২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রধান দুটি রাজনৈতিক ধারার বাইরে তারুণ্যের শক্তিতে নির্ভর একটি নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করল বাংলাদেশে।
তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই দলের উত্থান ছিল যেমনি অনিবার্য, তেমনি স্বতঃস্ফূর্ত গণ-আকাক্সক্ষার প্রকাশ। প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাইরে একটি নতুন স্বপ্ন এবং নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে নতুন এই রাজনৈতিক দলে। ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি) কেবল একটি রাজনৈতিক দল নয়, বরং তারুণ্যের আকাক্সক্ষার স্ফুরণ। তরুণরা বাংলাদেশকে যেভাবে দেখতে চায়, সেই সেরকম একটি বাংলাদেশ বিনির্মাণের দায়িত্ব তারা নিজেদের কাঁধে তুলে নিল। এই দায়িত্ব তারা অন্য কারও ওপর দিয়ে নিরাপদ মনে করছে না। যে কারণে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘জুলাই বিপ্লব’ যেমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যেখানে মূলধারার রাজনৈতিক নেতৃত্বের বাইরে গিয়ে কিছু উদ্যমী অকুতোভয়, সাহসীপ্রাণ তরুণ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিল। শত শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশ অবশেষে মুক্ত হয়েছিল স্বৈরাচারের নিগঢ় থেকে, ঠিক সেভাবেই স্বৈরাচারের পতনের পর যখন তরুণরা দেখছে যে তাদের প্রত্যাশা এবং স্বপ্নগুলো আস্তে আস্তে ধূসর হয়ে যাচ্ছে, তারা যেরকম বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নিজেদের সঁপে দিয়েছিল, সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ ক্রমশ পথ হারাচ্ছে তখন তারা নিজেরাই দায়িত্ব তুলে নিল। এটি যতটা না রাজনৈতিক দল তার চেয়েও তারুণদের আকাক্সক্ষার প্ল্যাটফর্ম। এটি বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশের সবকিছু অর্জন তারুণ্যের হাত ধরে। আমাদের ভাষা আন্দোলন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সবশেষে জুলাই বিপ্লব সবকিছু অকুতোভয় তারুণ্যের দ্রোহের বিজয়। কিন্তু অদ্ভুত একটি ব্যাপার হলো, আশির দশক থেকে আমাদের তরুণরা ক্রমশ নিজেদের রাজনীতিবিমুখ করে ফেলেছিল। ষাট বা সত্তরের দশকে আমরা যেমন লক্ষ করেছি যেসব মেধাবী শিক্ষার্থী ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্ররাজনীতির চর্চাকেন্দ্র, ভবিষ্যৎ-রাজনীতিবিদ তৈরি হওয়ার সূতিকাগার, সেখানে আশির দশকে এসে অবস্থা পাল্টে যেতে শুরু করে। বিশেষ করে তরুণরা লেখাপড়া, ভালো চাকরি, ব্যবসা, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়া বা বিদেশে গিয়ে চাকরিবাকরি করে স্থিত হওয়া, এরকম একটি সংস্কৃতির মধ্যে ঢুকে পড়ে। আর এর ফলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় বাংলাদেশের। নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাইপলাইন বন্ধ হয়ে যায়। অযোগ্য, অথর্বরা রাজনীতিতে জড়ো হতে থাকে এবং তারাই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। ফলে রাজনীতি হয়ে পড়ে মেধাহীন, মেধাশূন্য, দুর্নীতি, চাটুকারদের আখড়া।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আশির দশকে জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে তরুণ মেধাবীদের নিয়ে আসার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে তিনি তরুণ মেধাবীদের একসঙ্গে জড়ো করেছিলেন। হিজবুল বাহারে তাদের বাংলাদেশ এবং আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য উদ্দীপ্ত করেছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর সেই ধারা ব্যাহত হয়। নতুন রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্ররাজনীতিতে শক্তি, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। ফলে ছাত্ররাজনীতি হয়ে ওঠে পেশিশক্তিনির্ভর। মেধাহীন এবং হল দখল, ক্যাম্পাস দখলের এক নোংরা খেলায় ছাত্রদের ব্যবহার করা হয় ছাত্ররাজনীতির নামে। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা এবং একধরনের ঘৃণা তৈরি হয়। এরকম অবস্থায় বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের হাতে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা ক্রমশ ক্ষীণ হতে হতে প্রায় বিলীন হয়ে যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন, চাটুকার, মোসাহেব এবং অযোগ্যদের প্রাধান্য বাড়তে থাকে। কিন্তু এই অবস্থার পরিবর্তন আমরা লক্ষ করি ২০১৪-এর পর থেকে। প্রথমে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের প্রকাশ প্রথম ঘটায়। হারিয়ে যাওয়া তারুণ্যের একঝলক দ্রোহ আমরা প্রত্যক্ষ করি। নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য তারা রাজপথে নামে এবং প্রথম কোটা আন্দোলন বাংলাদেশে ছাত্রদের শক্তি এবং তারুণ্যের দ্রোহকে নতুনভাবে প্রস্ফুটিত করে। এরপর থেকে আস্তে আস্তে তরুণরা তাদের অধিকার আদায় এবং অব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামের পাদপ্রদীপে আসতে থাকে। ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’-এর মাধ্যমে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিকারের চেতনা নতুন করে সঞ্চালিত হয়। এটিও আমাদের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের আরেকটি নতুন মাইলফলক, যেখানে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের দাবি আদায় করেছিল। আর এভাবেই আস্তে আস্তে তরুণদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ে। তারা নতুন চিন্তাভাবনা শুরু করে এবং তাদের মধ্যে এক নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার দর্শন লক্ষ করা যায়। এই দর্শনটি আসলে জুলাই বিপ্লবের মূল প্রেরণা।
অনেকেই মনে করতে পারেন যে জুলাই বিপ্লব কেবল একটি ক্ষণিকের আবেগ। কোটা সংস্কারের দাবি মেনে না নিয়ে সরকারের একগুঁয়েমির ফলে ছাত্রদের যে সংগ্রাম, সে সংগ্রামের একটি অনিবার্য পরিণতি। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে ২০২৪-এর কোটা আন্দোলন কেবল কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ছিল না। বরং একটি বৈষম্যমুক্ত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের আকাক্সক্ষা থেকেই তরুণরা সংঘবদ্ধ হয়েছিল এবং এই সংঘবদ্ধ শক্তি এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল, যে বাংলাদেশে বৈষম্য থাকবে না, পরিবারতন্ত্র থাকবে না, দুর্নীতি থাকবে না। যোগ্যতা এবং মেধার প্রকৃত মর্যাদা হবে। এরকম একটি বাংলাদেশ বিনির্মাণের আকাক্সক্ষা থেকেই তরুণদের আন্দোলন শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচারের পতন ঘটায়। কিন্তু স্বৈরাচারের পতনের পর আমরা লক্ষ করি যে সেই স্বপ্নগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সেই পুরোনো আমলাতান্ত্রিক ধারা, সেই পুরোনো ব্যবস্থাপনাতেই একটি রাষ্ট্র এগিয়ে চলছে। ফলে সর্বত্র থাকা ফ্যাসিবাদের নানা রকম সুবিধাভোগীরা বাংলাদেশের তরুণদের স্বপ্নকে প্রায় ছিনতাই করতে যাচ্ছিল। এরকম পরিস্থিতিতে তরুণরা আবার নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করে। তারা অনুধাবন করে যে একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা যদি প্রতিষ্ঠা করতে না পারে, তাহলে পরে তাদের যে আকাক্সক্ষা সেই আকাক্সক্ষা কখনোই বাস্তবায়িত হবে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সনাতন পদ্ধতির বদলে একটি নতুন বিপ্লবের ডাক দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। এই নাগরিক পার্টি সাফল্য অর্জন করতে পারবে কি পারবে না, সেটি ভবিষ্যৎই বলে দেবে। কিন্তু তরুণরা যে রাষ্ট্র বিনির্মাণে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত তার একটি বার্তা এই রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে সুস্পষ্ট হলো।
বিশ্বজুড়ে নেতৃত্বের একটি সংকট চলছে। তরুণ নেতৃত্ব সামনে এগিয়ে আসতে পারছে না। বাংলাদেশের তরুণরা জাতীয় নাগরিক পার্টি গঠনের মাধ্যমে গোটা বিশ্বকেই যেন জানান দিল। তরুণদের শক্তি এবং তরুণদের আকাক্সক্ষা পূরণে বৈশ্বিক লড়াইয়ে বাংলাদেশ যেন পথ দেখাচ্ছে এখন। বাংলাদেশ যেন নেতৃত্বের আসনে।
আমরা জানি যে একটি রাজনৈতিক দল গঠন, তাকে বিকশিত করা, সারা দেশে সেই রাজনৈতিক দলকে ছড়িয়েছিটিয়ে দেওয়া অত্যন্ত কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ একটি কাজ। বিশেষ করে এখন রাজনীতিতে যেভাবে কালোটাকা এবং পেশিশক্তি প্রবেশ করেছে, সেখানে একটি সুস্থ ভাবনার রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ এবং বিকাশ খুবই কঠিন ব্যাপার। কিন্তু আমরা আশাবাদী হতে চাই। কারণ তরুণরা নতুন করে ভাবছে এবং আগামী বাংলাদেশ তাদেরই। এই বাংলাদেশকে তাদেরই নেতৃত্ব নিতে হবে। কাজেই তাদের সামনে অনেক পথ। সবচেয়ে বড় কথা হলো তরুণরা জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছে তারা পারে। এ কারণে ২৮ ফেব্রুয়ারি মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে দেখা গেল জনস্রোত। জনগণ তাদের ওপর আস্থা রেখেছে প্রথম দফাতেই। জনগণ পরিবর্তন চায়। জনগণ এই আশাহীন, স্বপ্নহীন দেশকে এক জাগরণের বাংলাদেশ হিসেবে দেখতে চায়। আর এ কারণেই তরুণদের ওপর তাদের আস্থা আছে তার প্রমাণ হলো ২৮ ফেব্রুয়ারি। কারণ তরুণরা এরই মধ্যে তাদের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। ১৫ বছর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা যে স্বৈরাচারকে কেউ হটাতে পারেনি, তাকে সরিয়ে তরুণরা দেখিয়ে দিয়েছে যে তাদের ঐক্যের শক্তি কত ব্যাপক বিস্তৃত। আর এ কারণেই জনগণ আশা নিয়ে বুক বেঁধে আছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ মানুষকে আশান্বিত করেছে। চারদিকে যখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সবদিকে যখন ব্যর্থতা, হতাশা ঠিক সে সময় এই রাজনৈতিক দল মানুষের জন্য নতুন প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করবে বলে জনগণ আশায় বুক বেঁধে আছে।
তবে মনে রাখতে হবে চটজলদি রাজনীতিতে কিছু অর্জিত হয় না। আত্মপ্রকাশের পর তাদের সমালোচনা হবে। তাদের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হবে। অনেকে তাদের কর্মসূচি, নীতি এবং বক্তব্যের সমালোচনা করবে। এই সমালোচনা সহ্য করার সক্ষমতা থাকতে হবে। দলের কাজকর্মে থাকতে হবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। মানুষ যেন বিশ্বাস করে তারা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতো না। জাতীয় নাগরিক পার্টির কথা ও কাজে মিল আছে। এসব যদি করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সত্যিকারের গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবে এনসিপি। আর তাহলেই তাদের নতুন ভাবনাচিন্তা কেবল তাদেরই জনপ্রিয় করবে না, অন্য রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পুরোনো চিন্তাভাবনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হবে। নতুন ধরনের একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কায়েম হবে আস্তে আস্তে। জাতীয় নাগরিক পার্টি ক্ষমতায় আসবে কি না, সেটি জনগণ নির্ধারণ করবে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান যে গতিধারা, তা যে তারা বদলে দেবে, এটা হলফ করেই বলা যায়।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৮ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০২৫
এসআই