ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ডা. জাফরুল্লাহর সঙ্গে এক টুকরো স্মৃতি

মাছুম কামাল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০২৩
ডা. জাফরুল্লাহর সঙ্গে এক টুকরো স্মৃতি

১.
তখন করোনাকাল। বেশ একটা ভয়ের আবেশ চারপাশে।

কখন কে মারা যায়! পড়াশোনার পাঠ প্রায় চুকে এসেছে, কিন্তু শেষ হয়নি তখনও। পড়াশোনা সূত্রে নিকটতম জেলা শহর কুমিল্লাতেই থাকতাম।

 

করোনা যখন শুরু হয়, তখনও পড়ছিলাম সেখানেই। ফিরে এসেছি বাড়িতে। তো, সেই সময়ে ভরসা বলতে শুধুই টিভি। দিনের পর দিন বের হওয়া যেতো না বাড়ি থেকে। দুপুরের দিকে একবার ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার ব্রিফিং। সেই দিকেই তাকিয়ে থাকতাম পরিবারের সবাই। শনাক্তের সংখ্যা বা মৃত্যু কমলো নাকি বাড়লো!

এই যখন অবস্থা, চারদিকে দিশাহীন বিভ্রান্ত মানুষ, তখন ধীরে-ধীরে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ডাক্তার পরিচয়ের সঙ্গে পরিচিত হই। টিভিতে দেখি উনি করোনা রোগীদের চিকিৎসার্থে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন, কিন্তু জায়গা পাচ্ছেন না! তার প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত স্বল্প মূল্যের কিট অনুমোদন পাওয়া না পাওয়া নিয়ে কত টালবাহানা। এরপর যখন টিকা, কিট নিয়ে নানা ধরণের দুর্নীতির গল্প বেরিয়ে এলো, প্রতারক সাহেদ, সাবরিনাদের উত্থান হলো, তখন আর কারো বোঝার বাকী রইল না যে, সমস্যাটা আসলে কোথায় হচ্ছিল।

২.
‘আগুনের দিন শেষ হবে একদিন’ বাংলা সিনেমার এই জনপ্রিয় গানের মতো করোনার সেইসব ভয়াবহ দিনও শেষ হলো এক সময়। ঘরকুনো মানুষেরা সবাই যার-যার গন্তব্যে ফেরত যাওয়া শুরু করলেন। ইতোমধ্যে সাংবাদিকতার পুরোনো যোগসূত্র ধরে আমিও চলে এলাম ঢাকায়। তখন পর্যন্ত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী টিভির পর্দায় দেখা সেই হিরো। করোনার টালমাটাল সময়ে যিনি, যার প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র আমাদের অন্তত আশ্বস্ত করতে পেরেছিলেন। সেই সময়ের ভয়াবহ প্রেক্ষাপটে সেটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সবারই অনুধাবন করার কথা।  

যাইহোক, ঢাকায় আসার পর প্রথম প্রথম তরুণ রিপোর্টার হিসেবে প্রায়ই প্রেসক্লাবে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হতো আমাকে। কত যে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের প্রোগ্রাম কভার করতে পেরেছি। কিন্তু, আমি মনে-মনে খুঁজতাম ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকেই। টিভিতে দেখা সেই বীর'কে। শেষমেশ সেই সুযোগ এলো। এক শুক্রবারে নুরুল হক নূর, মাহমুদুর রহমান মান্নাদের একটা অনুষ্ঠানে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এলেন। সেই প্রথম সামনাসামনি দেখা। লুঙ্গি আর ঢোলা একটা হাওয়াই শার্ট পরে হুইল চেয়ার চেপে এসেছিলেন তিনি। খুব আস্তে-আস্তে বক্তব্য দিলেন। কিন্তু, সেটা স্পষ্ট।  

সেদিন কথা বলতে পারিনি। সেমিনারের মতো হয়েছিল। বেশ লম্বা সময় ধরে। ভাবলাম, বিরক্ত করা ঠিক হবে না।

৩.
এরপর বেশ কয়েকবার তার অ্যাসাইনমেন্ট কভার করেছি। পল্টন মোড়ে একদিন সকালে গিয়ে দেখি গার্মেন্টস শ্রমিকরা ন্যুনতম ২০ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন করছেন। চারপাশে পুলিশ। ওদের মাঝখানে কেউ একজন আছেন। এগিয়ে গিয়ে দেখি হুইলচেয়ারে বসা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। কথিত কোনো গার্মেন্টস নেতাকে সেদিন দেখলাম না। এই অসুস্থ মানুষটি প্রায় ২ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে পল্টনের রাস্তায় বসে রইলেন। তাকে ঘিরে প্রতিবাদ চললো। অথচ, নিজের লুঙ্গিটাও ঠিকঠাক পরার সুস্থতা উনার ছিল না সে সময়।  

এরপর আরও কয়েকবার দেখা হয়েছিল। একদিন প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হল থেকে একটা অনুষ্ঠান শেষ করে বের হয়েছেন। পেছনে গণসংহতি'র জোনায়েদ সাকি। এগিয়ে গিয়ে সাহস করে এটুকু বললাম, কেমন আছেন? গলায় আইডি কার্ড ঝোলানো দেখেই হয়ত বুঝলেন সাংবাদিক। আমি তো বিখ্যাত কেউ না। উত্তরে বললেন—‘ভালো আছি, দেশের জন্য লিখবে। সত্য লিখবে’।  

ওইটুকুই। আর কখনো কথা হয়নি। হবেও না। সমস্ত কথা, সমস্ত প্রতিবাদের ঊর্ধ্বে চলে গেলেন তিনি। একটা সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা ভাবতাম প্রায়ই। মনে-মনে একটা স্ক্রিপ্টও লিখে রেখেছিলাম। কিন্তু, করি-করি করেও আর করা হলো না সেটা। প্রায়ই মনে পড়লে ভাবতাম, আমি সাক্ষাৎকারটা নেওয়ার আগেই যদি উনি চলে যান। যদি শব্দটা কখনো-কখনো খুব অপ্রাসঙ্গিক কিছু বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, কখনো-কখনো সেটি মৃত্যুর মতো প্রাসঙ্গিকও হয়ে যায়।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০২৩
এমকে/এনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।