ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩০ মাঘ ১৪৩১, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

‘আমার সোনা কি দুই বছরেও ইতালিতে পৌঁছায়নি’

সরোয়ার হোসেন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৫
‘আমার সোনা কি দুই বছরেও ইতালিতে পৌঁছায়নি’ লিবিয়ায় গিয়ে নিখোঁজ যুবকদের স্বজনরা, ইনসেটে রানা, শাহীন আর আনোয়ার

যশোর: ‘আমার সোনা দুই বছরেও কি ইতালিতে পৌঁছায়নি? সে তো আর ফোন দেলো না’-কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন মানব পাচারের শিকার রানা হোসেনের মা তানজিলা খাতুন।  

তিনি যশোরের শার্শা উপজেলার চার নম্বর ঘিবা গ্রামের আরশাদ আলীর স্ত্রী।

তার ছেলে রানা হোসেন, চাচাতো দেবর শাহীন আলম এবং চাচাতো ভাসুরের ছেলে আনোয়ার হোসেন লিবিয়ায় দুই বছর নিখোঁজ রয়েছেন।

শাহীন আলম (২৪) ওই গ্রামের জব্বার আলীর ছেলে এবং আনোয়ার হোসেন (২৩) মশিয়ার রহমানের ছেলে।

সংসারে সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় দালালের প্ররোচণায় দুই বছর আগে ইতালির উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়েছিলেন রানা ও শাহীন। দালালের দ্বারা প্রলুব্ধ হয়েছিলেন লিবিয়ায় থাকা আনোয়ার হোসেনও। কথা ছিল, দালাল লিবিয়া থেকে তিনজনকে একসঙ্গে পাঠানো হবে ইতালিতে।  
 
তানজিলা খাতুন জানান, দুই বছর আগে সর্বশেষ যখন রানার সঙ্গে কথা হয়, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা ইতালির উদ্দেশ্যে যাত্রা করছি। মোবাইল ফোন অফ থাকবে। ইতালিতে পৌঁছানোর পর তোমাকে ফোন দেবো’।

শাহীন আলমের মা নুরজাহান বেগম বলেন, ‘লিবিয়ায় অবস্থানকারী মানব পাচারের দালাল সোহাগের কথা মতো লিবিয়ার উদ্দেশ্যে ২০২৩ সালের ২৪ মার্চ তারা ঢাকা থেকে বিমানে ওঠেন। সেখান থেকে তাদের ইতালি নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিল দালাল ও তার বাবা-বোন। ’
 
‘ওই ২৪ মার্চই আমি আমার ছেলের সাথে মোবাইল ফোনে শেষ কথা বলিছি। এ দুই বছরে আর একবারও আমার বাছার (সন্তানের) মুখির কথা শুনতি পারলাম না। ওরা আমার শাহীনের সাথে কি করেছে শুধু সেটুকু বললিও শান্তি পাতাম’-কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন নুরজাহান বেগম।

মানব পাচারকারী সোহাগ আলীর বাড়িও বাহাদুরপুর ইউনিয়নের ধান্যখোলা গ্রামে। তার বাবা মফিজুর রহমান, মা মমতাজ বেগম এবং বোন রুমা খাতুনের প্ররোচণায় পড়ে প্রতিজন আট লাখ টাকা করে দিয়ে ইতালির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। কথা ছিল, লিবিয়ায় যাওয়ার পর সোহাগ আলী তিন যুবককে ইতালিতে পাঠিয়ে দেবেন। এজন্য কোথায় টাকা পরিশোধ করতে হবে লিবিয়া থেকে সোহাগ তার নির্দেশনা দিয়েছেন।  

তানজিলা খাতুন জানান, তার ছেলে রানা একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। পাশাপাশি চাকরি করতেন বেনাপোলের একটি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টে। তিনি নিজে গরু লালনপালন করতেন। মাঠে কিছু জমি চাষাবাদ করেও কিছু রোজগার হতো। সংসার একেবারে খারাপ চলছিল না। কিন্তু, সোহাগের প্ররোচনায় পড়ে বিদেশে সোনার চাকরির স্বপ্নে বিভোর হয়ে যান রানা।

তিনি বলেন, পাচারকারীদের প্রলোভন আর ছেলের তীব্র আকাঙ্ক্ষার কাছে হার মানেন তারা। পাঁচটি গরু, মাঠের সাত শতক জমি বিক্রি করে এবং সমিতি থেকে দেড় লাখ টাকা ঋণ নিয়ে পাচারকারী সোহাগ আলীকে আট লাখ টাকা তুলে দিয়েছিলাম।
 
এ টাকার মধ্যে ৫০ হাজার বিমানের টিকিটের জন্য লেগেছে। সাড়ে তিন লাখ টাকা পাচারকারীর বাবা ও বোনের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। বাকি চার লাখ টাকা ইসলামি ব্যাংকের মাধ্যমে লিবিয়ায় সোহাগের কাছে পাঠানো হয়।

তানজিলা জানান, শাহীন আলম এবং আনোয়ার হোসেনও একই প্রলোভনে পড়েন। সোহাগ লিবিয়া থেকে আনোয়ারকে ইতালিতে যাওয়ার জন্য পটিয়েছিলেন। প্রতিটি পরিবার একই ভাবে টাকা দিয়েছিলেন সোহাগ ও তার বাপ, মা, বোনকে।  

তিন যুবকের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লিবিয়ায় যাওয়ার প্রথম দুই মাস তারা পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। ওই দুই মাস তারা ছিলেন সোহাগের অধীনে। দুই মাস পর একদিন রানা ফোনে মাকে জানান, তারা রাত ৩টার দিকে সাগরপথে ইতালির উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। সেখানে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত তাদের মোবাইল বন্ধ থাকবে।
 
এরপর আর তার সঙ্গে পরিবারগুলোর আর কথা হয়নি। স্বজনরা জানেন না তাদের সন্তানেরা কোথায় আছেন, কীভাবে আছেন। আদৌ তারা বেঁচে আছেন না মারা গেছেন, সেই খবরও কেউ তাদের দিতে পারেননি।  

পরিবারগুলোর দাবি, প্রথম কয়েক মাস পাচারকারী সোহাগ আলী জানাতেন যে তিনজনই ভালো আছেন, জায়গামতো আছেন। সময়মতো তাদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবেন। তারপর থেকে আর কোনো যোগাযোগ করতে চান না সোহাগ আলী।  

পরিবারগুলোর অভিযোগ, এখানে সোহাগের মা-বোনদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তারা খারাপ ব্যবহার করেন।  
বিষয়টি নিয়ে তারা থানায়ও গিয়েছিলেন। কোনো লাভ হয়নি। এলাকার ইউপি মেম্বারদের কাছে বলেছিলেন। বিচারের কথা বলে তারা ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর কাছ থেকে ১০ হাজার করে টাকাও হাতিয়েছেন। কিন্তু, কিছু করেননি।  

এখন পরিবারগুলোর একটাই দাবি, সন্তানদের জীবনে কী পরিণতি ঘটেছে, তা যেনো তাদের জানানো হয়। মারা গেলেও যেনো তারা একটা বুঝ নিয়ে থাকতে পারেন।  

বাহাদুরপুর ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার সুজন উদ্দিন জানান, সোহাগ ও তার পরিবারের সদস্যরা টাকা নিয়ে তিন যুবককে লিবিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। এ পরিবারের বিরুদ্ধে বাইরে থেকেও পাচারের অভিযোগ নিয়ে লোকজন আসেন।

শাহীন আলমের মা মোছা. নুরজাহান ছেলেকে পাচারের অভিযোগে ২০২৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর যশোরের মানব পাচার ট্রাইব্যুনাল ২ এ একটি পিটিশন দায়ের করেছিলেন। আদালত অভিযোগটি তদন্তের জন্যে পিবিআইকে নির্দেশ দেন।  

বাংলাদেশ সময়: ২০১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৫
এসআই


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।