ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

বাঙালির বিজয়া দশমীর একাল-সেকাল

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৬
বাঙালির বিজয়া দশমীর একাল-সেকাল ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কলকাতা: প্রতিমা বিসর্জন হওয়ার পর ইলিশ মাছ কেনা যাবে না। এই প্রথা পশ্চিমবঙ্গে চলে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে।

 

বর্তমানে সরকারিভাবে এই সময় ইলিশ মাছ না ধরার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেকালের গৃহকত্রীরা বিজয় দশমীর দিনই হেঁসেল থেকে ঘোষণা দিতেন ইলিশ মাছ আর খাওয়া যাবে না। বিজয়া দশমীর সেকাল আর একাল নিয়ে আলোচনা করতে গেলে উঠে আসে এমনই কিছু তথ্য যেখানে প্রথা, সংস্কার, বিজ্ঞান আর ঐতিহ্য মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
 
তিথি মতে দেবী দুর্গার বিসর্জন হলেই শুরু হয় বিজয়া দশমীর পালা। কিন্তু মহালয়ার পর থেকেই একটা সময়ে পরিবারের নারী সদস্যরা শুরুর করে দিতেন বিজয়া দশমীর প্রস্তুতি। গাছ থেকে নারকেল পাড়িয়ে ঘরে জমা করা, ঘষেমেজে সন্দেশের ছাঁচগুলিকে প্রস্তুত করে রাখা, মিষ্টির জন্য গুড়-চিনি এবং নিমকির জন্য ডালডার টিন মজুত রাখা, মশলার কৌটো গুলিকে সযত্নে পরিপূর্ণ করে রাখা আরও কত কি?

পূজোর শুরু হতে না হতেই চলে আসে বিজয়া দশমী। বিসর্জনের পরেই এখনও বাড়ির কর্তাদের লাইন পড়ে পাড়ার মিষ্টির দোকানে। অতীতে মুদির দোকানে লম্বা লাইনে লিস্টি হাতে গৃহকত্রীরা কখনও নিজেরাই হাজির হয়ে যেতেন। কলকাতার ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় বনেদি বাড়ির দুর্গা পূজার পর মিষ্টির ভিয়েনে তৈরি হোতো বিজয়ার মিষ্টি।

তবে বনেদি বাড়ির বাইরেও বিজয়া দশমী বাঙালির কাছে চিরকালই এক মিলন উৎসব বলে বিবেচিত হয়ে এসেছে। আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারগুলোও দুর্গা প্রতিমার বিসর্জনের পরে বাড়িতে ছোটরা এলে তাদের হাতে অন্তত কয়েকটি গুড়ের নাড়ু তুলে দিতেন। ময়রাদের ব্যস্ততা থাকতো চোখে পড়ার মতো। ঢাকের বোলে বিদায়ের ছন্দ বাজলেই ময়রাদের কড়ায় তৈরি হওয়া শুরু হতো জিবেগজা, রসবড়া, মনোহরা, মিহিদানা, সীতাভোগ।

তবে বিজয়া মানেই যে শুধু মিষ্টি তা নয়, কনকাঞ্জলিতে দেবীর বিদায়ের পরই ঘুগনির কড়াই বসতো চুলায় (ঘুগনি হল মটরের তৈরি ডাল)।   বাড়িতে আসা অতিথিদের মিষ্টির প্লেটের সঙ্গে থাকতো ঘুগনির বাটি। কোনও কোনও বাড়িতে ঘুগনিতে মেশানো হতো পাঁঠার মাংস।

আজকের বিজয়া দশমী বেশ কিছুটা বদলে গেছে। কলকাতার বনেদি বাড়িগুলোতে কোথাও কোথাও এখনও তৈরি হয় বিজয়ার মিষ্টি। কিন্তু বেশিভাগ বনেদি বাড়িতেই আজকাল বাজার থেকে কেনা মিষ্টির ব্যবহার হয় বেশি।

মধুমেহ রোগের (ডায়াবেটিস) সমস্যার কারণে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের বড় অংশের মানুষ মিষ্টি খাওয়া নিয়ে অনেকটাই সাবধানী। কবজি ডুবিয়ে খাওয়া তো দূরের কথা আঙুল দিয়ে একটি-দুটির বেশি মিষ্টি বেশি খাওয়ার অভ্যাস প্রায় চলে গেছে। অনেকে আবার মিষ্টি ছুঁইয়েই দেখেন না।

বাড়িতে ডালডার টিন বর্তমানে আসে না, তবে নানা ধরনের ভোজ্য তেল এখনও আসে। অনেক বাড়িতেই বিসর্জনের পরেই শুরু হয় ঘুগনি তৈরির তোরজোড়। তবে শহরের ছোট ছোট পরিবারগুলো এই রেওয়াজ থেকে অনেক দূরে। দশমীর পর তারা ঠাণ্ডা পানীয় আর কেনা মিষ্টিতেই কাজ সারেন। অনেকেই মিষ্টির বদলে পিজা কিংবা কেক, কুকিজেই বিজয়া সারেন।

তবে বিজয়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিক ভাবে জড়িত কুচো নিমকি। সারা বছর পাওয়া গেলেও বাড়িতে তৈরি কুচো নিমকি পছন্দ করেন না এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আজও বেশ কিছু বাড়িতে বিজয়ার পর নিমকি তৈরির প্রথা চালু আছে।
 
সমাজবিজ্ঞানে বলা হয় একটি জাতির সংস্কৃতির নিউক্লিয়াস তার ঘরোয়া সংস্কৃতি। বিজয়া দশমী সেই রকমই একটি ঘরোয়া সংস্কৃতি। যদিও সময়ের সঙ্গে তার বিবর্তন ঘটেছে প্রচুর। দশমীর চিঠির বদলে এখন এসএমএস-এ যায় প্রণাম, শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ। প্রবাসে পৌঁছায় ইমেল। এই ভাবেই অনেক বদলে গিয়েও বাঙালির সঙ্গে আজও জুড়ে আছে বিজয়া দশমী। এই প্রথা তার মাঙ্গলিক চরিত্র ছাড়িয়ে পরিণত হয়েছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এক ধর্ম নিরপেক্ষ উৎসবে। যে উৎসবের সঙ্গে লতায় পাতায় জড়িয়ে আছে ভারতীয় উপমহাদেশের দৃঢ় পারিবারিক বন্ধনের সংস্কৃতি। যেটি ছড়িয়ে পড়ছে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৮ ঘণ্টা, ১৪ অক্টোবর, ২০১৬
ভিএস/জিপি/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।