ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

পিলখানা হত্যাকাণ্ড: মিথ্যা সাক্ষ্য না দেওয়ায় ১৬ বছর খাটতে হলো জেল 

ইমতিয়াজ আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫
পিলখানা হত্যাকাণ্ড: মিথ্যা সাক্ষ্য না দেওয়ায় ১৬ বছর খাটতে হলো জেল  ইলিয়াস শিকদার।

মাদারীপুর: দীর্ঘ ১৬ বছর লোহার গরাদের বন্দি জীবন শেষে বাড়ি ফিরেছেন বিডিআর (বিজিবি) সুবেদার মো. ইলিয়াস শিকদার। বাড়ি ফিরে চিনতে পারেননি পথঘাট।

খুঁজে পাননি নিজের ঘরও। বাড়ির আঙিনার পাশেই নদী শাসন বাঁধ। বয়ে চলা আড়িয়াল খাঁ নদ। এমনকি ১৬ বছরের বন্দিজীবন শেষে চিনতে পারেননি নিজের ছোট সন্তানকেও।

মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার শিরুয়াইল ইউনিয়নের পশ্চিম কাকৈর এলাকার মৃত তমিজ উদ্দিন শিকদারের ছেলে বিডিআর সুবেদার মো. ইলিয়াস শিকদার বাড়ি ফিরেছেন গত ২৩ জানুয়ারি। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর ২০১০ সালের ১০ মার্চ মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে না চাওয়ায় জেলে যেতে হয় তাকে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হলেও শুধু মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে না চাওয়ায় বিস্ফোরক মামলায় আটকে রাখা হয় তাকে। এরপর কেটে যায় ১৬ বছর। তছনছ হয়ে যায় সংসার। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর গত ২৩ জানুয়ারি বিডিআরের কারাবন্দি থাকা ১৭৮ জন মুক্তি পান। এর মধ্যে শিবচরের ইলিয়াস শিকদার একজন।

সরেজমিনে বৃহস্পতিবার তার বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে, ইটের আধাপাকা সড়কের পাশে পায়ে হাঁটা একটি পথ, সে পথ দিয়েই যেতে হয় ইলিয়াস শিকদারের বাড়ি। পাশেই আড়িয়াল খাঁ নদ। ইলিয়াস শিকদারের বাড়ি মূলত এখন নদের মধ্যে। গত চার বছর আগে পুরো বাড়ি, ফসলি জমি নদের ভাঙনের কবলে পরে। এরপর নদের পাড়েই ছোট করে একটা ঘর তুলে থেকেছেন ইলিয়াস শিকদারের স্ত্রী হাওয়া বেগম। এর পাশেই বড় ছেলের ঘর। এখন থাকছেন ছেলের সঙ্গে। দীর্ঘ ১৬ বছর কারাবন্দি থেকে শরীরে বসত বেঁধেছে নানান রোগব্যাধীও। কমে গেছে শক্তি।

জানতে চাইলে বিডিআরের সুবেদার ইলিয়াস শিকদার বলেন, পিলখানার ঘটনার দিন আমি পিলখানার ভেতরে ছিলাম। দরবার হলে তখন আয়োজন চলছে। আমার দায়িত্ব ছিল একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে
 (নাটক) দেখভালের। এরই মধ্যে শুনি গুলির শব্দ। আমরা আর ওখান থেকে বের হইনি। আমরা বিডিআরের যে সদস্যরা অন্যত্র ছিলাম পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার কাজে যোগ দেই। এ ঘটনায় ২০১০ সালে আমাদের সাক্ষী দিতে বলে। কিন্তু আমরা যা দেখিনি, তার সাক্ষী কীভাবে দেব? মিথ্যা সাক্ষী না দেওয়ায় আমাকেসহ অনেককেই জেলে পাঠানো হয়।

বিডিআরের সাবেক এই সুবেদার বলেন, এক সময় সংসারে সচ্ছলতা ছিল, স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেছে। এখন বর্তমান সরকারের কাছে আবেদন জানাই, আমাদের চাকরি পুনঃবহালসহ অবসরকালীন সুবিধা, রেশন সুবিধা যেন দেয়। তাহলে সব হারিয়েও শেষ সময়ে এসে বাঁচতে পারবো। '

সুবেদার ইলিয়াস শিকদারের স্ত্রী হাওয়া বেগম বলেন,'আমার স্বামীকে যখন জেলে নেয়, এরপর ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমি দুঃখের সাগরে পড়ি। হঠাৎ করে চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে আমার! আমার ভাই, পাড়াপ্রতিবেশীরা আমাকে নানা ভাবে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু অর্থাভাবে আমার সন্তানেরা ঠিকমতো লেখাপড়া করতে পারেনি। আমি ঠিকমতো খাবার দিতে পারিনি। এত বছরে ঈদ বলতে আমাদের কিছু ছিল না। তবে আমার স্বামী মুক্ত হয়ে বাড়ি এসেছে, আমি আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া জানাই।

তিনি আরও বলেন, স্বামী জেলে গেল। এদিকে আড়িয়াল খাঁ নদীতে বাড়িঘর, জায়গা-জমি সব গেছে। নদীর পাড়েই ছোট করে ঘরে তুলে থাকি আমরা। আমাদের ১৬ বছরের কষ্টের কথা বলে শেষ করা যাবে না!

১৯৭৬ সালে সৈনিক হিসেবে বিডিআরে যোগদান করেন শিবচরের ইলিয়াস শিকদার। ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেয়ে ২০০৭ সালে সুবেদারে উন্নীত হন। ২/৩ বছর পরেই অবসর জীবনে যাওয়ার কথা ছিল তার। এরমধ্যে পিলখানা হত্যার ঘটনায় থমকে যায় তার জীবনও। মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে না চাওয়ায় কারাবন্দি হন। দীর্ঘ ১৬ বছর পর বাড়ি ফিরেছেন তিনি। রোগ-শোক আর অর্থ কষ্ট থাকলেও স্ত্রী-সন্তানদের ছুঁয়ে দেখতে পারছেন, এটাই জীবনের শেষ সময়ের বড় প্রাপ্তি বলে জানান ইলিয়াস শিকদার।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।