ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

উপ হাইকমিশনার জকি আহাদের ‘বিচ্ছিন্ন ভাবনা’

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১৭
উপ হাইকমিশনার জকি আহাদের ‘বিচ্ছিন্ন ভাবনা’ কলকাতায় বাংলাদেশের উপ হাইকমিশনার জকি আহাদ- ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কলকাতা: “আমার পূর্ব পুরুষ আমার সর্বস্ব/ ভুলেও ভুলি না কভু/ যত দিন তারা ভবেতে রয়েছেন/ আমায় ততদিন রেখ প্রভু”... জকি আহাদ।

বইমেলার প্রথম দিনই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর হাতে উদ্বোধন ‘বিচ্ছিন্ন ভাবনা’। লেখক কলকাতায় বাংলাদেশের উপ হাইকমিশনার জকি আহাদ।

বইটির শুরুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি শুভেচ্ছা পত্র লিখেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, এই বই দুই বাঙলার ‘মা-মাটি মানুষের মহা মিলনের’ মন্ত্র। আর কবি বইটি উৎসর্গ করেছে তাদের সবাইকে, যারা নিজের ভাবনায় অন্যদের কষ্ট দেন না।

এর কারণ, কবির বই প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য হলো- সব মানুষই সমান। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টিকর্তা করেননি বা বলা যায় করেন না। যদি তিনি না করেন তাহলে আমরা করবো কেনো। কেনো ধর্মের নামে খুন হবে। যারা ধর্মের নামে খুন করে বা অন্য ধর্মকে আঘাত করে তারা সত্যিকারের ধার্মিক নন। কারণ পৃথিবীর কোনো ধর্ম অন্য ধর্মকে ঘৃণা করতে শেখায় না।

এছাড়া বইয়ের পরতে পরতে উঠে এসেছে কবির জীবন দর্শনের নানা অধ্যায়। যেখানে এক কূটনীতিকের দায়িত্ব সামলানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে এক মননশীল মানুষের বিভিন্ন ভাবনা। প্রাক কথনে উঠে এসেছে কবির বেড়ে ওঠার দিনগুলোর কথা। মা, বাবা, ভাই, বোন বন্ধুদের যথেষ্ট প্রভাব যে কবির জীবনে পড়েছে সেটা প্রাক কথনেই পাঠক জানতে পারবেন।

পেশাগত কারণে ব্যক্তিগত জীবনে কর্মের খাতিরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গেছেন জকি আহাদ। কবিতাগুলোর নিচে সেই দেশ, সেই শহর আর সাল তারিখ পাঠককে শব্দ চয়নের মাধ্যমে সেই সময়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায়।
কলকাতায় বাংলাদেশের উপ হাইকমিশনার জকি আহাদ
বই প্রকাশের পর ফুরসতহীন ব্যস্ততার মধ্যেও বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তবে সাধারণভাবে একজন কবি বা একজন উপ রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাতকার যেরকম হয় এটি সেরকম ছিল না। ঘটনাচক্রে এই সাক্ষাতকার হয়েছিল কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর পাশে বসে। কারণ তখন ভর্তি ছিলেন জকি আহাদের বাবা নূর আল আহাদ। উপ হাই কমিশনারের জীবনে তার বাবা ও মার প্রভাব বারবার উঠে এসেছে তার কবিতার মধ্যে দিয়ে।

কবিতা লেখা নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে তার বেড়ে ওঠার প্রভাবের সঙ্গে কবি জোর দিয়েছেন বিভিন্ন দেশে কাজ করার অভিজ্ঞতাকে। প্রতিটি কবিতায় স্পষ্টভাবে ধরা দিয়েছে সমসাময়িক রাজনীতি, বিশ্ব ভাতৃত্ববোধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। হাসপাতালে বসে সাক্ষাতকার মধ্যে বারবার উঠে যেতে হয়েছে উপ হাই কমিশনারকে। প্রশ্নের উত্তর মুখে দিলেও চোখ কিন্তু ছিলো তার বাবার দিকে।   সেই সময় তার চোখে ধরা পড়েছে পিতার জন্য এক সন্তানের উদ্বিগ্ন দৃষ্টি।

কবিতায় খুব সাবলীল ভাবে উঠে এসেছে কবির ধার্মিক মানসিকতা। এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে উপ হাইকমিশনার জকি আহাদ জানিয়েছেন, ধর্ম নিয়ে ভেদাভেদে তিনি বিশ্বাসী নন। সেই কথা ধরা পড়েছে তার কবিতাতেও। ম্যানচেস্টারে বসে ২০১৩ সালের লেখা কবিতা 'মহা প্রভু'-তে তিনি লিখেছেন, ‘খোদা যদি হয় সৃষ্টি কর্তা/ সব সৃষ্টির স্রষ্টা/ নাম নিয়ে তাঁর কেন টানাটানি/ নয় কি তিনি সর্বদ্রষ্টা?” ধর্মের প্রতি তার অপার বিশ্বাস ফুটে উঠেছে এই লাইনগুলিতেই। উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

কবি কলকাতায় বসে ‘মুক্তিযুদ্ধের পতাকা’ কবিতায়  লিখেছেন “পৃথিবীর বুকে একটি জাতি/ শুধুই ভাষার তরে/ আদায় করেছিল একটি দেশ/ মরমে ও অন্তরে”।

তার কবিতায় এসেছে ছিটমহল হস্তান্তরের মতো বিষয়ও। কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছে দেশপ্রেম। যেমন ‘আমার ৭১’ কবিতায় কবি লিখেছেন এমন চারটি লাইন যা ভবিষ্যতের বাংলাদেশের একটি ছবি তুলে ধরে। তিনি লিখেছেন “আগামী ২১- এ মধ্যম আয়/ আর ৪১-এ উন্নত জাতি,/ হবই যে আমারা / প্রমাণ করব প্রগতি”।

কবিতায় ভিন্ন চেহারায় ধরা দিয়েছে প্রেম। যার ব্যপ্তি ব্যক্তি ছাড়িয়ে সমষ্টি এবং সমষ্টি ছাড়িয়ে বিশ্ব প্রেমে পরিণত হয়েছে। ধর্ম প্রেমের সাথে অবলীলায় কবি মিশিয়েছেন বিশ্ব প্রেমকে। যা  কবিতাগুলির অপর এক বৈশিষ্ট। তিনি আবার লিখেছেন “সাচ্চা আউলিয়া তুমিও পাবে /ফেরে নাকো হাত জার/ আমিও খনি পেয়েছি ধরাতে / নাম বিশ্ব দরবার”।

দুই বাঙলার সৌভাতৃত্বের কথা বারবার উঠে এসেছে লেখাতে। কলকাতায় বসে লেখা ‘মা-মাটি –মানুষের মহামিলন’ কবিতায় জকি আহাদ লিখেছেন ‘অনাবিল সুখ দু ভূভাগে বিরজিত/ বহমান সুখধারা / স্থান কাল সব মোরাই গড়িবো/ নইকো বিভেদে ছেঁড়া’।

বইয়ের প্রতিটি পাতায় রয়েছে রঙের খেলা। কবিতার সাথে মিশে গেছে সেই রঙ। দেখে মনে হয় যেনো রঙের আবেশে জেগে আছে কবিতার চেতনা। প্রচ্ছদ থেকে প্রতি পাতায় পাতায় রঙ ছড়িয়েছেন জাতীয় কবি নজরুলের পৌত্র শিল্পী কাজী অনির্বাণ। তার গ্রাফিক ডিজাইন বইটিকে বাস্তবিক অর্থে নতুন মাত্রা দিয়েছে। বইয়ের প্রকাশক ‘দি কালার্স অফ আর্ট’।

সাক্ষাতকারের শেষ লঙ্গে প্রশ্ন ছিল কবিতার থেকে কি চান কবি? তার উত্তরে জকি আহাদ যা বলেছিলেন সেটা তার বইয়ের শেষ কবিতা ‘শেষ ইচ্ছে’- এর শেষ চারটি লাইনের সঙ্গে ভীষণ ভাবে মিলে যায়। “শেষ ইচ্ছে বলে যাই আমি/ বিশ্ব দরবারের মাটিতে/ ঠাঁই যেন পাই যতটুকু চাই/ আমানটলার বাটিতে”।

যে অবস্থার মধ্যে কবির সাথে কথোপকথন হয়েছে। আমারা চাই দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন কবির পিতা জবান নুর-আল আহাদ। শুভেচ্ছা রইল উপ হাইকমিশনার এবং তার গোটা পরিবারের প্রতি। পাঠক হিসেবে আশা থাকল আগামী দিনে আরও নতুন কবিতা হাতে পাওয়ার।

বাংলাদেশ সময়: ০৭১৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ার ৩, ২০১৬
ভিএস/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।