ঢাকা: ২০১৬ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে নিয়ে মন্তব্যের জেরে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে হট্টগোল ও একপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট বিচারপতিকে লক্ষ্য করে ডিম ছুড়ে মারার ঘটনা ঘটেছে। এরপর বিচারপতি এজলাস থেকে নেমে যান।
বুধবার (২৭ নভেম্বর) দুপুর আড়াইটার দিকে বিচার কাজ চলা অবস্থায় বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি কাজী ওয়ালিউল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ ঘটনা ঘটে।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত। পরে সুপ্রিম কোর্টের ৯ জন আইনজীবীর রিট আবেদনে হাইকোর্ট ২০১৬ সালের ৫ মে এ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন।
এই রায়ের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল তার পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাক বাকুম করে ক্ষমতা নিয়ে নিলেন তথা রাষ্ট্রপতির পদ দখল করলেন। একবারও ভাবলেন না, তিনি একজন সরকারি কর্মচারী। সরকারি কর্মচারী হয়ে কীভাবে তিনি আর্মি রুলস ভঙ্গ করেন। ভাবলেন না তার শপথের কথা। ভাবলেন না তিনি দেশকে রক্ষা করতে প্রয়োজনে মৃত্যুকে বরণ করার শপথ নিয়েছিলেন। ভাবলেন না, তিনি এবং তারা ব্যর্থ হয়েছিলেন দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করতে। ভাবলেন না, তিনি এবং তারা ব্যর্থ হয়েছেন জাতীয় চার নেতাকে রক্ষা করতে। ’
জনগণ আশ্চর্য হয়ে দেখল মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারী এবং জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের দোসর হয়ে তাদের রক্তাক্ত হাতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করল। যাকে এক কথায় বলা যায় বন্দুক ঠেকিয়ে জনগণের প্রতিষ্ঠান দখল।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারপতি আশরাফুল কামাল আরও বলেন, আমরা জানি ডাকাতরা সংঘবদ্ধভাবে ডাকাতি করে। ডাকাতদের যে নেতৃত্ব দেয় তাকে ডাকাত সর্দার বলে। ডাকাতি করার সময়ে ডাকাতরা বাড়িটি বা ঘরটি কিছু সময়ের জন্য অস্ত্রের মুখে দখল করে এবং মূল্যবান দ্রব্যাদি লুণ্ঠন করে। বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান গংরা দেশে নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকা সত্ত্বেও অস্ত্র এবং অবৈধ কলমের খোঁচায় নির্বাচিত জাতীয় সংসদকে ভেঙে ডাকাতদের মতো অবৈধভাবে জোরপূর্বক জনগণের ক্ষমতা ডাকাতি করে দখল করেন। যে বিচার বিভাগ এবং এর বিচারকদের ওপর আইনগত দায়িত্ব ছিল সংবিধানের সামান্যতম বিচ্যুতিকে রক্ষা করা, সংরক্ষণ করা এবং নিরাপত্তা প্রদান করা; সেই বিচার বিভাগ এবং এর তৎকালীন বিচারকরা সংবিধানকে এক কথায় হত্যা করলেন, জনগণের রায় ডাকাতি করে ‘জনগণের নির্বাচিত সংসদকে বাতিল করলেন।
অপরদিকে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নিয়মিত একজন সরকারি কর্মচারী হয়েও আর্মি রুলস ভঙ্গ করে, জনগণের রায়ে নির্বাচিত জাতীয় সংসদকে হত্যা করে, দেশের সংবিধানকে হত্যা করে অস্ত্রের মুখে অন্যায়ভাবে, অসৎভাবে হত্যাকারীদের দোসর হয়ে জনগণকে চরম অবজ্ঞা করে ক্ষমতা দখল করেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী তথা স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর, আল- শামস এবং জামায়াতে ইসলামীকে এদেশে পুনর্বাসন করেন। যাদের রাজনীতি করার অধিকার দেন, তাদের নাগরিকত্ব দেন। (যে নাগরিকত্বকে আমাদের তথাকথিত জামায়াতী এবং স্বাধীনতাবিরোধী মানসিকতার বিচারকরা বৈধ বলেন)। তিনি স্বাধীনতাবিরোধী এবং মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সংসদ সদস্য করেন এবং তাদের মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের সঙ্গে এবং দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের সঙ্গে বেইমানি করেন। এর পরেও কি বাংলাদেশের জনগণ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযোদ্ধা বলতে পারে?
মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান শুধু জাতির পিতা ও তার পরিবারের এবং জাতীয় চার নেতা হত্যাকারীদের শুধু দোসরই হননি, বরং তিনি জাতির পিতা ও তার পরিবারের হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করেছেন রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্য ইত্যাদি বানিয়ে। তিনি আরও জঘন্য যে কাজটি করেছেন, তা হল তিনি জনগণের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা ও তার পরিবারের হত্যাকারীদের হত্যার বিচার বন্ধ করে দায়মুক্তি আইন প্রণয়ন করেন। অর্থাৎ তিনি জাতির পিতা ও তার পরিবারের হত্যাকে এই দায়মুক্তি আইন দ্বারা সমর্থন দিয়ে প্রমাণ করেন তিনিও জাতির পিতা ও তার পরিবারের হত্যাকারী এবং জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদেরই একজন।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন আইনজীবী জানান, ‘দুপুর আড়াইটার দিকে এই বেঞ্চে বিচারকাজ চলছিল। কার্যতালিকার ১২ নম্বর আইটেম শুনানির সময় কয়েকজন আইনজীবী দলবেঁধে এজলাস কক্ষে ঢুকে সরাসরি ডায়াসের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। তাদের একজন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালকে উদ্দেশ্য করে বলেন, একজন বিচারপতি হয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে রায়ে রাজনৈতিক ভাষায় বিরূপ মন্তব্য করেছেন। পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে আপনি এমনটা করেছেন। ফলে আপনার শপথ ভঙ্গ হয়েছে। বিচারকাজ পরিচালনা করার অধিকার হারিয়েছেন আপনি। আপনি এখনও যদি একই চিন্তাভাবনা পোষণ করেন তাহলে আপনার বিচারকাজ পরিচালনার অধিকার নাই। এসময় আরেকজন আইনজীবী বিচারপতি আশরাফুল কামালকে এজলাস থেকে নেমে যেতে বলেন। তখন পেছন থেকে একজন ডিম ছুঁড়ে মারেন, যদিও তা বিচারপতির গায়ে লাগেনি। এর পরই হট্টগোল শুরু হলে দুই বিচারপতি এজলাস ত্যাগ করেন।
এদিকে এর কিছুক্ষণ আগে হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার মুন্সী মশিয়ার রহমানের কক্ষের সামনে অবস্থান নেন কয়েকজন আইনজীবী। তারা এই রেজিস্ট্রারকে আগের সরকারের দোসর উল্লেখ করে নেমপ্লেট কালি দিয়ে মুছে দেন। কিছুক্ষণ পর তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
তবে দুটি ঘটনা কারা ঘটিয়েছেন তা জানা যায়নি।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঁঞা জানান, দুটি ঘটনা কর্তৃপক্ষ জেনেছেন। এর বেশি কিছু বলতে পারবো না।
বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, নভেম্বরর ২৮, ২০২৪
ইএস/আরএ