ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

তীব্র ভাঙনেও পদ্মায় চলছে বালু উত্তোলন, হুমকিতে বসতবাড়িসহ ফসলি জমি

এ কে এস রোকন,  ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০২৪
তীব্র ভাঙনেও পদ্মায় চলছে বালু উত্তোলন, হুমকিতে বসতবাড়িসহ ফসলি জমি

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: তীব্র ভাঙনের মধ্যেও পদ্মা নদীর পাড় ঘেঁষে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলায় চলছে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের মহোৎসব। এতে ভাঙনের হুমকিতে পড়েছে প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত নদী রক্ষা বাঁধসহ মোহনা পার্ক, কয়েক হাজার বিঘা ফসলি জমি, বসতবাড়ি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

 

স্থানীয়দের দাবি, দ্রুত বালু উত্তোলন বন্ধে দুই দফা আন্দোলন করেও প্রশাসনের টনক নড়েনি। তবে বাঁধ, পার্ক ও ফসলি জমি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় বালু উত্তোলন বন্ধ রেখে তদন্ত শুরু করা হয়েছে বলে দাবি স্থানীয় প্রশাসনের।

সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নিয়ম-নীতি ও আইন অমান্য করে পদ্মার পাড় ঘেঁষেই ভারতীয় সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জের রানীনগর-দুর্লভপুর এলাকায় তোলা হচ্ছে বালু। এই বালু উত্তোলনের কারণে ইতোমধ্যে বিলীন হয়েছে হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি ও বসতবাড়ি। ভাঙনের কবলে নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে সদর উপজেলার আলাতুলী ইউনিয়নের প্রায় অর্ধেক এলাকা। ঘরছাড়া হয়েছে হাজারও মানুষ। সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মার বামতীর সংরক্ষণ প্রকল্পের বাঁধের কিছু অংশ ইতোমধ্যেই ভেঙে গেছে। এমন অবস্থাতেও বন্ধ হয়নি নদীর পাড় ঘেঁষে এই বালু উত্তোলন।

এদিকে স্থানীয়দের অভিযোগ আবাসিক এলাকায় পদ্মার পাড়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ডে অভিযোগ দিলেও মেলেনি সুরাহা। উল্টো বাধা দিতে গিয়ে স্থানীয়দের হুমকি ও ভয়ভীতি দেখায় বালু উত্তোলনকারীরা।  

বাঁধ রক্ষা ও মোহনা পার্ক সংলগ্ন স্থানে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধের দাবিতে সর্বশেষ ১৬ অক্টোবর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার চরাঞ্চলের চর-আলাতুলি, দেবিনগর ও শাহজাহানপুর ইউনিয়নের সাধারণ মানুষ। তিনটি ইউনিয়নের ৫ শতাধিক জনসাধারণের দাবি ভাঙন ঠেকাতে আগামীতে বালু মহল ইজারা প্রদান বাতিল, সাত দিনের মধ্যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ ও এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা, অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান, যারা অন্যায় কাজে বাধা দিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন তাদের হয়রানি বন্ধ করে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি হুমকিদাতাদের তদন্ত সাপেক্ষ শাস্তি নিশ্চিত করা এবং ভুক্তভোগীদের সর্বত্র সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এরপরও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।

শাহজাহানপুর ইউনিয়নের পদ্মাপাড়ের স্থানীয় বাসিন্দা আফসারুল আলম জানান, নদীর ধারে বালু উত্তোলনের কারণে বাঁধের নিচে গর্ত তৈরি হচ্ছে। ফলে সরে যাচ্ছে বাঁধের ব্লক। বাঁধ ভেঙে ইতোমধ্যে বিলীন হয়েছে ঘরবাড়ি।

একই এলাকার মাওলানা কাউসার আলী জানান, নদীর ধারে ২০২১ সালে সরকারিভাবে নির্মিত মোহনা পার্কও রয়েছে ভাঙনের কবলে পড়ার শঙ্কায়। বালু উত্তোলনের ফলে ভাঙনের আশঙ্কায় আমরা আতঙ্কিত হলেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

রানীনগর গ্রামের শফিকুল ইসলাম জানান, গত ৯ সেপ্টেম্বর স্থানীয়দের পক্ষ থেকে যৌথবাহিনীকে বালু উত্তোলনে জড়িত ৬ জনের পরিচয় উল্লেখ করে একটি অভিযোগ দেওয়ার পরও বালু উত্তোলন চলছেই।

একই গ্রামের আব্দুর রাকিব জানান, এক জায়গা ইজারা নিয়ে অন্য জায়গায় বালু উত্তোলন করছে। এতে করে আলাতুলি ইউনিয়নের প্রায় অর্ধেক এলাকা ইতোমধ্যেই বিলীন। সব হারিয়ে আমরা কৃষকরা আজ নি:স্ব। অথচ এর কোনো প্রতিকার নেই।

বৃদ্ধ নবীর আলীর প্রশ্ন সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার বাঁধ বাঁচানো জরুরি না সরকারের সোয়া ৫ কোটি টাকার আয় জরুরি।

সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মো. মোখলেসুর রহমান জানান, সর্বশেষ এক মাস আগে বালুমহাল ইজারা বাতিল ও অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করে ফসলি জমি ও বসত-ভিটা রক্ষার জন্য বালু উত্তোলন বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়। এছাড়া ৬ দফা দাবিতে স্মারকলিপি দেওয়ার পরও বালু উত্তোলন অব্যাহত আছে। যা দুঃখজনক।

অভিযুক্ত বালু উত্তোলনকারী মো. বকুল হোসেন দাবি করেন, প্রায় ১৬ বছর আগে জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্টরা হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের মাধ্যমে রানী নগর এলাকাটি সিলেক্ট করে দীর্ঘদিন ধরে ইজারা দিয়ে আসছে। সে আলোকে দাদু ভাই কনস্ট্রাকশনের পক্ষে আমি চলতি বাংলা ১৪৩১ সালে ১ বছরের জন্য ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা প্রদানের মাধ্যমে এক বছর বালু উত্তোলনের অনুমোদন পেয়েছি। সে মোতাবেক আমরা সরকারি নীতিমালা অনুসরণ করে ঢাল প্রসেস পদ্ধতিতে বৈধ বালু মহল ইজারা নিয়ে বালু উত্তোলন করছি।

বালু উত্তোলনের কারণে নদীতে ভাঙন প্রসঙ্গে তার দাবি, জনগণের সম্মতিতে সরকারের দেখানো লাল পতাকা বসানো স্থানে  বাঁধের বিপরীতে ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষে বালু উত্তোলন হচ্ছে। তাই ভাঙনের বিষয়টি তাদের বিবেচ্য নয়।

এ ব্যাপারে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা তাছমিনা খাতুন জানান, স্থানীয়দের অভিযোগ পেয়ে তদন্তকাজ শুরু করা হয়েছে। জনস্বার্থ বিঘ্ন করে এবং ফসলি জমি, রক্ষা বাঁধ, পার্ক হুমকিতে থাকলে বালু উত্তোলন বন্ধের আশ্বাস দেন তিনি।

তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম আহসান হাবিব বালু উত্তোলনের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে জানান, বাঁধে কিছুটা ভাঙন দেখা দিয়েছে। বাজেট প্রাপ্তি সাপেক্ষে ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, চলতি বছরে ভারত থেকে আসা ঢলে পদ্মা নদীতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার প্রায় ৬ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।