ঢাকা, শুক্রবার, ২৪ মাঘ ১৪৩১, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭ শাবান ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

আল্ট্রাসনোগ্রাফি যখন ‘উল্টাসনোগ্রাফি’

নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৫
আল্ট্রাসনোগ্রাফি যখন ‘উল্টাসনোগ্রাফি’ ...

চট্টগ্রাম: জামালখান এলাকার বেসরকারি ইনোভা হাসপাতালে রোগীদের আল্ট্রাসনোগ্রাম করান মেডিক্যাল আল্ট্রাসাউন্ডে ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী ডা. নিপা দাশ। দুপুর ও রাতে বেশ কয়েকজন রোগীকে অল্প সময়ের মধ্যে পরীক্ষা করে রিপোর্টও দিয়ে দেন।

 

বিপরীত চিত্র মেহেদিবাগ মেট্রো ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও এপিক হেলথ কেয়ারে। চট্টগ্রামে বেশ খ্যাতি পাওয়া ডা. দিদারুল আলমের কাছে পরীক্ষা করাতে আসা রোগীর ভিড় সেখানে চোখে পড়ে সবসময়।

রিপোর্ট পেতে অপেক্ষা করতে হয় একদিন। চিকিৎসকদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে আছেন তিনি।

চট্টগ্রাম শহরেই রোগ নির্ণয়ে আল্ট্রাসনোগ্রাম করেন পাঁচ শতাধিক চিকিৎসক। যারা এক বছর মেয়াদি অ্যাডভান্স ডিপ্লোমা ইন মেডিক্যাল আল্ট্রাসাউন্ড (এডিএমইউ), ডিপ্লোমা ইন মেডিক্যাল আল্ট্রাসাউন্ড (ডিএমইউ) এবং তিন মাস মেয়াদি সার্টিফিকেট ইন মেডিক্যাল আল্ট্রাসাউন্ড (সিএমইউ) কোর্স করার পদবি ব্যবহার করেন।

নগরে গড়ে ওঠা আল্ট্রাসাউন্ড একাডেমি, আইএমএমটি, ইনস্টিটিউট অফ আল্ট্রাসনোগ্রাফি ট্রেনিং, চট্টগ্রাম কমিউনিটি প্যারামেডিক ইনস্টিটিউট, ইকরামড একাডেমি সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বেশ কয়েক বছর ধরে এসব ডিগ্রি দিচ্ছে। এছাড়া ঢাকার অসংখ্য প্রতিষ্ঠান থেকেও টাকার বিনিময়ে নেওয়া যায় ডিগ্রি। তাদের দেওয়া ডিগ্রির মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। এডিএমইউ ডিগ্রি পেতে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ, ডিএমইউ’র জন্য ৭০ থেকে ৮০ হাজার, সিএমইউ’র জন্য ১২ থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচ করলে পাওয়া যায় সনদ। এরইমধ্যে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব থাইরয়েড অ্যান্ড ইমেজিং রিসার্চ (বিটমির) নামে ২০০৭ সাল থেকে আল্ট্রাসাউন্ড বিষয়ক ক্লিনিক্যাল সেবা ও শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে আসা একটি প্রতিষ্ঠানের সনদের মান নিয়ে সতর্ক করেছে বিএমডিসি-ইউজিসি।

চট্টগ্রাম বিভাগে ২৪০টি বেসরকারি হাসপাতাল ও রোগ নির্ণয়কেন্দ্র দীর্ঘদিন ধরে নিবন্ধিত না হয়েও চলছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভুল রিপোর্ট প্রদানের অভিযোগও রয়েছে। রোগ নির্ণয়ের মেশিন সময়মতো ক্যালিব্রেশন (কার্যকারিতা পরীক্ষা) ছাড়াই বছরের পর বছর ব্যবহার হচ্ছে। নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোতেও দক্ষ সনোগ্রাফারের অভাবে রোগীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে। ঘটনার পর সিভিল সার্জন কার্যালয় তদন্ত কমিটি করে দায় সারছে।

আল্ট্রাসনোগ্রাম করার সময় হাতে ট্রান্সডিউসার নিয়ে রোগীর পরীক্ষা করাকালে শরীরের অভ্যন্তরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ছবি দেখে রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থ হলে ভিডিও কলে অন্য কারও সহায়তা নিতে দেখা যায় কিছু সনোগ্রাফারকে। আছে রোগীর সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও। একজন রোগীর পরীক্ষায় কমপক্ষে ৩০ মিনিট সময় দেওয়ার কথা থাকলেও গড়ে দেওয়া হয় ১০-১৫ মিনিট। প্রতিষ্ঠানভেদে এই পরীক্ষার দামেও রয়েছে তারতম্য। একজন সনোগ্রাফার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে গিয়েও পরীক্ষা করেন।  

আনোয়ারার বটতলী ইউনিয়নের রুস্তমহাটে অবস্থিত এসএমএ পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সেই প্রতিষ্ঠানে সনোলজিস্ট ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস আল্ট্রাসনোগ্রাফি করিয়ে এক নারীর গর্ভে দুটি সন্তানের উপস্থিতির কথা রিপোর্টে উল্লেখ করেন। চিকিৎসকের পরামর্শে পুনরায় আল্ট্রাসনোগ্রাফি করলে একটি শিশুর তথ্য আসে। ওই নারী পরবর্তীতে এক সন্তানই জন্ম দেন।

নগরের চেকআপ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে স্ত্রীর আল্ট্রাসনোগ্রাফি করিয়ে ভয় পেয়েছিলেন সংবাদকর্মী বিপ্লব নাথ। তাঁর ভাষ্য, চিকিৎসক রিপোর্ট দেখে মন্তব্য করেন-‘সব আজগুবি তথ্য’। এরপর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল ক্যাম্পাসের ভেতর পরমাণু চিকিৎসা ও আল্ট্রাসাউন্ড কেন্দ্রে পরীক্ষা করে দেখা যায় দুই রিপোর্টের পার্থক্য।

শেভরন ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরিতে নীপা বড়ুয়া নামের এক রোগীকে দেওয়া রেডিওলজি ও ইমেজিং বিশেষজ্ঞ ডা. এবিএম কেফায়েত উল্লাহ ভূঁঈয়া স্বাক্ষরিত আল্ট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়- রোগী পুরুষ। বর্ণনা দেওয়া হয় পুংজনন তন্ত্রের সমস্যার। ওই রিপোর্ট দেখে অবাক হন চিকিৎসক ডা. আবদুল জলিল। তবে এ ঘটনাকে ‘কম্পিউটার অপারেটরের ভুল’ বলে দায় সারেন অভিযুক্ত। তিনি দাবি করেন, কম্পিউটার অপারেটররা পুরাতন রিপোর্ট থেকে টাইটেলগুলো কপি করে রিপোর্টের ক্যালকুলাস বসায়’।

একই প্রতিষ্ঠানে আল্ট্রাসনোগ্রাম করিয়েছিলেন প্রবাসী আনোয়ার হোসেন। রিপোর্টে তাঁর ডান কিডনিতে ৬ দশমিক ৪ এমএম সাইজের পাথুরে বস্তু রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। ওই রিপোর্ট দেখানোর পর চিকিৎসক পুনরায় আইভিইউ (ইন্ট্রাভেনাস ইউরোগ্রাম) করাতে বলেন। এপিক হেলথ কেয়ারে সেই পরীক্ষা করানোর পর রিপোর্ট আসে ভিন্ন, দুটি কিডনি ‘স্বাভাবিক’ উল্লেখ করা হয়।

পেটের ব্যথা নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করান আমান উল্লাহ নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। এরপর রিপোর্ট আসে- অ্যাপেন্ডিসাইটিস। চিকিৎসক অপারেশন করানোর পরামর্শ দেন। রোগী অন্য চিকিৎসকের পরামর্শে আবারও টেস্ট করান ইবনে সিনায়। রিপোর্টে অ্যাপেন্ডিসাইটিসের আলামত পাওয়া যায়নি, পাওয়া যায় পিত্তথলীতে পাথর।

মাতৃগর্ভে শিশুর অবস্থান ও তার সুস্থতা সম্পর্কিত তথ্য পেতে আল্ট্রাসনোগ্রাম সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই কাজ চলছে দায়সারাভাবে। ল্যাব ওয়ান হেলথ সার্ভিস নামের প্রতিষ্ঠানে অন্তঃসত্ত্বা এক নারীকে দেওয়া রিপোর্টে প্রফেসর ডা. এম এস আলম উল্লেখ করেন-‘প্লাসেন্টা প্রিভিয়া উইথ মাইল্ড প্লাসেন্টাল ইনসাফিসিয়েন্সি’। তবে বিস্তারিত উল্লেখ না থাকায় গাইনোকোলজিস্ট রিপোর্ট দেখে সন্তুষ্ট হননি।

নগরের ম্যাক্স হাসপাতালে এক প্রসূতির আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্টে গর্ভের শিশুর অবস্থা ‘স্বাভাবিক’ উল্লেখ করা হলেও অস্ত্রোপচার করার পর জানানো হয়- শিশুটি গর্ভেই মারা গেছে। এ ঘটনায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন আইনজীবী ইউসুফ আলম মাসুদ। মামলায় আসামিদের তালিকায় রাখা হয় আল্ট্রাসনোগ্রাফির চিকিৎসক ডা. এইচ এম রাকিবুল হককে।

সনোলজিস্টদের মতে, অতি উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করে শরীরের লিভার, হার্ট, কিডনিসহ প্রায় সব স্থানেই করা হয় আল্ট্রাসনোগ্রাম। কিছু কিছু বায়োপসি করতেও আল্ট্রাসনোগ্রাম ব্যবহার করা হয়। আল্ট্রাসনোগ্রাফি ব্যবহৃত হয় থেরাপিউটিক প্রসিডিউর ও ইন্টারভেনশন গাইডের ক্ষেত্রে। সঠিক রোগ নির্ণয়ের ওপর নির্ভর করে রোগীর চিকিৎসা। ফলাফল যদি ভুল হয়, তাহলে ভুল চিকিৎসা হবে।  

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের (চমেক) পোস্টগ্রাজুয়েট প্রশিক্ষণার্থী ডা. রাকিব আদনান চৌধুরী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামের মতো একটা বিভাগীয় শহরে আল্ট্রাসনোগ্রাফি, এফএনএসি, হিস্টোপ্যাথলজির মতো পার্সন বেইজড টেস্টগুলোর যে বেহাল দশা, সেটা নিয়ে হতাশ না হয়ে উপায় নেই।  যে ক’জন অল্প স্যার-ম্যাডামের ওপর ভরসা করা যায়, তারা এত বেশি ওভারবার্ডেন্ড, সেখানেও ভোগান্তি। অথচ গ্রামে ও শহরের অলি-গলিতে ল্যাব আর নামকাওয়াস্তে কনসালট্যান্টে ভর্তি! আল্ট্রার এতো বেহাল দশা যে, আমাদের এক স্যার এটার নাম দিয়েছেন ‘উল্টাসনোগ্রাফি’।

প্রত্যুত্তরে সাজিনাজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার ডা. সুদীপ্ত পাল লিখেছেন, প্রদীপ দত্ত স্যার এই ‘উল্টাসনোগ্রাফি’ শব্দের উদ্ভাবক। একই রকম মন্তব্য পেডিয়াট্রিক হেমাটো অনকোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. এ কে এম রেজাউল করিমের। তিনি বলেছেন, ‘সবচেয়ে করুণ অবস্থা আল্ট্রাসনোগ্রাফির’।

মৃণাল সাহা নামের আরেক চিকিৎসকের মতে, ‘আল্ট্রাসনোগ্রাফি এখন পয়েন্ট অব কেয়ার বেড সাইড টেস্ট। তাই এটার অ্যাফিকেসি প্রাইমারী কনসালটেন্টকেই এনসিউর করতে হবে’।

তবে আল্ট্রাসনোগ্রাফির এই বেহাল দশা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য দিতে রাজী নন সনোলজিস্টরা। তারা বলছেন, সবার যে অভিজ্ঞতায় ঘাটতি আছে-সেটা বলা যাবে না। চট্টগ্রামেও বেশ ক’জন সনোলজিস্ট আছেন, যাদের রিপোর্ট যথাযথ এবং এতে আস্থা রাখা যায়।

ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেস, চট্টগ্রাম (ইনমাস) সূত্রে জানা গেছে, রিয়েল টাইম গ্রে-স্কেল ও থ্রি-ডি কালার ডপলার আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনের সাহায্যে প্রাথমিক অবস্থাতেই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। এছাড়াও অন্যান্য জটিলতা নির্ণয়ে এর অবদান অনস্বীকার্য। টিউমার থেকে টিস্যু সংগ্রহ করে পরীক্ষার ক্ষেত্রে আল্ট্রাসাউন্ড গাইড করা হয়। আল্ট্রাসনোগ্রাফির সাহায্যে রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাধা বা অন্য কোনও কারণে রক্তনালীর সংকোচন, রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়া কিংবা রক্তনালীর অন্যান্য রোগ নির্ণয় করা যায়। এজন্য দরকার দক্ষ সনোলজিস্ট। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) কোড অব এথিকস অনুযায়ী, রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ছাড়া অন্য কেউ আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে পারবে না।  

রেডিওলজি ও ইমেজিং বিশেষজ্ঞ সহযোগী অধ্যাপক ডা. শহীদুল ইসলাম বলেন, আল্ট্রাসনোগ্রাম করার সময় ত্বকে জেলির মতো এক ধরনের তরল ব্যবহার করতে হয়। লিভার ও গলব্লাডার-সংক্রান্ত রোগ নির্ণয়ের কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে খালি পেটে থাকতে হয়। গর্ভাবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে, প্রস্রাবের থলিতে আটকে থাকা প্রস্রাবের পরিমাণ নির্ণয়ে বেশি করে পানি পান করার পরামর্শ দেওয়া হয়।  

তিনি বলেন, সাধারণত সনোগ্রাফি যিনি করেন তিনিও একজন চিকিৎসক। সনোগ্রাফি করে যথাযথ রোগ নির্ণয় করতে হলে অবশ্যই ডিগ্রিধারী অভিজ্ঞ সনোগ্রাফার দিয়ে করাতে হবে। তিনি প্রাথমিকভাবে ছবি ও সনোগ্রাফের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করেন, যা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে রোগটি যথাযথভাবে নির্ণয় করে চিকিৎসায় সহায়তা করে।

বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০২৫ 
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।