ঢাকা, রবিবার, ৯ চৈত্র ১৪৩১, ২৩ মার্চ ২০২৫, ২২ রমজান ১৪৪৬

মুক্তমত

ড. ইউনূস এই চ্যালেঞ্জে না জিতলে দেশে ‘গৃহযুদ্ধ’ হবে 

লুৎফর রহমান হিমেল  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০২৫
ড. ইউনূস এই চ্যালেঞ্জে না জিতলে দেশে ‘গৃহযুদ্ধ’ হবে 

ঢাকা: বাংলাদেশের ক্রান্তিকালে দেশবাসীর ভাগ্যের হাল ধরেছেন আমাদের বিশ্বমুখ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদের দিকেই এখন চেয়ে আছে গোটা দেশের মানুষ।

তার কাঁধে যে পুরো দেশের ৫৬ হাজার ৯৭৭ বর্গমাইলের ভার। তার ভুল করা চলবে না। কোনোভাবেই না। খুব সতর্কতার সঙ্গে তাকে দেশ পরিচালনা করতে হবে।  

পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গেছে, একজন রাষ্ট্রপ্রধানের একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে গোটা রাষ্ট্রের জনগণকে কী ভয়ংকর পরিণতিই না ভোগ করতে হয়। তাই ড. ইউনূসকেও কোনো ভুল করা চলবে না। অতীব প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার করে দেশে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। এটিই এ মুহূর্তের লক্ষ্য। কিন্তু এই নির্বাচন আয়োজন করতে হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে শর্তটি তা হলো, দেশের দীর্ঘদিনে জমে থাকা অনিয়ম-বৈষম্যের জঞ্জাল পরিষ্কার করা। এ জন্য রাষ্ট্র মেরামতের কাজ করতে হবে। ছাত্র-জনতা এই রাষ্ট্র মেরামতের নাম দিয়েছে সংস্কার।

ড. ইউনূস এই চ্যালেঞ্জ জয় করতে পারবেন। এরই মধ্যে সেই ইঙ্গিতও মিলেছে। সাত মাসে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দৃশ্যমান বেশ কিছু কাজ করেছে। এসব কাজ জনগণকে আশা দেখাচ্ছে। ওদিকে সংস্কারের জন্য তিনি গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি খাতে কমিশন গঠন করে দিয়েছেন। এগুলো হলো নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এবং সংবিধান সংস্কার কমিশন।

এসব কমিশন যে সুপারিশ করেছে, সেগুলো বাস্তবায়ন এখন জরুরি। এগুলো বাস্তবায়ন না করে নির্বাচনের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে এগিয়ে গেলে জাতির জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। দেশে গৃহযুদ্ধও বেঁধে যেতে পারে! দেশ এখন শূন্যরেখায় যুগ-সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এই শূন্যরেখা থেকে দেশ হয় ভালো নাহয় খারাপের দিকে যাত্রা করবে। যদি সংস্কারের মাধ্যমে নতুন এক বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে এই শূন্যরেখা থেকে দেশ যাত্রা শুরু করে, সেটি হবে সমৃদ্ধির পথে যাত্রা। অপরদিকে সংস্কার ছাড়া ভোটের আয়োজন করলে দেশ আগের চেয়েও আরও খারাপ পরিস্থিতিতে পড়বে। গৃহযুদ্ধও বেঁধে যেতে পারে। কারণ আমরা দেখেছি, অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো  সংস্কার না করে দেশে ভোট আয়োজন করেছে। এতে করে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসেনি; বিচার বিভাগ, প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানে ইতিবাচক সংস্কার তো হয়ইনি, বরং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল এবং চতুর্থ মেয়াদেও থাকার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়ে।  

ওয়ান ইলেভেনের সময় নানাবিধ সংস্কারের যে কথা শোনা গিয়েছিল, সেই সরকার বিদায় নেওয়ার পর এমন সব ঘটনা দেশের রাজনীতিতে ঘটতে থাকল, যা দেশকে আরও পিছিয়ে দিয়েছে। আমরা দেখেছি, একজন প্রধানমন্ত্রী একহাতে পাঁচ-ছয়টি নির্বাহী ক্ষমতা হাতে নিয়ে কীভাবে ধরাকে সরাজ্ঞান করেছেন। রাবন হয়ে উঠেছেন। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গুম, খুন এমনকি ব্যাংক লুটের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এমনটা আর হতে দেওয়া যাবে না। দেশকে আর ধ্বংসের হাতে পড়তে দেওয়া যাবে না। ছাত্র-জনতার শতসহস্র আত্মবলিদান বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না। সংস্কার হতেই হবে। এটি অন্তর্বর্তী সরকারেরই কাজ, নির্বাচিত সরকারগুলো অতীতে কথা রাখেনি। তাই তাদের ওপর নতুন করে বিশ্বাস স্থাপন করা কঠিন।  

সংস্কার নিয়ে বহু কথা হচ্ছে। সংস্কার হলো একটি মুমূর্ষু দেশের জন্য এন্টিবায়োটিকের মতো। পুরো ডোজ না দিলে শরীর যেমন আগের চেয়েও খারাপ অবস্থায় পড়ে, তেমনি সংস্কার পুরোপুরি না করে ছেড়ে দিলে দেশের পুরো সিস্টেম আরও বিগড়ে যাবে। আর ডোজ কমপ্লিট করা গেলে দেশ আবার উঠে দাঁড়াবে। দেশকে সারিয়ে তুলতে তাই সংস্কারের বিকল্প নাই। এই সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দিতেই হবে।  

মৌলিক বিষয়গুলোতে সংস্কারের জন্য সকল রাজনৈতিক দলকে ঐকমত্য রাখতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, দেশ ও জনগণের জন্যই তারা রাজনীতি করেন। দেশ ও জনগণ ভালো না থাকলে তারা রাজনীতি করবেন কাকে নিয়ে, কার জন্য, কার স্বার্থে? 
   
এটি দিনের মতো পরিষ্কার যে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে সংস্কার করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রধান প্রধান খাতগুলোর সংস্কার করতে কমপক্ষে তিন বছর সময় প্রয়োজন পড়বে। যদিও প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে তিনি নির্বাচন আয়োজন করবেন। সেটি কীভাবে সম্ভব, তিনি জনগণের কাছে এখনই পরিষ্কার করে দেবেন যাতে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়।  
 
দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দারুণভাবেই দেশ পরিচালনা করে চলেছেন। গত ৫৪ বছরে যেরকম দৃশ্য দেখা যায়নি সেরকম দৃশ্যও দেখা যাচ্ছে এখন! এবারের রোজার মাসের কথাই ধরা যাক। রোজা এলেই দ্রব্যমূল্য লাগাম ছাড়া হয় এই দেশে। খবরের কাগজে ভর্তি থাকে দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির সংবাদে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে পণ্যমূল্য এবার স্থিতিশীল। ২০০ টাকার পেঁয়াজ জনগণ কিনছে ৩৫ টাকায়, ৪০০ টাকার কাঁচামরিচ এখন ৫০ টাকা, ১০০ টাকার সবজি এখন কেনা যাচ্ছে ৩০-৪০ টাকা দিয়ে। ওদিকে বিদেশ থেকে রেমিটেন্স আসছে আশা জাগানিয়া অংকের। রিজার্ভও বাড়ছে। শুধু তাই নয়, লুট হওয়া ব্যাংকগুলোকে বন্ধ না করে ধীরে ধীরে বাঁচিয়ে তুলেছেন তিনি! 

সব মিলিয়ে তিনি দারুণ কিছু পদক্ষেপ নিয়ে জনগণের বুকে আশার সঞ্চার করেছেন। তিনি যে সফলভাবে দেশ পরিচালনা করে চলেছেন তার প্রমাণ মেলে সামাজিক মাধ্যমে লাখো মানুষের সমর্থনসূচক নানা মন্তব্যের মধ্য দিয়ে। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে যে যা খুশি এখন লিখছে, মন্তব্য করছে। কোনো ডিজিটাল আইন নেই। নেই কোনো বাধা।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বারবার বলেছেন, তিনি ক্ষমতায় থাকতে আসেননি। ছাত্রদের অনুরোধে তিনি দেশের ভার কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তিনি সুন্দর ও সফল একটি নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেবেন। এই নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে দেশের খোলনলচে ঠিকঠাক করতে হবে। দেশ মেরামত না করলে দেশে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা যাবে না। ড. ইউনূস দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, বিশেষ কয়েকটি খাতে সংস্কারের পরই এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন, নিরাপত্তা সংস্থা ও গণমাধ্যমসহ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে সংস্কারের পর তিনি নির্বাচন আয়োজন করবেন।

ড. ইউনূসের এই মতের সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেছে দেশের সব রাজনৈতিক দল। তবে দুই-একটি দল ভোট আয়োজনে দেরি করতে নারাজ। তাদের দাবি সংস্কার করা অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়। এই সংস্কার করবে নির্বাচিত সরকার। তাদের শীর্ষ নেতারা নানা সভা-সেমিনারে বলে চলেছেন, দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে।  

এ অবস্থায় ড. ইউনূস দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে ছুড়ে দিয়েছেন অন্যরকম একটি চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেছেন, সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত তিনি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন। তিনি এই মতামত জনসাধারণকে জানানোর জন্য ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করবেন।  

ড. ইউনূস বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তাবিত বিভিন্ন সংস্কারের বিষয়ে একমত হতে পারে, কিছুটা সংশোধন সাপেক্ষে একমত হতে পারে অথবা তারা একমত না-ও হতে পারে। কিছু সংস্কার এ মুহূর্তে না-ও চাইতে পারে। তবে, সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে সবার একমত হওয়া জরুরি। একমত হলে কীভাবে বাস্তবায়ন হবে সে উপায়ও বেরিয়ে আসবে। একমত না হলে আমাদের মুক্তি নেই।  

ড. ইউনূস বলেছেন, আমরা সংস্কার বিষয়ে আলোচনা করছি। এজন্য করছি যে এটা থেকে জাতি হিসেবে সরে যাওয়ার উপায় আমাদের নেই। যদি বলি যে সংস্কারের প্রয়োজন নেই, লোকে হাসবে। এতদিন কি করলেন তাহলে, বলবে যে এতদিন কি বললেন তাহলে, এটা ভুল, ওটা ভুল। এখন বলে যে সংস্কারের কাজ নেই। সেটা আমরা কেউ বলছি না। সংস্কার প্রয়োজন। খুব গভীরভাবে প্রয়োজন, হালকাভাবে না।  

জুলাই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল বৈষম্যের মূল উৎপাটন। আর সমাজ-রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা এই বৈষম্যের ক্যান্সার সারাতে হলে লাগবে সংস্কারের দাওয়াই। শুধু একটি ভোট আয়োজনই যে এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল না, সেটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা বারবার বলে দিয়েছেন। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্যের ছড়াছড়ি। মেধাবীরা দিনের পর দিন হচ্ছিল বঞ্চিত। অন্যদিকে সুবিধাবাদী মেধাহীনরা বসেছিল সমাজ-রাষ্ট্রের শীর্ষ বহু পদে। এসব সমস্যার সমাধান দু-চার মাসে করা সম্ভব না। অন্তত রাষ্ট্র মেরামত শুরু করতেও বছর তিনেক সময় লাগবে। এরপর নির্বাচিত সরকারগুলো এই সংস্কারকাজ এগিয়ে নিয়ে যাবে। মোট কথা, দেশের আমূল সংস্কার ছাড়া কোনোভাবেই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হবে না।  

দেশবাসী এখন ড. ইউনূসের চ্যালেঞ্জ জয়ের প্রত্যাশাতেই দিন গুনছেন। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বিজয় তারই হবে।  কারণ ড. ইউনূসের বিজয় মানেই ছাত্র-জনতার বিজয়, দেশের বিজয়।

লেখক: সম্পাদক, বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০২৫ 
এসআইএস  

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।