‘এক হাতে তালি বাজে না’ একটি প্রাচীন গ্রামীণ প্রবাদ- যা সাধারণত এমন পরিস্থিতি বোঝাতে ব্যবহার করা হয় যেখানে এক পক্ষের একতরফা চেষ্টা বা উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। এর মানে হলো, কোনও কাজ বা ঘটনা এবং তার সমাধান লাভের জন্য দু’পক্ষের সহযোগিতা বা সমন্বয় প্রয়োজন।
ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কিন্তু ছাত্র, শিক্ষক, পেশাজীবীদের রাজনীতি করা একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। সে কারণে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা বাস্তবসম্মত নয়। আগেও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ করা যায়নি, বরং গুপ্ত রাজনীতির বিকাশ হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করতে গেলে সংঘাত আরও বাড়বে।
প্রকৃত সমস্যা সশস্ত্র ও জবরদস্তিমূলক তৎপরতা, যা বন্ধ করা সম্ভব। প্রশাসন নিরপেক্ষ হলে এবং নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে গণতান্ত্রিকভাবে এ সংকট সমাধান করা যাবে। এ কথাগুলো শুধু আমার নয়, সচেতন প্রতিটি মানুষের যা কুয়েটের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পরে সবাই সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরেছে।
বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে, যা দেশের স্বাধীনতা, মুক্তি ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্রদের আত্মত্যাগ, সংগ্রাম এবং নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি একটি অনন্য উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাত্র রাজনীতি একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রগতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ঔপনিবেশিক শাসন থেকে শুরু করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিটি আন্দোলনে ছাত্র রাজনীতির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য ছাত্র সমাজ যে সংগ্রাম চালিয়েছিল, তা পৃথিবীজুড়ে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। ছাত্রদের জীবনদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয় যা বিশ্বের অন্যতম শ্রদ্ধেয় ইতিহাস হয়ে থাকবে।
১৯৫৪ সালে ছাত্রসমাজ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সচেতনতার নতুন যুগের সূচনা করে। তারা গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছিল। ১৯৬২ সালে ছাত্ররা শিক্ষানীতি সংস্কারের জন্য আন্দোলন করে যেখানে তারা শিক্ষার বৈষম্য দূর করতে এবং শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার দাবিতে জীবন দিয়েছে। ১৯৬৯ সালে ছাত্রসমাজ স্বায়ত্তশাসন ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ ও ভূমিকা রাখে, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অমর অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজের অবদান ছিল অমূল্য। তারা পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। ১৯৯০ সালে ছাত্র সমাজ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে, যার ফলে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৩ সালে শাহবাগে অনুষ্ঠিত গণজাগরণ আন্দোলনে ছাত্রসমাজ আবারও যুদ্ধাপরাধীর বিচার, গণতন্ত্র এবং মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়। ২০২৪ সালে ছাত্রসমাজ-জনতা মিলে একটি নতুন গণঅভ্যুত্থান সফল করে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পক্ষে শক্তিশালী বার্তা দেয়।
এই সকল আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে ছাত্রসমাজ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অনন্য ভূমিকা পালন করেছে এবং দেশের মুক্তি, গণতন্ত্র, শিক্ষা ও সামাজিক উন্নতির পথ মজবুত করেছে। ছাত্র রাজনীতি একটি শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন, যা দেশের ভবিষ্যৎ গড়তে সহায়ক।
ছাত্র রাজনীতি শিক্ষার্থীদের গণতন্ত্রের প্রাথমিক ধারণা, নেতৃত্বের গুণাবলি এবং রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়াতে সহায়তা করে। এটি তাদের রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয় এবং পরবর্তীতে দেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে তাদের ভূমিকা পালনে সহায়তা করে। অনেক জাতীয় নেতা ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে এসেছেন, যা তাদের নেতৃত্বের দক্ষতা বিকাশে সহায়ক ছিল। ছাত্র রাজনীতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে যুক্তিবাদী মানসিকতা গঠন করতে সাহায্য করে, যা পরবর্তী জীবনে তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে সহায়ক।
অপরাজনীতি এমন একটি ব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে রাজনীতির মৌলিক নীতিগুলো উপেক্ষিত হয় এবং ব্যক্তিস্বার্থ, ক্ষমতার অপব্যবহার, সহিংসতা, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন রাজনীতির চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে, যা প্রকৃত ছাত্র রাজনীতিকে ব্যাহত করছে।
রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও দলীয় দখলদারিত্ব শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট করছে। ক্যাম্পাসে দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভেদ তৈরি হচ্ছে এবং অপরাজনীতি গুণগত নেতৃত্ব বিকাশের পথ রুদ্ধ করছে। এর ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা সমাধান নয়, বরং সুষ্ঠু ছাত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় ক্যাডার নিয়োগ নিষিদ্ধ করতে হবে, গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়ানো এবং নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
ছাত্র রাজনীতি যদি সুষ্ঠু এবং অপরাজনীতি মুক্ত হয়, তবে তা জাতির জন্য আদর্শিক ও যোগ্য নেতৃত্ব তৈরির পথে সহায়ক হবে। সঠিক ছাত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হলে তা দেশের উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য স্পষ্ট নিয়মকানুন প্রবর্তন করা উচিত, যাতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ করতে পারে। ছাত্র সংগঠনগুলোর সহিংসতা ও অস্থিরতা কমাতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ছাত্র রাজনীতিতে সুস্থ ও গণতান্ত্রিক চর্চার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে সকল মতামত সম্মানিত হবে। সহিংসতা প্রতিরোধে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব তৈরির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ আয়োজন করা যেতে পারে। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ না করে, তার ইতিবাচক দিকগুলো বজায় রেখে সহিংসতা ও অপরাজনীতি থেকে মুক্ত রাখতে হবে। ছাত্ররা ন্যায়ভিত্তিক ও আদর্শিক রাজনীতি চায়, যা তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে।
ডাকসু নির্বাচন নিয়মিত করতে এবং ছাত্র রাজনীতির সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়ন জরুরি। ছাত্র সংগঠনগুলো একমত যে, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ নয়, বরং সন্ত্রাস বন্ধ করতে হবে এবং দ্রুত ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে হবে।
শিক্ষা একটি জাতির অগ্রগতির মূল চাবিকাঠি। তবে বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমানে নৈরাজ্য, অব্যবস্থাপনা এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় বিচ্যুতি রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের উন্নত ভবিষ্যতের জন্য বড় বাধা। এই সমস্যা দূর করতে এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে একটি যুগোপযোগী, চাহিদাভিত্তিক এবং জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন।
বর্তমানে শিক্ষার মানের তারতম্য, অব্যবস্থাপনা এবং অকার্যকর নীতিমালার কারণে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ পর্যায়ে শিক্ষার সুযোগ ও মানের পার্থক্য সমাজের সব শ্রেণীর শিক্ষাগত উন্নতি বাধাগ্রস্ত করছে।
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার, যা উন্নয়নের মূল স্তম্ভ। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দ করা, যা শিক্ষার মান উন্নয়ন করবে এবং সমান শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করবে। এতে দক্ষ, সৃজনশীল এবং জ্ঞানী জনগোষ্ঠী গড়ে উঠবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং সুষম শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, একটি জাতির অগ্রগতির জন্য শিক্ষা অপরিহার্য। তিনি প্রাইভেট সেক্টরের ভূমিকা নিয়েও কথা বলেছেন। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায়, যেখানে শিক্ষার মান বজায় রেখে বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। এছাড়া তিনি শিক্ষাকে কেবল জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম নয়, বরং একটি জাতির সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে মনে করেন। তার মতে, গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ গবেষণার মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তি এবং সৃজনশীলতা আসবে যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।
রাজনৈতিক দল বা সংগঠন নিষিদ্ধ করা গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে গণতন্ত্রের অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিষিদ্ধ দল বা সংগঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সংঘাত বাড়ে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন একচেটিয়া পরিবেশ তৈরি হয়, যা স্বৈরতন্ত্রের ঝুঁকি বাড়ায়। রুশো বলেছেন, ‘গণতন্ত্র তখনই কার্যকর হয় যখন জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত থাকে। ’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দল ও সংগঠন নিষিদ্ধ করার কিছু দৃষ্টান্ত রয়েছে, তবে এটি সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয়। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা উন্মুক্ত রাখতে হবে, যাতে সকল মতামত ও পক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে সংঘাত এড়ানোই উত্তম পথ। দল বা সংগঠন নিষিদ্ধ করা সমাজের উন্মুক্ততাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রমকে সংবিধান ও আইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা গণতন্ত্রের জরুরি। ছাত্র রাজনীতি নয়, অপরাজনীতি, গুপ্ত রাজনীতি বন্ধ হওয়া জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে