জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি, ইংরেজিতে ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি, সংক্ষেপে এনসিপির যাত্রা শুরুতেই নানামুখী বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই বিতর্কের অন্যতম বিষয় ওদের স্লোগান ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শেরে বাংলা নগরে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের প্রশস্ত সড়কে অনুষ্ঠিত লক্ষাধিক মানুষের এক সমাবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে এই দল গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এই দল গঠনের ঘোষণা দিয়ে মঞ্চের বক্তারা যখন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেন, তখন সামনের লখো ছাত্র জনতা মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে বজ্রকণ্ঠে স্লোগান ধরেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। এ থেকে স্পষ্ট যে, দলটি তাদের স্লোগান হিসেবে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বেছে নিয়েছে। অবশ্য খাতা-কলমে এ নিয়ে এখনো কিছু লেখা হয়নি। তবে এটা যে দলটি তাদের দলীয় স্লোগান নির্ধারণ করেছে তা একরকম নিশ্চিত। কারণ এ বিষয়ে দলের অন্যতম এক নেতা ও এক নেত্রী সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, তারা এই স্লোগানকে ওন করবেন।
২৮ ফেব্রুয়ারির সমাবেশের এই স্লোগানের পরপরই বিএনপির অন্যতম দুই শীর্ষ নেতা এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ইনকিলাব! এটা আবার কি? আমরা জানি, আমাদের দেশে ইনকিলাব নামের একটা পত্রিকা আছে। রীতিমতো তুচ্ছ্য তাচ্ছিল্য করেন। এমন কি এ নিয়ে তারা কটাক্ষ করতেও ছাড়েননি। এ বিষয়ে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী এক তরুণ বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় যারা এসি রুমে ঘরের ঠান্ডা বাড়িয়ে দামি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে বসে দিন কাটিয়েছেন, তাদের তো এই স্লোগান শোনার কথা নয়। এই স্লোগান শোনার কথা নয়, যে বা যারা ভারতের স্বাস্থ্য নগরীর হিল টপে বিলাসী জীবনযাপন করেছেন। হিল টপ, ওই পর্যন্ত এই আওয়াজ যাওয়ার কথা নয়।
বিএনপির দুই নেতার সমালোচনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই নিয়ে অনেকে অনেক মন্তব্য করেন। অনেকে এই স্লোগানের মধ্যে নবগঠিত দলের সঙ্গে পাকিস্তানের মুসলিম লীগের যোগসূত্রের সন্ধানও করেন। এটা যে কেউ করতেই পারেন। এটা তার স্বাধীনতা। তাই বলে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। কারণ তাতে বিভ্রান্তি বাড়বে বৈ কমবে না।
প্রথমে আসা যাক পাকিস্তানের যোগসূত্র নিয়ে। অতীত স্বৈরাচার গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ ও তার দোসরা কথায় কথায় যে কাউকে জামায়াত-শিবির, বিএনপি-জামায়াত, রাজাকার বলেছে যুগের পর যুগ। সাথে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, স্বাধীনতা বিরোধী বলে বর্ণনা করেছে। সেই ধারাবাহিকতায় তারা ছাত্রদের ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানকে বিদেশি, পাকিস্তানি স্লোগান হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। ওরা বলেছে, এটা পাকিস্তানি উর্দু শব্দ। অথচ এই মুর্খের দল জানে না যে, এটা পাকিস্তানি নয়, ওদের প্রভুদেশ ভারতের হিন্দুস্তানি শব্দ। হিন্দুস্তানে, ভারতে ব্যাপক জনপ্রিয় স্লোগান। আদতে এটা হিন্দুস্থানিও নয়, ইনকিলাব আরবি শব্দ। যার অর্থ বিপ্লব। জিন্দাবাদ ফারসি শব্দ। যার অর্থ দীর্ঘজীবী হোক।
সুলতানি আমলের চারশ ও সাড়ে চারশ বছরের মুঘল শাসন, তারপর কোম্পানি ও ব্রিটিশ শাসনের একশ বছর এদেশের (বাংলাদেশসহ পুরো ভারতবর্ষে) অফিসিয়াল ভাষা ছিল ফার্সি। আর মাদ্রাসায় পড়ানো হতো আরবি। তাই স্বাভাবিকভাবেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষা অসংখ্য আরবি ফার্সি শব্দ ঢুকেছে। তার সংমিশ্রণে উর্দুর জন্ম হয়েছে, জন্ম হয়েছে হিন্দির। আর তাইতো ভারতবর্ষে ইনকিলাব বা জিন্দাবাদ হিন্দুস্তান শব্দ হিসেবে পরিচিত। পাকিস্তানি শব্দ হিসাবে নয়। কারণ তখনো পাকিস্তানের জন্মই হয়নি। ভারতের এ দেশীয় দোসররা এটা না জেনেই ইনকিলাব জিন্দাবাদকে পাকিস্তানি বানিয়ে নবগঠিত দলের স্লোগানকে পাকিস্তান থেকে আমদানিকৃত বলে মিথ্যাচার ও অপপ্রচার করছে। অথচ আওয়ামী লীগের মুর্খরা একবারও ভেবে দেখছে না যে, তাদের দলের নাম আওয়ামী পুরাপুরি উর্দু শব্দ। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার শব্দ। আর লীগ ইংরেজি শব্দ যা ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তির দাসত্বের প্রতীক। সে দিক দিয়ে এনসিপির স্লোগানে এদেশে মুসলিম শাসনের অতীত ঐতিহ্যকে ধারণ করেছে, যা মুঘলদের প্রভাবে অর্থাৎ মুসলিম শাসকদের সময় হিন্দুস্তানি শব্দে পরিণত হয়েছে। তারপরও কথা হচ্ছে ইনকিলাব ও জিন্দাবাদ বাংলা ভাষায় প্রত্যয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর ব্যাপ্তি ও আদর্শ যা রাষ্ট্রের দীর্ঘজীবতা কামনা করা। ব্যবহারিকভাবে এটা প্রচলিত রাজনৈতিক শব্দ।
এবার আসা যাক এই স্লোগানের জন্ম কথা, ব্যবহার ও মাহাত্ম্য বিষয়ে। ১৯২১ সালে এক মুসলিম পণ্ডিত মাওলানা হাসরাত সোহানি এই স্লোগানের জন্ম দেন। যার প্রকৃত নাম ছিল সৈয়দ ফজল উল হাসান। তিনি ছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের একজন বিশিষ্ট নেতা ও প্রখ্যাত কবি এবং ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তার আবিষ্কৃত এই স্লোগানে ব্রিটিশ শাসকদের ঘুম উড়ে যায়। আর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তরুণ যুবক রক্তে আগুন লাগে। তাইতো ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান শিখ, জৈন কংগ্রেস ও কংগ্রেসসহ সব স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্লোগান ছিল ইনকিলাব জিন্দাবাদ। এই স্লোগান দিয়েই ভগবত সিং ও বিকে দত্ত দিল্লি পার্লামেন্টে অধিবেশনে বোমা ছুড়ে ইংরেজদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেন। আজও ভারতবর্ষের কমিউনিস্টরা এই স্লোগান দেন। সম্ভবত এক শ্রেণির মানুষের সমালোচনার এটাও একটা কারণ। এরা বিষয়টি স্পষ্ট না করলেও কার্যত এদের প্রশ্ন, এটা তো কমিউনিস্টদের স্লোগান।
এমন প্রশ্ন যদি কেউ করে, তা তারা করতেই পারেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে কিছু আইকনিক শব্দ অথবা অভিব্যক্তি আছে যা অমর হয়ে যায় এবং চিরকাল আমাদের সঙ্গে রয়ে যায়। ইনকিলাব জিন্দাবাদ হলো সেই রকম একটি শব্দ। তাই এটা স্পষ্ট করে বলা যায়, ইনকিলাব জিন্দাবাদ বিপ্লবীদের জন্য নিছক একটি আবেগময় রণহুঙ্কার নয়। বরং এর মধ্যে উচ্চ আদর্শ নিহিত রয়েছে। এটাকে অনেকে এভাবেও ব্যাখ্যা করেছেন যে, বিপ্লব পুঁজিবাদ ও শ্রেণিবৈষম্য ও সুযোগ সুবিধার মৃত্যু ঘণ্টা বাজিয়ে দেবে। বিপ্লব এক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দেবে। জন্ম দেবে একটি নতুন সামাজিক ব্যবস্থা। সেই লক্ষ্যেই বাংলাদেশের তরুণ ছাত্র যুবকরা জুলাই বিপ্লবের ঝাঁপিয়ে পড়ে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়ে। বাড়িতে বসে হঠাৎ করে কোনো এক সন্ধ্যায় প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে তরুণ ছাত্রদের মাথা ও মনে এই স্লোগান আসেনি। রাজপথে লড়াকু তরুণ ছাত্র যুবকের মধ্যেই এই স্লোগান এসেছে। এই স্লোগান উচ্চারিত হয়েছে লড়াইয়ের ময়দানে লড়াইয়ের মাধ্যমে। পুলিশের লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস আর সাউন্ড গ্রেনেডের মুখোমুখি হয়ে। আর এইতো ২৪-এর ছাত্র জনতার বিপ্লবের সময় ব্যাপক জনপ্রিয় হয় ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান। গ্রাফিতিতে উঠে এসেছে সেই স্লোগান। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের দেয়ালে আজও জ্বলজ্বল করছে ইনকিলাব জিন্দাবাদ আঁকা গ্রাফিতি। এখানে বলে রাখা ভালো, ২৪-এর জুলাইয়ের ছাত্ররা এই প্রথম এই স্লোগান দেননি। ছাত্ররা এই স্লোগান প্রথম দেন ২০১৮ তে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবিতে। তারপর ওই বছরে কোটাবিরোধী আন্দোলনে। সর্বশেষ ২৪-এর জুলাই বিপ্লবে। এই বিষয়ে জুলাই বিপ্লবের অন্যতম রূপকার ফ্রান্স প্রবাসী পিনাকী ভট্টাচার্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি তার প্রতিটি ভিডিও কনটেন্ট শেষ করেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে। ২০১৮ তে স্কুল ও কলেজের তরুণ ও কিশোর কিশোরীরা এই স্লোগানে আকৃষ্ট ও উজ্জীবিত হয়। উজ্জীবিত হয় জুলাই বিপ্লবেও।
সেই জুলাই বিপ্লব, জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রদের দল তাদের স্লোগান হিসেবে ইনকিলাব জিন্দাবাদ বেছে নেবে এটাই তো স্বাভাবিক। এরা তো আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ, বিএনপি, জাপা, জামায়াতের মতো ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বিলাসবহুল ডাইনিং রুমে বসে রাজনৈতিক দল গঠন করেনি। এরা দল গঠন করেছে মাঠের আন্দোলনে লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। নতুন স্বপ্ন নিয়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অঙ্গীকার নিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়বে। সেই নতুন বাংলাদেশ গড়তে নতুন বন্দোবস্ত করতে গণঅভ্যুত্থান যে যথেষ্ট নয়, এর জন্য বিপ্লব দরকার, সেই নির্মম সত্য লড়াকু ছাত্রদের দল কিছুটা হলেও উপলব্ধি করেছে। তাই তারা সঠিকভাবে স্লোগান নির্ধারণ বা নির্বাচন করেছে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’- বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। এতে সমালোচনা থাকবেই। অতীতেও সমালোচনা হয়েছে।
১৯২৯ সালে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানের সমালোচনা করে মর্ডান রিভিউ অব কলকাতায় একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ওই নিবন্ধ প্রকাশিত হয় যখন ভবগত সিং ও বি কে দত্ত দিল্লির সংসদ অধিবেশনে বোমা মেরে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান দেন তখন। আর এখন ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানের সমালোচনা করা হচ্ছে যখন ছাত্ররা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য রাজপথে লড়াই সংগ্রাম করেছে। এটাই এদেশের বাস্তবতা। এদেশ সহজে নতুন কিছু গ্রহণ করতে পারে না। যখন গ্রহণ করে তখন অনেক দেরি হয়ে যায় অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। দেখা যাক এবার কি হয়, এজন্য অপেক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ২০১৬ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০২৫
এজে