ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৯ ফাল্গুন ১৪৩১, ০৪ মার্চ ২০২৫, ০৩ রমজান ১৪৪৬

জাতীয়

উদ্বোধনের প্রহর গুনছে তর্জনী ভাস্কর্য ‘মুক্তির ডাক’

সুজন বর্মণ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৭, ২০২০
উদ্বোধনের প্রহর গুনছে তর্জনী ভাস্কর্য ‘মুক্তির ডাক’

নরসিংদী: ১৯৭১ সালের অনিশ্চয়তায় ভরা দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ উদ্দীপ্ত করে তুলেছিল পূর্ব বাংলার মানুষকে। দিয়েছিল বিপদসংকুল পথে এগিয়ে যাওয়ার পথরেখা।

প্রতিবছর এই দিনটি ফিরে আসে এ দেশের মানুষের স্বাধীনতা আর মুক্তির অফুরান আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে। ২০১৭ সালের অক্টোবরে ইউনেসকো বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে এই ভাষণ এখন বিশ্বের সবার।  

৭ই মার্চের সেই ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের ইতিহাসে প্রথম ও একমাত্র তর্জনী ভাস্কর্য ‘মুক্তির ডাক’   Call for redemption নির্মাণ হচ্ছে নরসিংদীতে।  

মুজিববর্ষ উপলক্ষে নরসিংদী পৌরসভার মেয়র কামরুজ্জামান কামরুলের উদ্যোগে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ওপর নরসিংদী শহরের প্রবেশ মুখে সাহে-প্রতাপ মোড়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তেজদীপ্ত তর্জনী নিয়ে নির্মিত ভাস্কর্যটি উন্মোচনের অপেক্ষায় দিন গুনছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সাবেক ছাত্র ভাস্কর অলি মাহমুদ ভাস্কর্যের নকশা (মডেল) প্রণয়ন থেকে শুরু করে মূল ভাস্কর্য নির্মাণে সার্বিক কর্মসম্পাদন করেছেন। ৪১ ফুট উচুঁ ভাস্কর্যটি বিশ্বের হাত 
ভাস্কর্যের মধ্যে উচ্চতার দিক থেকে অন্যতম। ১৪ মাস আগে শুরু করা ঐতিহাসিক এই ভাস্কর্যটির কাজ অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারির কারণে এটির সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। তর্জনী ভাস্কর্যটির সম্ভাব্য নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ৪২ লাখ টাকা।

ভাস্কর অলি মাহমুদের বিশ্বাস, এই তার্জনীর নিচে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে উপলব্ধি করলে স্বীয় জাতি, ঐতিহ্য আর গৌরবময় সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি নিজের মধ্যে ভেসে উঠবে।  
 
ভাস্কর অলি মাহমুদ জানান, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একই সূত্রে গাঁথা। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশে বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার যে ডাক দিয়েছিলেন সেই বলিষ্ঠ তর্জনীর ইশারায় সেইদিন সমগ্র বাঙালি জাতি জেগে উঠেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য। একটি তর্জনী  প্রতিবাদের ভাষা, অত্যাচারী জালিমদের হুঁশিয়ারি করে দেওয়া, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক। একটি তর্জনী, একটি নির্দেশ, একটি যুদ্ধ, একটি জাতির মুক্তি। এই তর্জনীই নতুন প্রজন্মের কাছে একটি নতুন স্বপ্ন। এই তর্জনী এখনও আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে শক্তি যোগায়। আর এই তর্জনী নিয়েই এবার ইতিহাসে সর্বোচ্চ বৃহত্তর বঙ্গবন্ধুর তর্জনী ভাস্কর্য  ‘মুক্তির ডাক’ নির্মিত হয়েছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্যস্ততম স্থান সাহে প্রতাপে।  

ভাস্কর্যটির বেদীর চারপাশে থাকবে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৬র ছয় দফা দাবি, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থ্যান, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো টেরাকোটার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। নানা ধরনের অত্যাধুনিক অপটিক্যাল ফাইবার, হোয়াইট সিমেন্ট, পাথরসহ নানা দ্রব্যাদি দিয়ে নির্মিত ভাস্কর্যটি। লাইটিং, টাইলস, মার্বেল পাথরের বেদীর ওপরে আছে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক তর্জনীটি।

এমন তর্জনী ভাস্কর্য এ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোথাও দৃশ্যমান হয়নি, ইতোমধ্যে মূল ভাস্কর্যটির কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। মূল বেদীর চারপাশে নান্দনিক পানির ফোয়ারা নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও দ্রুতগতিতে ল্যান্ডস্কেপের কাজ চলছে। এর মাঝে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী ভিড় জমাচ্ছে এই ঐতিহাসিক শিল্পকর্মটি দেখতে।

নরসিংদী পৌরসভার মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, বাংলার মাটি ও মানুষের হৃদয়ে যে নামটি চিরস্মরণীয় ও উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো ফুটে আছে তিনি হলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। আমাদের মহান নেতার একটি তর্জনীর ইশারায় আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি, একটি স্বাধীন ভূ-খণ্ড পেয়েছি। আর এই তর্জনী ভাস্কর্য নির্মাণ করতে পেরে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত। আশাকরি আমাদের দেশের জন্য এটি নতুন এক মাইলফলক হয়ে কাজ করবে।

এই তর্জনী ভাস্কর্যের শিল্পী ভাস্কর অলি মাহমুদ বাংলানিউজকে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়, একটি সংগ্রামের প্রতীক। তার একটি তর্জনীর ইশারায় পরাধীন জাতিকে তিনি স্বাধীনতার সুখ লাভ করিয়েছেন। তিনি পৃথিবীতে এঁকেছেন নতুন সীমারেখার মানচিত্র, আকাশে উড়িয়েছিলেন লাল-সবুজের নতুন পতাকা। বঙ্গবন্ধু মানেই শক্তি, উৎসাহ আর প্রেরণা। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। তার অসাধারণ বাগ্মিতা, মানবিকতা, মানুষের প্রতি সহমর্মিতার গুণেই তিনি চির অমলিন। তার ৭ই মার্চের ভাষণ আমাদের শিহরিত করে, অনুপ্রাণিত করে। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার যে ইশারা দিয়েছিলেন সেই বিষয়টি নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার প্রয়াসে ৪১ ফুট উঁচু শিল্পকর্মটির মূল বেদীতে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় স্থান পেয়েছে। মূল ভাস্কর্যটি বঙ্গবন্ধুর তেজদীপ্ত তর্জনীর প্রকাশ পেয়েছে।

তিনি আরো বলেন, আজ থেকে ১৪ মাস আগে ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ শুরু করেছিলাম। ইচ্ছে ছিলো মুজিববর্ষের শুরুর দিনই উদ্বোধন করার। মূল ভাস্কর্যের কাজ ১৭ মার্চের আগেই শেষ হয়েছিলো কিন্তু মাঝখানে মহামারি করোনার কারণে মূল বেদীর চারপাশে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজে স্থবিরতা আসে। এখনো সৌন্দর্য বর্ধনের কাজের কিছু অংশ বাকি আছে। আমার বিশ্বাস এই শিল্পকর্মের মধ্যে দিয়ে একটি নতুন ইতিহাসের জন্ম হবে। আগামী দিনে এমন ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে আরো ব্যাপকভাবে কাজ হবে বলে আশা রাখি।

ভাস্কর অলি মাহমুদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছোট-বড় প্রায় ৩৯টি ভাস্কর্য ও মুর‌্যাল নির্মাণ করেছেন। এর মধ্যে তার উল্লেখযোগ্য কাজ হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছরের ইতিহাসে প্রথম ভাস্কর্য মাস্টার দা সুর্যসেন এর আবক্ষ ভাস্কর্য, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ভৈরবের আগে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের ম্যুরাল বাংলার ঈগল, নরসিংদী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সেবা বৃত্ত, জাগ্রত জাতিসত্ত্বা, লৌহজং উপজেলা কার্যালয়ের সামনে হিমালয়, রায়পুরা কলেজে মহানায়ক ভাস্কর্য।  

এখানে উল্লেখ্য যে পৃথিবীর ইতিহাসে হাত নিয়ে যত শিল্পকর্ম হয়েছে উচ্চতার দিক থেকে এটিই অন্যতম। আর শুধু একটি তর্জনীকে প্রতিপাদ্য করে নির্মাণ করা ভাস্কর্যের মধ্যে এটি সবচেয়ে উঁচু ভাস্কর্য বলে দাবি করছেন ভাস্কর অলি মাহমুদ।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০২০
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।