ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

গ্যালিফ স্ট্রিট: উপ-মহাদেশের পাখি চোরাচালানের অন্যতম কেন্দ্র

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৭ ঘণ্টা, জুন ৮, ২০১৬
গ্যালিফ স্ট্রিট: উপ-মহাদেশের পাখি চোরাচালানের অন্যতম কেন্দ্র

কলকাতাঃ মুম্বাইয়ের ‘ক্রাওফোর্ড মার্কেট’ হলো ভারতের সবচেয়ে বড় পশুপাখির বাজার। মনে করা হয়, এই বাজারের বড় অংশের লেনদেন হয় বেআইনি পশুপাখির কেনাবেচায়।

এই লেনদেনে স্বাভাবিক ভাবেই কোন সরকারি হিসেব না থাকলেও শোনা যায়, দিনে কয়েক কোটি রুপির কেনাবেচা নাকি এখানকার স্বাভাবিক হিসেব।

মধ্যপ্রাচ্য থেকে আনা বাজ পাখি, অ্যামাজনের জঙ্গল থেকে আনা কাকাতুয়া থেকে শুরু করে দেশি টিয়া, মুনিয়া সবই পাওয়া যায় মুম্বাইয়ের এই বাজারে। তবে শুধু পাখি নয়, খুঁজতে পারলে এই বাজারে এমন জন্তুও আপনি পাবেন যা আপনার কল্পনার সীমাকে চ্যালেঞ্জ করবে।

কলকাতার গ্যালিফ স্ট্রিটের পশুপাখির বাজার সম্পর্কেও একই জনশ্রুতি আছে। শুধু আশপাশের রাজ্য নয়, বিভিন্ন দেশ থেকেও এখানে আসে নানা ধরনের পশুপাখি। আর বিদেশি ক্রেতাদের জন্য নাকি তাদের দেশে জন্তু পৌঁছে দেবার বন্দোবস্ত আছে এই বাজারের কিছু লোকেরই হাতে। দিনের বিক্রির পরিমাণ মুম্বাইয়ের ‘ক্রাওফোর্ড মার্কেট’-এর মতো না হলেও বেশ বড়। খবর ছিল, এই বাজার থেকে প্রতি রোববার বড় মাপের পাখি পাচার হয় বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশে। আর এই ‘ডিল’ হয় গ্যালিফ স্ট্রিট থেকে হাতিবাগানের মধ্যে কোন এক বা একাধিক জায়গায়।

কলকাতার পশু-পাখির বাজারের এক পরিচিত মুখকে সঙ্গে নিয়ে বাংলানিউজ হাজির হয়েছিল এই বাজারে। উদ্দেশ্য শুধু পশুপাখির বন্দিদশার চিত্র তুলে ধরা নয়, মূল উদ্দেশ্য ছিল সেই চোরাচালান চক্রের হালহকিকত তুলে ধরা, যাদের মাধ্যমে সীমান্ত পার হয়ে এই নিরীহ প্রাণীগুলি তাদের খাঁচায় বন্দি জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়।

এক রোববার গ্যালিফ স্ট্রিটের বাজারে গিয়ে দেখা গেল, সকালবেলাতেই পশুপাখি কিনতে বেশ কিছু লোকজন জমা হয়েছে। চোখের সামনে রঙিন মাছ, দেশি-বিদেশি কুকুর থেকে শুরু করে নানা রকমের পশুপাখি। অবাক করার মতো জিনিস যেটা চোখে পড়ল, খাঁচায় যেমন পাখি আছে তেমনই ছোটছোট নাইলনের ব্যাগের মধ্যে পাঁচ ছয়টি পাখি একসঙ্গে হাতের মুঠোয় রেখে বিক্রি করছেন কয়েক জন বিক্রেতা। কিছুটা দূর থেকে দেখলে মনে হবে, যেন হাতে বল জাতীয় কিছু রাখা। কিছু মাত্র সন্দেহ হলেই এগুলি ঢুকে যাচ্ছে লুঙ্গির ভাঁজে বা হাতে ঝোলানো ব্যাগের ভেতর।

কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর আমার সঙ্গীর দেখিয়ে দেওয়া একটি লোকের কাছে গিয়ে আমার প্রস্তাবটি ফিসফিস করে বললাম। দুটি লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া চাই। শুনেই সে জানিয়ে দিল, এই ধরনের জিনিষ বাজারে পাওয়া যায় না। তবে বিশেষ একজনের নাম বলতে লোকটি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলল। তারপর সে জানাল, লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া পাওয়া যাবে, কিন্তু সেটি গ্যালিফ স্ট্রিটে পাওয়া যাবে না। যেতে হবে রাজাবাজার, সেখানে কথা বলতে হবে।

বাংলাদেশ থেকে এসেছি হাতে বেশি সময় নেই জানাতে সে কাউকে ফোন করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলো আর একটি লোক। নিজের নাম বলল মহিম। গ্যালিফ স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে সে নিয়ে গেল কিছুটা দূরে হাতিবাগান মোড়ের দিকে। তার দাবি, বাংলাদেশে সে আগেও পাখি পাঠিয়েছে। জানতে চাইলো পাখি কি আমি নিয়ে যাবো না পৌঁছে দিতে হবে।

ঢাকায় পৌঁছে দিতে হবে শুনে মনে হলো লোকটি যেন কিছুটা নিশ্চিন্ত হোল। সে জানাল কলকাতার রাজাবাজারে পাখি কারবারিদের একটি আস্তানা আছে। তবে ইদানিং পশ্চিমবঙ্গ বন দপ্তর খুব ধরপাকড় শুরু করায় ‘জিনিস’ দেখতে যেতে হবে হুগলী জেলার রবীন্দ্রনগরে। কিন্তু ফিরে যাওয়ার তাড়া আছে বলাতে সে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ল। তার মোবাইলে সে একের পর এক পাখির ছবি দেখাতে লাগলো। কোনটি তার হাতে, কোনটি অন্য কারো হাতে। ইতিমধ্যেই একাধিক জন এসে আড়চোখে দেখে গেছে। চোখের ইশারায় মহিম জানিয়েছে, সব ঠিক আছে।

এলাকার একটি চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে মহিম জানালো, ভারতীয় রুপীতে দুটির দাম পড়বে ১ লক্ষ্য ৫০ হাজার। ঢাকায় পৌঁছে দিতে হলে দিতে হবে ২ লক্ষ ২০ হাজার রুপি। তবে বয়স অনুযায়ী দামের কিছুটা পার্থক্য হতে পারে। সেক্ষেত্রে ৩ লাখ পর্যন্ত দাম উঠতে পারে। কথায় কথায় মহিম জানাল- টিয়া, ময়না কিংবা নীলকণ্ঠ সামান্য ব্যাপার। চাইলে সে মধ্য প্রাচ্যের চিল থেকে প্যাঁচা কিংবা লাল গলার সারস পাখিও এনে দিতে পারে। তবে অগ্রিম লাগবে।

তার কথার মধ্যে উঠে এলো নেপাল, আসাম হয়ে মূলত রেল এবং সড়ক পথে কলকাতায় আসে এই পাখিগুলি। বিভিন্ন জায়গায় পাখি শিকারিরা এই পাখিগুলিকে ধরে। মূলত তিন ভাবে পাখি ধরা হয়- প্রথমত গাছে ফাঁদ পেতে বা পাখির বাসা আছে এমন গাছে রাতে জাল বিছিয়ে, দুই ফসলের ক্ষেতে পোষা পাখি বসিয়ে ফাঁদ পেতে, আর তৃতীয়ত গাছের ডালে একধরনের আঠা লাগিয়ে। ছোট ছেলেদের নাকি বিভিন্ন এলাকায় কাজে লাগান হয়। তারা নজর রাখে এলাকার কোন গাছে কোন ধরনের পাখি বাসা করছে। তার পর তারাই পাখির বাসা থেকে বাচ্চা চুরি করে তুলে দেয় মহাজনদের হাতে।

পাখি ধরা পড়ার পর সেগুলিকে রেল পথে সড়ক পথে বিভিন্ন বাজারে পাঠানো হয়। ভারতে  অন্তত ২০টির বেশি বাজার আছে। যেখানে দেশিবিদেশি পাখি পাওয়া যায়। আর আছে কিছু বেআইনি ‘ব্রিডার’। যারা নিজেদের বাড়িতে বিভিন্ন পাখির ‘ব্রিড’ করিয়ে বিক্রি করেন। কলকাতাতেও এ ধরনের কয়েকজন আছে। বনদপ্তর অভিযান করে তাদের একাধিকের বাড়ি থেকে বেআইনি পাখি উদ্ধার করেছে।

কখনো ঝুড়িতে আবার কখনও বাক্সে পুরে ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুম্বাই, কলকাতা সহ বিভিন্ন বাজারে পাখি পাচার করা হয়। বিদেশে চোরাচালান হয় সীমান্ত পেরিয়ে।

পাচারের পদ্ধতিটি নৃশংস। অন্য কোন পণ্যের প্যাকেটে পাখিটিকে ঢুকিয়ে পাখির ঠোঁট ভালো করে বেঁধে পাঠান হয় দেশের বাইরে। পণ্যের প্যাকেটে যাওয়ায় অনেক সময় নজর এড়িয়ে যায়। অনেক সময় প্লাস্টিকের বোতলের তলাটি কেটে পাখিটিকে ঢুকিয়ে বোতলের তলাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধু বোতলের মুখটি খোলা থাকে। পাখি সেখান দিয়েই বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকে। নড়াচড়ার কোন জায়গা থাকে না। এই ভাবে পাঠানোর সময় মৃত্যু হয় ধরা পড়া ৬০ শতাংশ পাখির।

বিএসএফ শুধু ২০১৫ সালের প্রথম তিনমাসে চোরাচালান হতে চলা যতো পাখি উদ্ধার করে সেগুলোর বাজার মূল্য ৩৬ লক্ষ ৫০ হাজার রুপি। যে কোনো রোববার গ্যালিফ স্ট্রিটে গেলেই পাওয়া যাবে চন্দনা, ব্রাহ্মণী স্টার্লিং, মুনিয়া, টিয়াসহ কমবেশি সমস্ত নিষিদ্ধ পাখি।

তবে খুব দামি পাখি কিনতে গেলে আপনাকে কিছুটা চেনাশোনা থাকতে হবে। তবেই এরা মুখ খুলবে। ভারতীয় বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পাওয়া ১,২০০ এর বেশি প্রজাতির পাখির যে কোনও প্রজাতিকেই ধরা এবং খাঁচায় আটকে রাখা নিষিদ্ধ।

তবে পশু প্রেমিকদের মতে, সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়লে চোরা কারবারিদের রমরমা অবস্থা চলতে থাকবেই। তাদের বক্তব্য, মানুষকে বন্যপ্রাণী আর গৃহ পালিত প্রাণীর পার্থক্য বুঝতে হবে। পাখি সবসময়ই বন্যপ্রাণী, তাদের খাঁচায় বন্দি করে রাখা উচিৎ নয়। পশু প্রেমিকদের আশা প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে, বন্ধ হবে এই বেআইনি ব্যবসা।

বাংলাদেশ সময়: ১১১৬ ঘণ্টা, জুন ৩, ২০১৬
ভি.এস/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।