ঢাকা, বুধবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

রাজনীতি

‘মুক্তিমঞ্চ’ নিয়ে একা হয়ে যাচ্ছেন কর্নেল অলি!

মহসিন হোসেন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৯
‘মুক্তিমঞ্চ’ নিয়ে একা হয়ে যাচ্ছেন কর্নেল অলি!

ঢাকা: বিএনপির একসময়কার প্রভাবশালী নেতা কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদের নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তিমঞ্চের আত্মপ্রকাশের বিষয়টি প্রথম থেকেই ভালো চোখে নেয়নি ২০ দলীয় জোটের প্রধান শরিক বিএনপি। তারা প্রথম থেকেই এই মুক্তিমঞ্চ গঠনকে সন্দেহের দৃষ্টিতে রেখেছিল। সেই সন্দেহ ক্রমেই বাড়ছে কর্নেল অলি আহমদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে। ফলে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন অলি আহমদ।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সভাপতি ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান ও জাতীয় দলের সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদাকে নিয়ে কর্নেল অলি আহমদ মুক্তিমঞ্চ গঠন করায় নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তিমঞ্চ গঠনের কয়েকদিন পরেই বিএনপি নেতা ইসমাইল হোসেন বেঙ্গলকে এলডিপির প্রেসিডিয়াম সদস্য করেন কর্নেল অলি আহমদ।

এতে সন্দেহ আরও বাড়ে।

জানা গেছে, ইতোমধ্যে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছে এলডিপি ও জাগপা’য়। কল্যাণ পার্টি না ভাঙলেও দলের মহাসচিব এমএম আমিনুর রহমানের পদত্যাগকে কেন্দ্র করে রয়েছে এক ধরনের অস্থিরতা। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেও রয়েছে নানা ধরনের গুঞ্জন। অনেকে মনে করছেন এই মঞ্চ সৃষ্টির পেছনের উদ্দেশ্য জাতীয়তাবাদী শক্তিকে বিভক্ত করে বিএনপির বাইরে একটি আলাদা ফ্রন্ট খোলা। নেপথ্য শক্তি হিসেবে কাজ করছে জামায়াতে ইসলামী।

জানা গেছে, আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না দিলেও ২০ দলীয় জোটের কয়েকটি শরিক দল নিয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক জোট ‘জাতীয় মুক্তিমঞ্চ’ থেকে কৌশলগত দূরত্ব বজায় রাখছে বিএনপি। উপরন্তু মুক্তিমঞ্চের কার্যক্রমে বিএনপির নেতাদের অসন্তোষের ব্যাপারটি প্রকাশ হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে এ জোটের আষ্টেপৃষ্ঠে রয়েছে জামায়াত। স্বাধীনতাবিরোধী দলটির ব্যাপারে মুক্তিমঞ্চের উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্য এ জোটকে জামায়াতের নয়া প্ল্যাটফর্ম হিসেবেই পরিচিত করেছে রাজনৈতিক মহলে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও জাগপার সম্মেলনে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনুপস্থিতিই প্রমাণ করছে কর্নেল (অব.) অলির নেতৃত্বাধীন জাতীয় মুক্তিমঞ্চ ও শরিকদের কোনোভাবেই ছাড় দিতে রাজি নয় দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। গত ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের।

সূত্র জানায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশেই কল্যাণ পার্টির অনুষ্ঠানে হাজির হননি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অন্যদিকে কল্যাণ পার্টির ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।

৬ ডিসেম্বর ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় মুক্তিমঞ্চের আরেক শরিক জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) জাতীয় সম্মেলনেও একই অবস্থা দেখা যায়। বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সম্মেলনে থাকার কথা থাকলেও তারা উপস্থিত হননি। উপস্থিত হয়েছিলেন জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মাওলানা আবদুল হালিম ও এলডিপির প্রেসিডিয়াম সদস্য ইসমাইল হোসেন বেঙ্গল।

অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, আমি ঢাকার বাইরে ছিলাম। সেজন্য জাগপার অনুষ্ঠানে যেতে পারিনি।

আর জাগপা নেতা নজরুল ইসলাম বাবলু বাংলানিউজকে বলেন, মওদুদ আহমদ লন্ডনে গেছেন। সেজন্য অনুষ্ঠানে আসার কথা থাকলেও আসতে পারেননি।

অন্যদিকে মুক্তিমঞ্চের বিষয়ে নানাভাবেই বিএনপি নেতারা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আগে ২০ দলীয় জোটের যেকোনো শরিক দলের কর্মসূচিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বা স্থায়ী কমিটির সদস্যদের উপস্থিতি দেখা গেলেও মুক্তিমঞ্চ গঠনের পর সেই ধারাবাহিকতার ছন্দপতন ঘটে। বিশেষ করে মুক্তিমঞ্চের দলগুলোর কর্মসূচিতে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের আর দেখা মেলে না।

এদিকে খন্দকার আবিদুর রহমান ও খন্দকার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে জাগপার একাংশ নিজেদের আলাদা ও মূল জাগপা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পঞ্চগড়-২ আসনটি ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধানকে না দেওয়ায় তিনি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ওপরে নাখোশ। ফলে আবিদুর রহমান ও খন্দকার লুৎফরের জাগপা’ই ২০ দলীয় জোটের স্বীকৃতি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিকে এলডিপি সভাপতি ও জাতীয় মুক্তিমঞ্চের প্রধান কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ রয়েছেন দেশের বাইরে। এর মধ্যে দলের মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করছেন। তার অংশ হিসেবে ৭ ডিসেম্বর লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) এক আলোচনা সভায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আব্দুর রব ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। জামায়াত নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে না শর্তে তারা এলডিপির আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেও আলোচনা সভায় উপস্থিত হননি।

১৭ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবে এলডিপি আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তিনি যাননি।  

এরই মধ্যে দুই ভাগ হয়েছে এলডিপি। সাবেক হুইপ আবদুল করিম আব্বাসী ও শাহাদাত হোসেন সেলিমের নেতৃত্বে নতুন এলডিপি গঠিত হয়েছে। দ্রুততম সময়ে তাদের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে গত ১১ ডিসেম্বর এলডিপি’র আব্বাসী ও সেলিম অংশের আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। অলির পক্ষ থেকে চেষ্টাও করা হয়েছিল যাতে খসরু উপস্থিত না হন। কিন্তু তাতে সফল হন নাই অলি। বরং অলি অংশের আমন্ত্রণে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের অনুপস্থিতি প্রমাণ করছে মুক্তিমঞ্চের বিষয়ে কতটা কঠিন অবস্থানে রয়েছে বিএনপি।

সূত্র জানায়, বিএনপির পক্ষ থেকে দলের শীর্ষনেতাদের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যাতে করে তারা মুক্তিমঞ্চের শরিকদের কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত না হন এবং তাদের চাপে রাখেন। এ নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও অলি আহমদের মুক্তিমঞ্চ গঠন ও খালেদা জিয়ার মুক্তি চাওয়াকে ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি’ বলে উল্লেখ করেছেন বিএনপির মহাসচিব।

জানতে চাইলে নবগঠিত এলডিপির সদস্য সচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, আমি মনে করি খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের জন্য আলাদা জোট করার দরকার নেই। ২০ দল রয়েছে। সুতরাং বিষয়টি বিএনপি ভালো চোখে দেখবে না এটাই স্বাভাবিক। আমার ধারণা কর্নেল অলি আহমদ মুক্তিমঞ্চ গঠন করে একা হয়ে পড়েছেন। অচিরেই তিনি ২০ দল থেকে ছিটকে পড়লে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

২০ দলীয় জোটের এক শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, বিএনপি এবং ২০ দলের বাইরে একটি শক্তি তৈরি করে রাজনীতিতে অবস্থান নিতে চায় অলি আহমদ ও সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। তাদের সঙ্গে বিএনপি থেকে পদত্যাকারী নেতারাও শরিক হতে পারে। তাদের এই কাজের পেছনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা থাকতে পারে।

সূত্র জানায়, মুক্তিমঞ্চ নিয়ে এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ একা হয়ে পড়ছেন। ২০০১-২০০৬ সালের ক্ষমতার শেষ পর্যায়ে এসে অলি আহমদ বিএনপিকে বড় ধরনের ভাঙনের মুখে ফেলে দিয়েছিলেন। সেই সময় বিএনপির রাজনৈতিক ইমেজ ক্ষুণ্ন করতে খুবই কঠিন বক্তব্য দিয়েছিলেন গণমাধ্যমে। তার বক্তব্য জিয়া পরিবারের চরিত্র হননে বিরোধী পক্ষ এখনও ব্যবহার করে। সব মিলিয়ে অলি আহমদের ওপর বিএনপির শীর্ষ নেতাদের আস্থা কখনো খুব বেশি ছিল না। বরং তারা সব সময়ই তাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতেন। সম্প্রতি মুক্তিমঞ্চের মাধ্যমে বিএনপির বিকল্প প্ল্যাটফর্ম গঠনের বিষয়টিকেও বিএনপি প্রথম থেকেই ছাড় না দেওয়ার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল।

সূত্র আরও জানায়, বিএনপি কৌশলে অলি আহমদকে একা করে ফেলেছে। মুক্তিমঞ্চের অন্যান্য শরিকরাও হয়তো এক সময় তাকে ছেড়ে বিএনপির পক্ষেই অবস্থান গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে অলি আহমদের ঘনিষ্ট মিত্র কল্যাণ পার্টি, জাগপা, জাতীয় দলও শেষ পর্যন্ত তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে বিএনপির পক্ষেই থেকে যেতে পারে।

জানতে চাইলে এলডিপি অলি আহমদ অংশের মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, বিএনপির সঙ্গে আমাদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আমরা ২০ দলে ছিলাম, আছি। মুক্তিমঞ্চ গঠন করায় বিএনপি নাখোশ, এমনটি আমি মনে করি না। বরং আমরা খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনসহ সরকারবিরোধী সব আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে আছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪১১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৯
এমএইচ/এসএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।