ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাজেট বরাদ্দ কমেছে সাড়ে চার শতাংশ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০২৩
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাজেট বরাদ্দ কমেছে সাড়ে চার শতাংশ

ঢাকা: ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ তথা আদিবাসীরা মানবসত্তার মর্যাদা ও মানব উন্নয়নের সম্ভাব্য সব মাপকাঠিতেই অতি দরিদ্র। যেখানে পাহাড়ী সমতলের প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বহুমুখী দারিদ্রের হার ৮০ শতাংশ ছাড়িয়েছে।

ঠিক এই অবস্থায় গত অর্থ বছরের তাদের বাজেট বরাদ্দ ৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ কমিয়েছে সরকার।

রোববার (১৫ জানুয়ারি) বিকেলে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশের পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য বাজেটে কতটা বরাদ্দ রাখা হয় এবং কতটা ব্যয় করা হয়’ শীর্ষক সেমনিারে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পক্ষ এই সংক্রান্ত একটি গবেষণার প্রেক্ষাপট, ফলাফল ও সুপারিশ করেন উপস্থাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল বারাকাত।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনগোষ্ঠীর আর্থিক সমস্যার কথা তুলে ধরে আধ্যাপক আবুল বারাকাত বলেন, করোনা মহামারির আগে যখন জাতীয় দারিদ্র্যের হার যখন ২১ দশমিক ৮ শতাংশ তখন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত জেলাগুলোতে তা ছিল ৬০ শতাংশ। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের গড় আয় জাতীয় গড় আয় থেকে কম। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে ২৬ শতাংশের কম, সমতলের ক্ষেত্রে ৪১ শতাংশের কম। সমতলের দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ কার্যত ভূমিহীন।  

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের বাজেট বরাদ্দ বাড়াননোর তাগিদ দিয়ে আবুল বারাকাত বলেন, গত ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের তুলনায় ২০২১-২০২২ অর্থবছরে পাহাড় ও সমতল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের জন্য বাজেট বরাদ্দ কমেছে ৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ। যা টাকার অঙ্কে প্রায় ১০৮ কোটি টাকা। গত অর্থ ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে পাহাড় ও সমতল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বরাদ্দ ছিল দুই হাজার ৫০৮ কোটি টাকা, ২০২১-২০২২ এ হয়েছে দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা। মুদ্রাস্ফীতিকে বিবেচনায় আনা হলে এই বাজট হ্রাসের পরিমাণ বেড়ে ৬ শতাংশে দাঁড়াবে।

সমীক্ষায় এই তথ্যগুলো উপস্থাপন করে অধ্যাপক আবুল বারাকাত বলেন, জাতীয় বাজেটে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য যেমন পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হয়না, তেমনি বাজেট তৈরি করার প্রক্রিয়ার মধ্যেও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের অংশগ্রহণও খুব সামান্য। এমনকি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নেতা ও জনগণের কাছে জানতে চাওয়া হয় না যে তাদের কী প্রয়োজন, কতটা প্রয়োজন। যে কারণে ‘খুব একটা দরকারি নয়’ এমন বিষয়ও বাজেটে ধরা হয়, আবার কিছু জরুরি প্রয়োজনও উপেক্ষিত হয়। সেজন্যই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য বাজেট বরাদ্দ, বাজেট ব্যয় এবং প্রকৃত প্রয়োজনের ব্যাপারটি উপেক্ষিতই থেকে যায়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, আমরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছি। এরই মধ্যে আমরা বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়েছি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ দেশের সার্বিক উন্নয়নেরই অংশ। তাদের বঞ্চিত করে দেশ এগিয়ে যাবে না। আমরা সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে কাজ করছি।

সমীক্ষায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের জীবনমান উন্নয়নে জন্য একটি সাধারণ সুপারিশমালা উপস্থাপন করেন। যেখানে সাতটি বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।  

১. ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের জন্য সমতল, পার্বত্য নির্বিশেষে বাজেট বরাদ্দ অন্তত দ্বিগুণ বাড়াতে হবে; ২. শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মানব উন্নয়ন এবং আর্থিক উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট খাতসমূহে বরাদ্দ বর্তমানের তুলনায় ৩ গুণ বাড়াতে হবে, ৩. বাজেটে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের জন্য সংশ্লিষ্ট সব খাত উপখাত ভিত্তিক লাইন আইটেমসহ বরাদ্দ প্রদর্শন করতে হবে, 'পার্বত্য' ও 'সমতল' এর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের জন্য ওই বরাদ্দ ভিন্ন ভিন্ন দেখানো স্বচ্ছতার নিরিখে যুক্তিসংগত হবে, ৪. ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় পাঠ্যবই, উপকরণ, হোস্টেলসহ শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ সম্পর্কে বাজেটে যথাযথ বরাদ্দ রাখতে হবে; ৫. অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ কোনো অবস্থায় যেন বাস্তবায়ন বা ব্যয় পর্যায়ে হ্রাস না পায় তা নিশ্চিত করতে হবে, ৬. বরাদ্দের গুণগত ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে অর্থাৎ অভিষ্ট জনগোষ্ঠীর কাছে যাতে বরাদ্দের যতটুকু পৌঁছার কথা ততটুকু পৌঁছায় এবং তাদের সুফল ভোগের মাত্রা কাম্য পর্যায়ে থাকে ও ৭. প্রকল্প নির্বাচন থেকে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণের প্রতিটি পর্যায়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের জন্য তিনটি বিশেষ সুপারিশমালা উপস্থাপন করেন।

১. সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের দারিদ্র্য নিরসন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় এবং সেই মন্ত্রণালয়ের জন্য যথাযথ বাজেট বরাদ্দ থাকা জরুরি; ২. সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য একটি ভূমি কমিশন গঠন করে ওই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতার সঙ্গে কার্যকর করতে মধ্যমেয়াদী (৫ বছরব্যাপী) বরাদ্দ দিতে হবে, ৩. হাওর, উপকূল, বরেন্দ্রভূমি এবং সমতলের অন্যান্য এলাকায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের বে-দখল হয়ে যাওয়া জমি-জলা পুনরুদ্ধারে বাজেটে বরাদ্দসহ কার্যকর উদ্ধার মেকানিজমের পথনির্দেশ থাকতে হবে৷

পার্বত্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৪টি বিশেষ সুপারিশমালা উপস্থাপন করেন, যেখানে-
১. পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট ৩ ভাগে বিভক্ত করে উপস্থাপন করতে হবে: (ক) ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের জন্য, (খ) বাঙালিদের জন্য এবং (গ) উভয়ের জন্য ২. নির্বাচিত জেলা পরিষদের মাধ্যমে পার্বত্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প প্রণয়ন করে সেখানে যথাযথ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে; ৩. জুম চাষীদের অন্তত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত যে ৩ মাস তারা কর্মহীন থাকে সেই সময়ের জন্য জরুরি মানবিক সেবা হিসেবে রেশনের ব্যবস্থা করতে হবে ৪. পার্বত্য শান্তি চুক্তির দুই যুগ পূর্তির প্রেক্ষিতে বিশেষ বাজেটীয় বরাদ্দ দিয়ে চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন জরুরি; ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন এবং সম্পর্কিত’ এ ধরনের কোনো লাইন আইটেমে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার রক্ষায় মধ্যমেয়াদে আগামী ৫ অর্থবছরে (২০২৩-২৪ থেকে ২০২৭-২৮) কমপক্ষে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখতে হবে।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নেতা সঞ্জীব দ্রং সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০২৩
১৫ জানুয়ারি/এসআর
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।