ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ভক্ত-পুণ্যার্থীর ভিড়ে মুখরিত নরসিংদীর ঐতিহ্যবাহী বাউলমেলা

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৪
ভক্ত-পুণ্যার্থীর ভিড়ে মুখরিত নরসিংদীর ঐতিহ্যবাহী বাউলমেলা

নরসিংদী: নরসিংদী শহরের মেঘনা নদীর তীরে ভক্ত ও পুণ্যার্থীর ভিড়ে মুখরিত হয়ে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী বাউল মেলা। ভারতসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা কয়েকশ বাউল সাধক যোগ দিয়েছেন মেলায়।

বাউলরা বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে মানবধর্ম ও সাম্যের জয়ধ্বনি করছেন। বাউল সম্প্রদায়ের নিয়ম অনুযায়ী প্রায় সাতশ বছর ধরে মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে শহরের কাউরিয়াপাড়ার শ্রী শ্রী বাউল ঠাকুরের আখড়ায় এ মেলার আয়োজন করা হয়। গত বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া বাউলমেলা চলবে আগামী বুধবার পর্যন্ত।

বাউল সাধকরা জানান, এ আখড়ায় বাউল ঠাকুরের অন্তর্ধান হয়েছিল। বাউল আখড়ায় জগন্নাথ দেবতার মন্দির রয়েছে। মন্দিরে মহাবিষ্ণুর পূর্ণাঙ্গ প্রতিমা, জগন্নাথ দেবতার প্রতিমা, মা গঙ্গার গট, নাগ দেবতার বিগ্রহ ও শিবলিঙ্গ রয়েছে, যা বাউল ঠাকুর নিজে প্রতিস্থাপন করে গেছেন বলে কথিত রয়েছে। পাশে রয়েছে বাউল ঠাকুর ও মাতাজির সমাধি মন্দির। সবার মধ্যখানে রয়েছে উপাসনার জন্য বিশাল আটচালা বৈঠক ঘর।

সেই ঘরেই দেশ-বিদেশের বাউল সাধকরা সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বৈঠকে মিলিত হচ্ছে। এই আখড়ার বৈঠক প্রচলিত বৈঠকের মতো নয়। এ বৈঠকে কেউ কথা বলেন না। শুধু সাধকের গাওয়া গানের মর্মার্থ উদ্ধার করার চেষ্টা করা হয়।

বৈঠক ঘরে গান গাইছিল অরুন চন্দ্র দে। তিনি বলেন, আমাদের গাওয়া গানগুলো সাধারণ বাউল সংগীত না। এগুলো শত শত বছর ধরে চলে আসা মানবতার গান। মানবের কল্যাণের নিমিত্তেই আমাদের এসব পরিবেশনা।

শনিবার দেবতা ব্রহ্মার পূজা মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। মহাযজ্ঞ পরিচালনা করেন সেবায়েত স্বপন কুমার বাউল। তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে সব ধর্মকে মানবতার ঊর্ধ্বে তোলার জন্যই বাউল ঠাকুরের আবির্ভাব হয়েছিল। তাই বাউলমেলায় বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষ অংশ নেয়। মহাযজ্ঞে জগতের কল্যাণের জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের পূজা করা হয়। ঠাকুরের কাছে দেশ ও মানুষের কল্যাণে প্রার্থনা করা হয়।

মহাযজ্ঞে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে শত শত নারী-পুরুষ অংশ নেয়। মেলায় আসা ভক্তরা মনোবাসনা পূরণে বাউল ঠাকুরের সমাধিতে প্রদীপ প্রজ্বালন করে। তা ছাড়া নিজেদের মঙ্গল চেয়ে প্রার্থনা করেন।  

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা থেকে আগত বাউল ভক্ত বীনা দাস বলেন, আমরা এই দিনটার জন্য সারা বছর অপেক্ষা করি। ঠাকুরকে যারা বিশ্বাস করে তাদের মঙ্গল ঠাকুর অবশ্যই করে। আমাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। আগরতলাতে ও বাউল সমাজে আজকে যজ্ঞ হয়েছে। সেখানেও ঠাকুরের আরাধনা করা হয়। আমরা গানের মাধ্যমে ঠাকুরের বন্দনায় মেতে থাকি।

নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা প্রিয়াঙ্কা চৌধুরী বলেন, ছোটবেলা থেকেই বাউল মেলাই আসি। ঠাকুরের যজ্ঞের দিন ঘি বাতি দিয়ে পূজা অর্চনা করি। সারা বছরই মেলার জন্য অপেক্ষা করি। এবার ছেলে-মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই মেলায় এসেছি, খুব ভালো লাগছে।

নরসিংদী শহরের কালীপদ দাস বলেন, আমাদের বিশ্বাস, বাউল ঠাকুর জাগ্রত। বাউল ঠাকুর মনের ঠাকুর। মনেপ্রাণে ডাকলেই ঠাকুরকে পাওয়া যায়। তাই পরিবারের ও বিশ্ব মানবতার মঙ্গল কামনায় ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেছি।

বাউল আখড়ার মনি বাউল বলেন, জীবের মঙ্গলার্থে বাউল ঠাকুরের আবির্ভাব হয়েছিল। কীভাবে সহজে মানুষ নিজেকে চিনতে পারবে সেই পথ তিনি দেখিয়ে গেছেন। আমরা তার পথ অনুসরণ করে ভেদাভেদ বিভেদ না করে ঈশ্বরের সৃষ্টিকে ভালোবেসে যাচ্ছি।

শ্রী শ্রী বাউল ঠাকুরের আখড়া এবং বাউল মেলার তত্ত্বাবধায়ক সাধন চন্দ্র বাউল বলেন, আনুমানিক সাতশ বছরেরও বেশি সময় আগে কোনো এক বাউল সাধক এখানে এসে আখড়া স্থাপন করে মানবধর্ম ও মানবের কল্যাণের জয়গান গেয়েছেন। সেই থেকে এখানে এই আয়োজন। এখানে প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে যজ্ঞের মাধ্যমে সব জীবজগৎ ও মানব জাতির কল্যাণ কামনা করা হয়। এবার বুধবার মেলার মহাপ্রসাদ বিতরণ করা হবে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই বাউল ঠাকুরের মেলায় আসে। আমরা মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করি। আমাদের মনের মলিনতা দূর করার জন্য প্রার্থনা করি।

অন্যদিকে, বাউল আখড়ার উৎসবকে কেন্দ্র করে মেঘনা নদীর তীরে বসেছে মেলা। মেলার এক কোনে বসেছে চরকি, নাগরদোলাসহ সাপের খেলার আয়োজন। পাশেই দুই সারিতে শ’খানেক বাচ্চাদের খেলনার দোকান। মাটির পুতুল, হাড়ি, কলসসহ বিভিন্ন তৈজসপত্র বিক্রি হচ্ছে পুরোদমে। সেই সঙ্গে রয়েছে জিলেপিসহ বিভিন্ন খাবারের সমারোহ।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৪
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।