ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বিলুপ্তপ্রায় জলজ উৎসব ‘পলো বাওয়া’ 

ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০২৪
বিলুপ্তপ্রায় জলজ উৎসব ‘পলো বাওয়া’  শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরে সম্মিলিতভাবে পলা দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য

মৌলভীবাজার: আমাদের গ্রাম-বাংলার প্রায় হারিয়ে যাওয়া একটি উৎসবের নাম ‘পলো উৎসব’। কেউ কেউ আবার ‘পলো বাওয়া উৎসব’ বলে থাকেন।

এটি গ্রামীণ বাংলার চিরায়ত সৌন্দর্য। যেখানে সম্মিলিত মানুষ মনের আনন্দ নিয়ে মাছ ধরার উদ্দেশে হাঁটু পানিতে নামেন।  

আগে এ উৎসব সচরাচর দেখা গেলেও বর্তমানে খুব একটা চোখে পড়ে না। বর্তমানে এটি কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে। হাইল-বিল বা বিস্তীর্ণ জলাশয় ঘিরে মাছ ধরার পলো উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। অংশ নেন হাজারো মানুষ।

সকালে হাজারো মানুষের ঢল নামে হাওরের বুকে। কারো হাতে পলো, কারো হাতে জালসহ মাছ ধরার বিভিন্ন উপকরণ। দূরদূরান্ত থেকে হেঁটে আনন্দ-ফুর্তি করতে করতে মাছ ধরার উৎসবে এসেছেন নানা বয়সী মানুষ। উৎসবে কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও অংশ নেন।

বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) বিলুপ্তির পথে গ্রামীণ এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভুনবীর ইউনিয়নের জৈতাছড়ার আগে হাইল হাওরে আয়োজন করা হয়েছিল পলো বাওয়া উৎসব। শেষ হয় দুপুর ১টা থেকে দেড়টার দিকে। আশপাশের গ্রামের কয়েকশ’ শৌখিন মাছ শিকারি অংশগ্রহণ করেছিলেন এ জলজ উৎসবে।

সকাল থেকে উপজেলার ভুনবীর ইউনিয়নের জৈতাছড়ার হাইল হাওরের একটি বিলে শুরু হয় পলো বাওয়া। দল বেঁধে লোকজন বিলের মধ্যে পলো হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শুরু হয় মাছ ধরার প্রতিযোগিতা। এ উৎসবের মধ্য দিয়েই স্থানীয়রা জানান দিল পুরোনো সংস্কৃতির। সকাল থেকে মনের আনন্দে পলো বাওয়া উৎসবে যোগ দেন উপজেলার ভুনবীর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের শত শত মানুষ।

এ উৎসবে যোগ দিতে ছেলে-বুড়োসহ প্রায় শতাধিক ব্যক্তি ছুটে আসেন হাইল হাওরের বিলে। কারও হাতে পলো, ছিটকি জাল, উড়াল জাল, লাঠি জাল, হাত জাল অর্থাৎ ঠেলাজাল। দল বেঁধে কয়েক গ্রামের কিশোর, যুবকসহ বৃদ্ধরাও অংশগ্রহণ করেন এ পলো উৎসবে। তবে পলো বাওয়া উৎসবের আনন্দ যুবক-বৃদ্ধের চেয়ে ছোট ছোট শিশুদের মধ্যে একটু বেশিই দেখা যায়। তারা তাদের বাবা-চাচা-দাদা-মামা-ভাইয়ের হাত ধরেই উৎসবে শরিক হতে এসেছে।

খুব ভোরেই আদমপুর বিলে হইহুল্লোড় করে একসঙ্গে পলো-জাল হাতে মাছ শিকারে নেমে পড়েন সবাই। ‘ঝপ ঝপ’ শব্দের তালে চলতে থাকে পলো বাওয়া। কয়েক ঘণ্টার এ উৎসবে আশপাশের গ্রামের নানা বয়সের লোকজন, শিশু থেকে বৃদ্ধ যে যার মতো পলো বাওয়া উৎসবে মেতে ওঠেন। বিলের মধ্যে নানা বয়সের মানুষ মাছ ধরতে নামলে তাদের মাছ ধরা দেখতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন গ্রামের নারীরাও। কেউ আবার জাল থেকে মাছ ধরে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। এ সময় তাদের হাতে নানা প্রজাতির মাছ দেখা যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আয়োজক বাংলানিউজকে বলেন, এতদিন তো এ পুরো হাইল হাওর আওয়ামী লীগের নেতাদের দখলে ছিল। এরা সাধারণ মৎস্যজীবীদের কিছুতেই হাওরে নামতে দিত না। বেঁচে থাকার দায়ে লুকিয়ে বিলে নামলেই সাধারণ মৎস্যজীবীদের হামলা-মামলা দিয়ে আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। এখনও তাদের হুমকি-ধামকি অব্যাহত আছে। তবে সময় বদলেছে। ক্ষমতাসীন দলের দুস্কৃতকারীরা এখন এলাকায় নেই। তাই আমরা হুমকি-ধামকি উপেক্ষা করে এ উৎসবের আয়োজন করলাম। আমাদের নতুন প্রজন্ম দেখুক আমাদের সংস্কৃতির এ বিশেষ দিকটি।

তিনি আরও বলেন, স্থানীয় প্রশাসনের আন্তরিকতা থাকলে উন্মুক্ত জলাশয়ে কারেন্ট জাল বা চায়না দুয়ারি দিয়ে দেশীয় মাছের বংশানুক্রম ধ্বংস করতে পারতো না। কিন্তু প্রশাসন আন্তরিকতা না বাড়ালে একসময় দেশীয় মাছ চায়না জাল, কারেন্ট জালের বুকে বিলীন হয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে গ্রামীণ ঐতিহ্য পলো দিয়ে মাছ শিকারের মতো নানা উৎসবও।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০২৪
বিবিবি/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।