কোনো একজনমাত্র ব্যক্তির উপস্থিতির কারণে নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন গ্যালারির সব টিকেট বিক্রি হয়ে যাবার ঘটনা খুবই বিরল। যে জনাকয় ব্যক্তির বেলায় এমনটি ঘটেছে তাদের সবাই অনেক আগে থেকেই বিশ্বনন্দিত সেলিব্রেটি।
অথচ এই লোকটাকেই ‘গুজরাট দাঙ্গার হোতা’ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র নিষিদ্ধ করেছিল একদা । আর সেই লোকই কিনা মার্কিন মুলুকে এসে জয় করে নিল বরমাল্য! যেন এক রূপকথার কাহিনি থেকে উঠে এলেন তিনি। এসেই জয় করলেন সবার মন। ‘ভিনি, ভিদি, ভিসি’ বা সরল বাংলায় যাকে বলে , ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’! গত সেপ্টেম্বরের ঘটনা এটি। ‘ম্যনহাটান এরিনা’ নামে খ্যাত ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে সেদিন কোন জাদুর টানে ছুটে এল এতো-এতো লোক? মোদী নামের ছোটখাট আকারের এই লোকটাই যে ভারত জয় করলেন! সেজন্যই এই কৌতূহল। এই সেই লোক যিনি শত কোটি ভারতবাসীকে এক শক্তিশালী ভারত গড়ার মন্ত্র শুনিয়ে, স্বপ্ন দেখিয়ে বাজিমাত করলেন। বহু বছরের অর্থনৈতিক দুরবস্থা দূর করে ভারতকে বিশ্বসভায় শক্তিমান রাষ্ট্রগুলোর কাতারে তুলে আনবার, মর্যাদার আসনে বসানোর স্বপ্ন দেখালেন তিনি। খোল নলচে পাল্টে দেবার কথা বললেন আর সে-কথায় ভরসা করে ভোটবাক্স ভরে দিল কোটি কোটি ভারতবাসী। আর তাতেই ভারতের গত তিন দশকের নির্বাচনী ইতিহাসের সবচে বড় জয় ছিনিয়ে আনলেন। হয়ে উঠলেন নায়ক। মার্কিন মুলুকে এক সময়ের অবাঞ্ছিত মোদী সবচে বড় মেহমানের মর্যাদা নিয়ে বুক টান করে যা দেখালেন, বুঝিবা তারই নাম ক্যারিশমা। টানা একটা ঘণ্টা সমবেত সবাইকে মোদী শুনিয়ে গেলেন তার আশা ও স্বপ্নগাথা—‘‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’’ (সবাইকে নিয়ে, সবার ভাগ্যোন্নয়ন’’)। বক্তব্যের মাঝে বারংবার পুরো ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন কাঁপিয়ে স্লোগান উঠল ‘‘মোদী, মোদী, মোদী’’। যেন এটা ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন নয় বরং ভারতেরই কোনো কোনো বিশাল নির্বাচনী জনসভা।

যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষ করে দেশে ফেরার মাসকয় পর ২০১৫ সালের ২ মে তার দু’ঘণ্টাদীর্ঘ এক বিরল সাক্ষাৎকার নিল বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন । সেখানেও ‘‘গুজরাট কাণ্ডের হোতা’’ নয়, বরং পাওয়া গেল অন্য এক মোদীকে । অকপট, আন্তরিক, খোলামেলা, বাস্তববাদী আর একইসঙ্গে আবেগকাতর এক মোদীকে। বিব্রতকর প্রশ্নের মুখেও সাবলীলভাবে নিজের অবস্থান তুলে ধরেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক থেকে শুরু করে সংখ্যালঘুদের প্রতি তার সরকারের বিপিতাসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি সব প্রশ্ন ও সমালোচনার জবাবই তিনি দিয়েছেন। রাষ্ট্রনায়কের চেয়ে আটপৌরে, সহজিয়া এক ব্যক্তি-মানুষের ছবিই তাতে ধরা পড়েছে বেশি। টাইম-এর ভাষায়, ‘‘…the public man gets surprisingly personal.’’
টাইম জানতে চাইলো ক্ষমতা আরোহণের পথে দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রায় কে ছিলেন তার প্রেরণা। প্রশ্নটা শুনে বেশ কিছুটা সময় নীরব থাকলেন ‘ভারতের নব ভাগ্যবিধাতা’। তারপর বলতে থাকলেন:
‘‘খুবই গরিবঘরে জন্ম আমার। যখন খুব ছোটোটি ছিলাম ট্রেনের কামরায় কামরায় চা- বিক্রি করতাম। আমার মা ছিলেন কাজের মাসি। সংসার চালানোর জন্য মা আমার মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করতেন, বাসন পেয়ালা ঘটি বাটি পরিষ্কার করতেন। নিউ ইয়র্ক আর আলো-ঝলমল ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন থেকে বহুদূরে ’’
পশ্চিম ভারতের গুজরাট রাজ্যের এক ছোট শহরে নিজের ফেলে আসা দারিদ্র্যপীড়িত শৈশবের কথা বলতে বলতে জলে ভরে উঠলো তার দুই চোখ। কিন্তু অশ্রু গোপন করবার কোনো চেষ্টা নেই। রুমালে চোখের কোন মুছতে মুছতে বলে যেতে থাকলেন: ‘‘আমার পুরোটা শৈশব ছিল দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। এক দিক থেকে আমার জন্য বরং দারিদ্র্যই ছিল প্রথম প্রেরণা--- গরিব মানুষের জন্য কিছু করবার সংকল্প ও অঙ্গীকারটার জন্ম দারিদ্র্যই দিয়েছে আমার মধ্যে। ’’
এই অঙ্গীকারটাই তাকে সব সময় নাকি তাড়িয়ে বেড়ায়। এই এজেন্ডা সামনে রেখেই তার কাজ তিনি করে চলেছেন। আর সেটা কাউকে কাছে টেনে আর কাউকে দূরে সরিয়ে নয়, বরং সবাইকে সঙ্গে নিয়ে---‘‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’’। যেটা ছিল তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানের স্লোগান, সেই স্লোগানকে বুকে ধারণ করেই এগুচ্ছেন মোদী। আর এই স্লোগানই গত বছরের মে মাসে গুজরাজের মুখ্যমন্ত্রী থেকে রাতারাতি দিল্লির সবচে বড় ক্ষমতার আসনটিতে তুলে এনেছে তাকে। মানে ১ শ ২৫ কোটি ভারতীয়র জীবনকে ইতিবাচকভাবে বদলে দেবার গুরুদায়িত্ব এখন তার কাঁধে। গোটা পৃথিবীর জনসংখ্যার ৬ ভাগের এক ভাগের দায়িত্ব। দুনিয়ার আর কোনো গণতান্ত্রিক দেশের নেতা এমন ক্ষমতা কখনো পাননি। ক্ষমতার এক বছরের মধ্যেই তিনি নিজের যোগ্যতাও প্রমাণ করে ছেড়েছেন। টাইম—এর ভাষায় অল্প দিনেই তিনি হয়ে উঠেছেন ‘‘ গ্লোব্যাল পলিটিক্যাল স্টার’’। মানুষ হিসেবে মোদী যে কতোটা নিরলস পরিশ্রমী সেটাও জানা গেল। সারাক্ষণ কাজে ডুবে থাকেন বলে রাতে মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমানোর ফুরসত পান। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ইয়োগা (যোগ ব্যায়াম) করেন। এরপর বসে যান কাজে। কেউ কেউ তাকে ‘‘ইয়োগা-মন্ত্রী’’ বলেও ডাকেন।
প্রধানমন্ত্রী হয়েও, হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও মানুষের সাথে যোগাযোগটা তিনি কমাননি বরং বাড়িয়ে চলেছেন কেবল। এজন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারকে বেছে নিয়েছেন মোদী। রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে টুইটারে অনুসারীর সংখ্যার দিক থেকে বারাক ওবামার পরেই তার স্থান। ভারত ক্রিকেট খেলতে নামলে মোদী টুইট করবেন না এমনটা হতেই পারে না। মানুষের মনের কাছে যাবার অদম্য এই ইচ্ছেটা ৬৪ বসন্ত পার করা মোদীর জন্য যেন এক অবশ্যকর্তব্য। যখন ক্রিকেট বা এরকম কিছু থাকে না তখন তিনি সরাসরি টুইট করেন বারাক ওবামা বা পুতিন বা শি জিন পিংকে। এরা তার প্রতিপক্ষই শুধু নন ব্যক্তিগত বন্ধুও। তার বন্ধুবৎসল স্বভাবের কারণেই তা সম্ভব হয়েছে । বন্ধুত্বের জন্য প্রটোকল ভাঙতেও কসুর করেন না। চিরশত্রু যে চীন, সেই চীনের প্রেসিডেন্টকে পর্যন্ত ব্যক্তিগত বন্ধু বানিয়ে ছেড়েছেন। প্রটোকল ভেঙে শি জিন পিংকে গুজরাটে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর চীন সফরে গিয়ে নিজেও পেয়েছেন প্রটোকলভাঙা বিরল আতিথেয়তা। এই প্রথম কোনো বিদেশি রাষ্ট্রনায়ককে চীনা রাজধানীর বাইরের কোনো শহরে উড়িয়ে নিয়ে আতিথ্য দেবার ঘটনা ঘটেছে। চীনের প্রাচীন ইতিহাসের নানা নিদর্শন দেখে আর বিরল আতিথেয়তা পেয়েই ক্ষান্ত হননি মোদী। ২হাজার ২শ কোটি ডলারের চুক্তিও করেছেন। যার ফলে ভারতে বিপুল বিনিয়োগের দরজা গেল খুলে। আর যে সীমান্তবিরোধ, সেটারও ইতি ঘটাবার সদিচ্ছা নিয়ে এশিয়ার দুই জায়ান্ট এখন আগের যে-কোনো সময়ের চেয়ে পরস্পরের আরো কাছাকাছি। পচা অতীতকে পেছনে ফেলে এখন কেবল এগিয়ে যাবার পালা। এমনই ক্যারিশমা তার। যারা তার দিকে একদা ভুরু কুঁচকে তাকাতেন, এখন তারাই ক্রমশ হয়ে উঠছেন তার মিত্র---দেশে এবং বিদেশে। বাংলাদেশের সরকার ও সাধারণ মানুষেরও মনে ভয় ছিল মোদী জিতলে নেতিবাচক অনেক কিছু হবে। বাস্তবে হচ্ছে বরং উল্টোটাই। দীর্ঘদিনের মেঘ সরিয়ে বাংলাদেশের সাথে করা সীমান্তচুক্তি অনুমোদন বিল পাশ করালেন ভারতের সব দলকে রাজি করিয়ে। একটিও ‘না’-ভোট কোনো দল দেয়নি। এমনকি কংগ্রেসও। বিল পাস হবার পর নিজের আসন ছেড়ে উঠে গিয়ে দাঁড়ালেন গিয়ে কংগ্রেস সুপ্রিমো সোনিয়া গান্ধীর আসনের সামনে। জোড়হস্ত প্রণাম করে সোনিয়াকে কৃতজ্ঞতা জানালেন। আর বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তাচুক্তির পথের কাঁটা যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাকেও বশ মানাতে উড়ে গেলেন পশ্চিমবঙ্গে। এভাবেই গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে এসে নতুন এক বাস্তববাদী রাজনীতির পথ রচনা করলেন মোদী। পণ্ডিতেরা যাকে বলেন ‘‘রিয়েল পলিটিক’’। বাস্তবতার রাজনীতি।

এভাবেই ঘরে-বাইরে জয়ের পাল্লা কেবলই ভারী হচ্ছে তার। তার পা এখন কতোটা মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো তা আঁচ করা যায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি নিকোলাস বার্নস-এর মন্তব্যে:
...he has shown himself to be very sure footed, very energetic..’’
ভ্রমণবিলাস নয়, বরং ভারতের উন্নয়নের স্বার্থে, ভারতকে বিশ্বসভায় আরো উঁচু আসন পাইয়ে দিতে একের পর এক দেশ চষে বেড়াচ্ছেন মোদী। কোনখান থেকেই খালি হাতে ফিরছেন না। ফিরছেন ভরা হাতে। গত এক বছরে প্রায় ১৯টা দেশ সফর করা হয়ে গেছে তার।
মোদী জানেন, দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক যে তরুণরা, যাদের বয়স ২৫ বছরের নিচে তারাই ভারতকে টেনে তুলবে পেশীর জোরে আর মগজ খাটিয়ে। এরাই তাকে ভোট দিয়ে এতোবড় আসনে তুলে এনেছে। কারণ তার মধ্যে তারা দেখেছে এক ত্রাতার ছবি; যিনি ভবিষ্যতের এক উজ্জ্বল অগ্রগামী শক্তিমান ভারত গড়ার যোগ্য কারিগর হবেন। ৬৪ বছরের দেহে তিনি ২৫ বছর বয়সী তরুণ-যুবার তারুণ্য ও উদ্যম বহন করছেন সেটা বারেবারে প্রমাণ করে চলেছেন।
কিন্তু যে-সময়টায় তিনি ক্ষমতায় এলেন তখন বিশ্বব্যাপী মন্দার প্রভাবে ভারতেও প্রবৃদ্ধি হোঁচট খেল, নেমে এলো ৫ শতাংশে। এই নিম্নগতির প্রবৃদ্ধির মধ্যে তো আর বিপুল জনসংখ্যার দেশ ভারতের কোটি কোটি বেকারের জন্য চাকরি ও কাজের পর্যাপ্ত সুযোগ তৈরি করা সম্ভব নয়। ফলে কঠিন এক পরিস্থিতিতে ভারত নামের দেশটির হাল ধরতে হয়েছে মোদীকে। তার হাত ধরেই নিম্নগতির প্রবৃদ্ধির বৃত্ত ভেঙ্গে ভারত প্রবৃদ্ধি বাড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে এখন; চীনের সঙ্গে ২২ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সে লক্ষ্মণকেই স্পষ্ট করে তুলেছে। তার পূর্বসূরী প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ব্যক্তি হিসেবে সজ্জন হলেও নেতা হিসেবে দৃঢ়চেতা ও উদ্যমী ছিলেন এমনটা বলা যাবে না। বরং কংগ্রেসনেত্রী সোনিয়া ও তার তরুণ পুত্র রাহুল গান্ধীর আজ্ঞাবহ বলেই ভাবা হয় তাকে। এমনকি নিন্দুকেরা তাকে আড়ালে ‘পাপেট প্রধানমন্ত্রী’ (পুতুল প্রধানমন্ত্রী) বলেই ডেকে থাকেন। মোদী ঠিক তার উল্টো। তার ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা ও বিপুল উদ্যম তাকে অন্য সবার চেয়ে---তার অন্যসব পূর্বসূরীর চেয়ে-- আলাদাভাবে চিনিয়ে দেয়। নির্বাচনের আগে ভারতবাসী এটা ঢের বুঝতে পেরেছিল যে, কংগ্রেসের আর দেবার মতো কিছু নেই, ভিশন নেই, দূরদৃষ্টি নেই। ঠিক এমন সময় মোদী এসে নতুন এক ভবিষ্যমুখি অগ্রসরমান ভারতের স্বপ্ন দেখালেন। ‘‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’’ স্লোগানে বাজিমাত করলেন। এই মোদীর নামে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বদনাম যা ছিল, তা ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে তার নেতৃত্বের ক্যারিশমায়। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে নিজ রাজ্য গুজরাটকে তিনি সারা ভারতে করে তুলেছিলেন উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির মডেল। আর সেটাই জাতীয় নির্বাচনে তার পক্ষে কথা বললো। ভারতীয় আমলাতন্ত্রের নিগড় থেকে নিজ রাজ্য গুজরাটকে মুক্ত করে একে তিনি করে তুলেছিলেন ব্যবসাবান্ধব এক স্বর্গ। তাই সবাই বলাবলি করতে লাগল, ভারতীয় অর্থনীতির স্থবির ইঞ্জনটাকে সচল করতে ‘‘গুজরাট মডেল’’ ছাড়া উপায় নেই।

এসব ইতিবাচকতার পাশাপাশি টাইম-এর নিবন্ধে মোদীর বিতর্কিত অতীতের কথাও তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, ২০০২ সালে ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডে ৫৯ জন হিন্দু তীর্থযাত্রীর পুড়ে মরার ঘটনার পর মোদীর রাজ্য গুজরাটে ভয়াবহ জাতিগত (মুসলিমবিরোধী)এক দাঙ্গা শুরু হয়। বলা বাহুল্য, তাতে অন্তত এক হাজার মানুষের মুত্যু হয়। এসব মানুষের বেশিরভাগই সংখ্যালঘু মুসলমান। এই দাঙ্গার মদদদাতা হিসেবে মোদীকেই দায়ী করা হয়। কেননা দাঙ্গা ঠেকাতে মুখ্যমন্ত্রী হয়েও মোদী কোনো উদ্যোগ নেননি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও তাকে ‘‘দাঙ্গা-মোদী’’ বলতে ছাড়েন না।
তবে মোদী সবসময়ই এসব সমালোচনাকে অগ্রাহ্য করে এসেছেন। তার দাবি, জ্ঞানত তিনি কোনো অন্যায় করেননি। আর তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগও দায়ের করা হয়নি। এ-সত্ত্বেও দাঙ্গার তিন বছর পর যুক্তরাষ্ট্র সরকার সেদেশে মোদীর সফরের/প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু গত বছর মোদী যখন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তখন সেই যুক্তরাষ্ট্রই নীরবেই তার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞাটা তুলে নেয়।
মোদী নির্বাচিত হবার পর ভারতে সংখ্যালঘুদের ভবিষ্যৎ কী হবে---এ-প্রশ্নটাও কিন্তু ভোটের আগে জোরেসোরেই উঠেছিল। আতঙ্কও ছিল। আশঙ্কা ছিল, বিজেপি-সংশ্লিষ্ট উগ্র হিন্দুত্ববাদী গ্রুপগুলোর মারমুখি উত্থান নিয়েও। গত ডিসেম্বরেই সে-আশঙ্কা কিছুটা সত্য বলেও প্রমাণিত হয় এক জুনিয়র মন্ত্রীর উগ্র মন্তব্যে। নিরঞ্জন জ্যোতি নামের এই জুনিয়র মন্ত্রী রাজধানী নয়াদিল্লির স্থানীয় এক নির্বাচনী জনসভায় ভোটারদের উদ্দেশ্যে বলেন, তাদের নিতে হবে তারা ‘ভগবান রামের সরকার’--এর (মোদীর সরকার) পক্ষে থাকবেন নাকি বেজন্মাদের পক্ষে থাকবেন। চাপের মুখে পরে অবশ্য তিনি তার মন্তব্যের জন্য দু:খপ্রকাশ করতে বাধ্য হন। সমালেঅচনার মুখে প্রধানমন্ত্রী মোদীও প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, নিরঞ্জন জ্যোতির বক্তব্যকে তার দল ও সরকার সমর্থন করে না। কিন্তু নিরঞ্জন জ্যোতির বিরুদ্ধে মোদী কোনো ব্যবস্থাই নেননি। ফলে তিনি বহাল তবিয়তেই আছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও ভারত সফরকালে বিজেপি সরকারের এসব আচরণের ব্যাপারে তার সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করেন। দিল্লিতে এসে তিনি প্রকাশ্যে বলে গেছেন, ভারত যতদিন ধর্মীয় বিভাজন বা অন্য কোনো বিভাজন থেকে নিজের গা বাঁচিয়ে চলবে ততদিনই সফলতার মুখ দেখবে। সব মত-পথ-বিশ্বাসকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েই চলতে হবে ভারতকে।

টাইম—এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারেও মোদী বলেছেন, তার সরকার সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ‘‘যখনই কেউ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছে, আমরা তা তৎক্ষণাৎ নাকচ করেছি’’।
মোদী একথাও বলতে ভোলেননি: ‘‘আমার সরকারের কাছে একটাই পবিত্র গ্রন্থ, আর তা হচ্ছে ভারতের সংবিধান। আমার সরকার ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের নিরিখে কোনো বৈষম্য সহ্য করবে না। বলতে কি, ভারতের বহুত্ববাদ ও ভারতীয় সভ্যতার বহুমুখিতা এমন এক সুন্দর বিষয় যা নিয়ে আমরা যারপরনাই গর্বিত। আমার নিজের এবং আমার দলের এবং আমার সরকারের দর্শন হচ্ছে ‘‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’’।
মোদীর অতীত: র্যাগস টু রিচেস: নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদীর জন্ম ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ সালে, উত্তর গুজরাটের ছোট্ট শহর বাদনগরে। তিনিই ভারতের একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যার জন্ম ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন-অবসানের পরে।
ব্রিটিশরা চলে যাবার পর বেশিরভাগ সময় ভারত শাসন করেছে কংগ্রেস। আর কংগ্রেস চালিয়েছে দিল্লির অভিজাত এলিটরা। মোদী সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। দিল্লির বাইরের এক রাজ্যের এক সাধারণ দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসে প্রধানমন্ত্রী হয়ে মোদী সেই অভিজাত-ধারাবাহিকতায় ছন্দপতন ঘটালেন। সামান্য এক চা-বিক্রেতার ছেলের ভারতের ভাগ্যবিধাতা হওয়ার এই ঘটনা রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে। দরিদ্র বাবার মতো নিজেও তিনি ট্রেনে ট্রেনে চা বিক্রি করতেন বালক বয়সে। ৬০-এর দশকের শেষ দিকে বয়স যখন ১৭, মোদী বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। বেছে নিলেন সন্ন্যাসজীবন। চষে বেড়ালেন ভারতের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত---তীর্থ থেকে তীর্থে। ঘোরাঘুরি শেষ হলে এক সময় ঘরের ছেলে ফিরলেন ঘরে। এরপরে এক সময় গেলেন রাজ্যের রাজধানী আহমেদাবাদে। সেখানে গিয়ে নাম লেখালেন বিজেপির সহযোগী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে (আরএসএস)। এরপর আশির দশকের শেষ দিকে যোগ দেন বিজেপিতে। সে সুবাদে পাড়ি জমালেন নয়াদিল্লিতে। সেখানে বিজেপির সদর দপ্তরে কয়েক বছর কাজ করেন। এরপর ২০০১ সালে দল তাকে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হতে আহমেদাবাদে পাঠায়। এর পরের ইতিহাস তো সবার জানা—‘‘কুঁড়েঘর থেকে প্রাসাদে’’; ইংরেজিতে যাকে বলে ‘‘র্যাগস টু রিচেস’’।
আগামীকাল পড়ুন:
মোদীর সাক্ষাৎকার –‘‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’’
বাংলাদেশ সময়: ০৮১২ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৫