ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাজনীতি

নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত ১০ চেয়ারম্যান এখন নৌকারই বিপক্ষে

মাহবুবুর রহমান মুন্না ও এস এস শোহান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০২৪
নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত ১০ চেয়ারম্যান এখন নৌকারই বিপক্ষে

মোংলা-রামপাল ঘুরে: বাগেরহাটের রামপাল ও মোংলায় নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হয়ে এখন নৌকার বিরোধিতা করছেন ১০টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। নৌকার বিরোধিতা শুধু নয়, প্রকাশ্যে ঈগল প্রতীকের পক্ষে ভোট প্রার্থনার পাশাপাশি নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রচারণাও চালাচ্ছেন তারা।

ইউপি চেয়ারম্যানদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হওয়া মোংলা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মো. ইকবাল হোসেন, জেলা পরিষদ সদস্য আব্দুল জলিল শিকদার ওরফে টাইগার জলিল। দীর্ঘদিনের দলীয় সহযোগীর বিরুদ্ধে ভোটযুদ্ধে নেমেছেন তারা। বিষয়টিকে সুযোগবাদী এবং ভোল পাল্টানোর শামিল বলে মনে করছেন তৃণমূল আওয়ামী লীগের কর্মীরা।

প্রকাশ্যে নৌকার বিরোধিতাকারী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ইদ্রিস আলী ইজারাদারের ঈগলের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেওয়া ইউপি চেয়ারম্যানরা হলেন সুন্দরবন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও যুবলীগ নেতা ইকরাম ইজারাদার, মিঠাখালী ইউপি চেয়ারম্যান উৎপল কুমার মন্ডল, বুড়িরডাঙ্গা ইউপি ও যুবলীগ নেতা চেয়ারম্যান উদয় শংকর বিশ্বাস।  

রামপাল উপজেলার বাঁশতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল, ভোজপাতিয়া ইউপি চেয়ারম্যান তরফদার মাহফুজুল হক, উজলকুর ইউনিয়নের মুন্সিবোরহান উদ্দিন জেড, গৌরম্ভা ইউনিয়নের রাজিব সরদার, রামপাল সদর ইউনিয়নের মো. নাসির উদ্দিন হাওলাদার ও পেরিখালী ইউনিয়নের রফিকুল ইসলাম বাবুলও প্রকাশ্যে নৌকার বিরোধিতা করছেন।  

প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র ও খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আব্দুল খালেক ও তার সহধর্মিণী হাবিবুন নাহারের বিষয়ে কটূ বাক্য ব্যবহার করছেন। সেইসঙ্গে প্রকাশ্যে ঈগলের পক্ষে ভোট প্রার্থনা করছেন। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আবু সাইদের নেতৃত্বে রামপালের বিভিন্ন এলাকার আওয়ামী লীগের একটা বড় অংশ ঈগলের পক্ষে কাজ করছে, যারা বিভিন্ন সময় দলীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। এদের বক্তব্য, নৌকার বিপক্ষে নয়, প্রার্থীর বিরুদ্ধে তারা এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নেমেছেন। নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হওয়ার পরে নৌকার বিরোধিতার বিষয়টিকে সহজভাবে দেখছেন না তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। তবে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের ধারণা, ব্যক্তি আক্রোশে নৌকার বিরোধিতা করছেন, শেষ হাসি দলীয় প্রার্থীই হাসবেন।
 
রামপাল উপজেলার মাদারদিয়া গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী জাফর আলী খান বলেন, হাবিবুন নাহার অনেক ভালো মানুষ। প্রধানমন্ত্রী তাকে নৌকা দিয়েছেন, আমরা তার জন্য কাজ করছি। যারা নৌকা প্রতীকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে, নৌকার বিরোধিতা করছেন, তারা সুযোগ-সন্ধানী ছাড়া আর কিছু নন। তাদের কথায় ভোট হবে না।

মোংলা পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. কামরুজ্জামান জসিম বলেন, আমরা শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। এ কারণেই আমরা নৌকার পক্ষে কাজ করছি। যেসব ইউপি সদস্য এখন নৌকার বিরোধিতা করেছন, তারা যখন নির্বাচন করে তখন আমরা তাদের পক্ষেও কাজ করেছিলাম। তারা যে নৌকার বিরোধিতা করছেন, এটা আদর্শচ্যুতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানোর শামিল।  

রামপাল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, নৌকা মানেই শেখ হাসিনা। আমরা শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তে সব সময় শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু রামপাল-মোংলায় কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তকে না মেনে নৌকার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এটা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের শামিল। জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা নৌকার পক্ষে কাজ করতে বলার পরেও তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী ঈগল প্রতীকের পক্ষে প্রচারণা করছেন। এটা খুবই জঘন্য কাজ।

এ বিষয়ে ভোজপাতিয়া ইউপি চেয়ারম্যান তরফদার মাহফুজুল হক বাংলানিউজকে বলেন, আমরা নৌকা নিয়ে পাস করছি ঠিক আছে, কিন্তু আমরা তো নৌকার বিপক্ষে কোনো কথা বলি না। আমরা ব্যক্তি হাবিবুন নাহারের বিপক্ষে। আমরা নৌকার বিপক্ষে না। প্রধানমন্ত্রী আমাদের অপশন দিয়ে দিয়েছেন। আরও যোগ্য নেতারা আছেন, তারা যদি নির্বাচন করতে চান করতে পারবেন। যারা যে পক্ষ নেবে আমার কোনো বাধা-নিষেধ নেই। আমরা নেত্রীর নির্দেশনা মানি। আমাদের প্রতিপক্ষ বলে, আমরা নৌকার সঙ্গে বেইমানি করছি আসলে বিষয়টি তা না। জননেত্রী শেখ হাসিনা চান, এই নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ গ্রহণযোগ্য ও উৎসবমুখর হোক, আমার ভোট আমি যাকে খুশি তাকে দেব। এখানে বিদ্রোহী কোনো প্রার্থী নেই। সবাই স্বতন্ত্র প্রার্থী। তাই আমরা রামপাল-মোংলার প্রায় ১০ ইউপি চেয়ারম্যান স্বতন্ত্র প্রার্থী ইদ্রিস আলী ইজারাদারের ঈগলের পক্ষে কাজ করছি।

রামপাল সদর ইউনিয়নের মো. নাসির উদ্দিন হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, সবাই নৌকার পক্ষ নেবে কেন? শেখ হাসিনা একটা সুযোগ দিয়েছেন, যে কেউ নির্বাচনে করতে পারবেন। যার যেটা ভালো লাগবে সে সেটা বেছে নেবে। দুইজনই আওয়ামী লীগের প্রার্থী। স্বতন্ত্র প্রার্থী যদি না থাকতো আদৌ কি নির্বাচন হতো? আওয়ামী লীগের যারা ত্যাগী নেতা, আমরা স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে আছি। রামপাল-মোংলায় ১৬ জন ইউপি চেয়ারম্যান। তার মধ্যে ১০-১২ জন চেয়ারম্যান স্বতন্ত্র প্রার্থী ইদ্রিস আলী ইজারাদারের ঈগলের পক্ষে একসঙ্গে আছি। রামপাল উপজেলার মধ্যে গৌরম্ভা, উজলপুর, রামপাল সদর, পেরিখালি, ভোজপাতিয়া, বাশঁতলী, মল্লিকের বেড় ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছে। এছাড়া মোংলা উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের মধ্যে তিটির ইউপি চেয়ারম্যানও রয়েছেন আমাদের সঙ্গে।

বাগেরহাটের রামপাল ও মোংলা উপজেলা নিয়ে গঠিত বাগেরহাট-৩ আসন। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক ও তার স্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন হাবিবুন নাহার। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও দলীয় মনোনয়ন পেয়ে ভোটযুদ্ধে নেমেছেন এই নারী। তিনি ছাড়াও সাত জন প্রার্থী নির্বাচন করছেন এখান থেকে। রয়েছে আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীও।  

এবারের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হাবিবুন নাহারের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী ইগল প্রতীকের ঈদ্রিস আলী আজারাদারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। অন্যরা ভোটের মাঠে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন না বলে ধারণা সাধারণ ভোটারদের।

আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ইদ্রিস আলী ইজারদার বলেন, ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মোংলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলাম। বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি দায়িত্ব পালন করছি। আগেও নমিনেশন চেয়েছি পাইনি, তাতে কষ্ট নেই। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা এবার জোর করে ভোটের মাঠে নামিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ মানুষ ও নেতা-কর্মীরা আমার সঙ্গে আছেন। জয় আমার হবে।

আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার বলেন, সবাই সব বিধি-নিষেধ মেনে নিশ্চিন্তে আমরা যেন এ ভোট অনুষ্ঠানটি পার করতে পারি। এ ভোটটিকে বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে যেটি দরকার সেটি হলো ভোটকেন্দ্রে সবার উপস্থিতি।  

তিনি আরও বলেন, পেছনে ফিরে তাকানোর কিছুই নেই, কারণ ২০০১ সালের পর থেকে এ এলাকায় প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে। আর এসব সম্ভব হয়েছে এ প্রতীককে (নৌকা) সামনে নিয়ে। সেই প্রতীকটিকে মানুষ অবশ্যই সম্মান করবেন বলে আমি আশা করি।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০২, ২০২৪
এমআরএম/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।