবিলা। ৬৭টি সাংগঠনিক জেলায় কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি।
সিদ্ধান্ত অনুসারে, রাজধানীসহ সারাদেশের এসব সভা-সমাবেশে দলটির শীর্ষ নেতারা অংশ নিচ্ছেন। কেন্দ্র থেকে প্রতিটি কর্মসূচি ব্যাপক জনসমাগমের মধ্য দিয়ে সর্বাত্মকভাবে সফল করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন রমজানে রাজপথে কোনো কর্মসূচি থাকবে না বিএনপির। তবে ওই মাসে ইফতার মাহফিলের মধ্য দিয়েও একই দাবি-দাওয়া তুলে ধরা হবে। আর এ সময়ের মধ্যে সংস্কার এবং জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ সুনির্দিষ্ট না হলে রমজানের পরে রাজপথে কর্মসূচি অব্যাহত রাখবে দলটি।
ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি!
দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরে। সেই বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার কাছে একটি চিঠিও হস্তান্তর করা হয়।
বৈঠকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে অংশ নেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ও হাফিজ উদ্দিন আহমদ।
বৈঠক শেষে বিএনপির মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান উপদেষ্টা এবং তার সঙ্গে যারা তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, অতি দ্রুত তারা নির্বাচনের ব্যবস্থা করছেন। তিনি বলেছেনও যে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা করার জন্য কাজ করছেন। আমরা আশা করবো, জনগণের যে প্রত্যাশা আছে, একটা রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন তিনি। সেটার মধ্য দিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি।
সরকারের তরফ থেকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, সব রাজনৈতিক দল একমত হলে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে আপত্তি নেই।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের আগের দিন ৯ ফেব্রুয়ারি বিএনপি নির্বাচন ভবনে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)-সহ অন্য কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠকও করেছে। সেখানে নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সার্বিক বিষয় নিয়ে তারা ইসির সঙ্গে মতবিনিময় করে। বিএনপির তরফ থেকেও নির্বাচনী প্রস্তুতিতে ইসিকে সার্বিক সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। এ কারণেই আমরা বারবার বলে আসছি যত দ্রুত সম্ভব একটি অবাধ, সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তাহলেই প্রকৃত গণতন্ত ফিরে আসবে।
সরকার সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি বছরের ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচন হতে পারে। সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্পও নেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, অন্তবর্তী সরকারের পক্ষে সব বিষয়ের সংস্কার করা সম্ভব নয়। এই কারণে শুধু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে সংস্কার করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন চাচ্ছে বিএনপি। কারণ জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ছাড়া সব সংস্কার করা সম্ভব নয়। আর সংস্কারের কারণে যদি নির্বাচিত হতে দেরি হয় তাহলে দেশের জন্য সেটা ভালো হবে না। তাই যত দ্রুত সম্ভব প্রকাশিত সরকারের কাছে ক্ষমতার হওয়া উচিত।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক বলেন, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটি সময়ের দাবি অনুযায়ী পরিবর্তন হয় এবং সংস্কার চলতে থাকে। এজন্য বিএনপি চায়, একটি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে দেশের সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে যাক। তবে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সংস্কার করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৫
টিএ/এইচএ