বগুড়া: ঋতুচক্রে অগ্রহায়ণ চলমান। কার্তিক-অগ্রহায়ণ এ দু’মাস হেমন্তকাল।
গ্রাম-বাংলার অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসলেও খেজুরের রস এখনও টিকে আছে। তবে, ব্যাপক পরিসরে না হলেও প্রত্যেক বছরের শীত মৌসুমেই দেখা মেলে এই খেজুর রসের। তাই খেজুরের রস পেতে গাছ পরিচর্যায় নেমেছেন বগুড়ার গাছিরা।
বগুড়ার ১২ উপজেলার মধ্যে শাজাহানপুর, শেরপুর, কাহালু, নন্দীগ্রাম, আদমদীঘি বরেন্দ্রখ্যাত উপজেলা হিসেবে পরিচিত। জেলার কয়েকটি উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, খেজুরের রস আহরণ শুরু করেছেন গাছিরা এবং তারা নিয়মিতভাবে গাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ধাপে ধাপে চলে রস নামানোর কাজ। ইতোমধ্যে গ্রামাঞ্চলে গাছিরা খেজুর গাছ থেকে রস নামানোর কাজে নেমে পড়েছেন। বগুড়ায় এসব উপজেলাসহ অন্যান্য উপজেলা মিলে বগুড়ায় প্রায় ৪৪ হাজারের মতো খেজুর গাছ রয়েছে। তবে কালের আবর্তে খেজুর গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, গ্রামীণ জনপদের বিভিন্ন রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধ খেজুরগাছ। জমির আইলে ও পতিত জায়গায়ও রয়েছে অসংখ্য খেজুর গাছ। বিশেষ করে শাজাহানপুর, কাহালু ও নন্দীগ্রাম উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা মেলে এ দৃশ্য। গাছিরা প্রথমে গাছের মাথা থেকে ডালপালা কেটে পরিষ্কার করেন। পরে নির্দিষ্ট স্থান হালকা করে কেটে পরিষ্কার করেন তারা। এর কিছুদিন বিরতির পর আবার কয়েক দফায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে ছেঁটে ফেলা হয় গাছের ছাল। গাছ কাটার এ কাজে গাছিরা ছ্যান (স্থানীয় ভাষায়) নামে ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেন। গাছ কাটার সময় খেজুর গাছের সঙ্গে নিজেদের শক্তভাবে দড়ি দিয়ে বেঁধে নেন তারা। তাদের সঙ্গে থাকে বাঁশের তৈরি পাত্র। যার ভেতর থাকে গাছ পরিষ্কার করার বিভিন্ন সরঞ্জামাদি। গাছ তৈরির প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর থেকেই মূলত রস নামানোর পর্বটা শুরু হয়।
এরপর গাছের মাথার নির্দিষ্ট স্থানে বাঁশের বানানো দু’টি চোখা খুঁটি পোতা হয়। সঙ্গে দড়ি বা সুতা বেঁধে মাটির পাত্র ঝুলে দেওয়া হয়। পাত্রের ভেতর রস পড়ার জন্য বাঁশের তৈরি নালার মতো ভিন্ন একটি খুঁটি পুঁতে দেওয়া হয় সেই গাছের সঙ্গে। এভাবেই গাছির নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে খেজুর রস।
বগুড়ার কাহালু উপজেলার গাছি বাবলা প্রামাণিক, মুন্নাফ আলী বাংলানিউজকে জানান, শীতের সকালে মানুষ খেজুর রসে মুড়ি মাখিয়ে খেতে পছন্দ করে। গ্রামে গ্রামে চলে খেজুর রসের পায়েস, পিঠা-পুলি তৈরির ধুম। মেয়ে জামাই ও স্বজনদের নিমন্ত্রণ করে বাড়ি বাড়ি চলে শীতের বাহারি পিঠা উৎসব। খেজুর রসে বানানো হয় নালি, দানাদার ও পাটালি গুড়ও।
তারা আরও জানান, গাছের মাথা হালকাভাবে ছেঁটে দিয়ে প্রতিদিন বিকেলে নির্ধারিত স্থানে মাটির পাত্র ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। পরদিন ভোরে গাছ থেকে পাত্র নামিয়ে আনা হয়। গাছভেদে দু’থেকে চার কেজি হারে রস পাওয়া যায়। সপ্তাহে দু’ থেকে তিন দিন পরপর রস সংগ্রহ করা হয়।
গাছিরা জানান, বাণিজ্যিকভাবে কেউ খেজুর গাছ লাগায় না। প্রাকৃতিকভাবেই এসব খেজুরগাছ জন্ম নিয়েছে। পতিত জমি, ভিটা, জমির আইলসহ বিভিন্ন স্থানে এসব খেজুর গাছের দেখা মেলে। একটি সময় এ জেলায় বিপুল সংখ্যক খেজুর গাছ ছিল। মানুষ সিংহভাগ খেজুর গাছ কেটে ফেলেছেন। এছাড়াও খেজুর গাছের বয়স বাড়ার কারণে সব গাছ থেকে রস উৎপাদনও হয় না। আবার কিছু কিছু খেজুর গাছ আছে দেখতে অনেক মোটা তাজা হলেও সেই গাছ থেকে রস পাওয়া যায় না। শীত মৌসুমে রস-গুড় উৎপাদন করে অন্তত ছয় মাস স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন তারা। এ থেকে তারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হন। পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হয়।
শাজাহানপুর উপজেলার গাছি পলাশ তালুকদার রস সংগ্রহের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বাংলানিউজকে বলেন, সাধারণত কার্তিক মাসে রস সংগ্রহের জন্য গাছগুলো প্রস্তুত করতে হয়। একটা গাছকে ডাল পালা কেটে প্রস্তুত করতে একদিনের মতো সময় লাগে। রস সংগ্রহের জন্য সাধারণত মাটির হাড়ি ব্যবহার করা হয় এবং হাড়ির ধারণ ক্ষমতা আট থেকে ১০ লিটারের মতো হয়। রসকে ভালো রাখার জন্য হাড়ির ভেতরে চুনের প্রলেপ দেওয়া হয়। তবে যে গাছের কাঁচারস খাওয়া হয়, সে গাছের হাঁড়িতে কোনো চুন দেওয়া হয় না।
তিনি আরও বলেন, একটা গাছ থেকে দুই-তিন মাস রস পাওয়া যায়। গাছ ভেদে এক থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত রস পাওয়া যায়। গাছ থেকে রস সংগ্রহের একটা নিয়ম আছে। প্রথম তিন দিন রস সংগ্রহের পর পরবর্তী তিন দিন গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা যাবে না। বিকেল ৪টা থেকে রস সংগ্রহের জন্য গাছে গাছে হাঁড়ি বাঁধা হয়। পরদিন কুয়াশা ঘেরা ভোরে অর্থাৎ ভোর সাড়ে ৩টা-৪টা থেকেই শুরু হয় রস সংগ্রহের কাজ।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী পরিচালক কৃষিবিদ মো. ফরিদুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, নভেম্বর থেকে শুরু করে মোটামুটি ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খেজুর রস সংগ্রহ করা যায়। ইতোমধ্যেই জেলার বিভিন্ন উপজেলায় গাছিরা এই রস সংগ্রহে মাঠে নেমে পড়েছেন। খেজুর গাছের জন্য বাড়তি কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। কৃষি বিভাগ কৃষকদের বাড়ির আশপাশ, জমির আইল, পুকুরপাড় এবং সড়কের ধারে খেজুর গাছ লাগানোর পরামর্শ দিয়ে থাকে। পরিত্যক্ত জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খেজুর বাগান গড়ে তোলা হলে কৃষকেরা আরও বেশি লাভবান হবেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০২৪
কেইউএ/এসএম