ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ফরিদপুরে ‘নিরুদ্দেশ’ এক পরিবারের ৪ জন, আলোচনায় ‘বিশেষ চক্র’

হারুন-অর-রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪
ফরিদপুরে ‘নিরুদ্দেশ’ এক পরিবারের ৪ জন, আলোচনায় ‘বিশেষ চক্র’

ফরিদপুর: ফরিদপুরের একটি পরিবারের চারজন ‘নিরুদ্দেশ’ হয়ে গেছেন। ‘নিরুদ্দেশ’ হয়েছিলেন আরও দুই কিশোরী।

তবে আইনের আশ্রয় নিয়ে তাদের ফিরিয়ে এনেছে পরিবার। এভাবে ‘নিরুদ্দেশ’ হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে সামনে এসেছে একটি ‘বিশেষ চক্র’। স্থানীয়দের অভিযোগ, চক্রটি ধর্মান্তকরণের মিশন নিয়ে কাজ করছে। তারা অনেককে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

যে পরিবারের চারজন ‘নিরুদ্দেশ’, তারা ফরিদপুর জেলা সদরের ঈশানগোপালপুর ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা। এরা হলেন- দুর্গাপুর গ্রামের তমিজদ্দিন বেপারীর ছেলে আলমগীর বেপারী (৪৫) ও তার স্ত্রী আম্বিয়া বেগম (৪০), দুই ছেলে সিয়াম বেপারী (২২) ও সোহান বেপারী (১৪)।

বেপারী পরিবারের দাবি, একটি চক্রের ফাঁদে পড়ে ধর্মান্তরিত হয়েছেন চারজন। এছাড়া ওই গ্রামের আরও কয়েকজনকে ফাঁদে ফেলে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চক্রটি।  

চক্রটি জেলা সদরের নর্থচ্যানেল ইউনিয়ন, মধুখালী, সদরপুর, চরভদ্রাসন ও ভাঙ্গায়ও তাদের মিশনের প্রচারণা চালিয়েছে বলে স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে। তারা হতদরিদ্র ও নিম্নশ্রেণির মানুষকে অর্থের লোভ-লালসা দেখিয়ে তাদের দলভুক্ত করে থাকে।  

বিষয়টি নিয়ে বৃদ্ধ তমিজদ্দিন বেপারী (৬৫) বলেন, আলমগীর তার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দুই থেকে তিন বছর আগে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। তখন তাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়ভাবে কয়েকবার সালিশও হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর একদিন পুলিশ ও ওই চক্রের ২৪ জনকে নিয়ে তারা আমার বাড়িতে আসে। তারা প্রত্যেকে সাদা কাপড় পরা ছিল। পরে একই দিন সালিশ বৈঠকে আমি বলেছিলাম, তোমরা ওই ধর্ম ছেড়ে চলে আসো তাহলে বাড়িঘর সবই পাবে। এরপর থেকে তারা নিরুদ্দেশ।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে খ্রিস্টান হয়ে গেছেন বলে তাদের কাছে শিকার করেছেন আলমগীর। সালিশের দিন আলমগীরের ঘর থেকে খ্রিস্টান ধর্মের বিভিন্ন বই উদ্ধার করে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে যাওয়া হয়।

তমিজদ্দিন বেপারীর নাতনি অর্থাৎ একই গ্রামের আইয়ুব আলীর কিশোর মেয়ে ওই চক্রের ফাঁদে পড়ে বাড়ি থেকে চলে যায়। পরে তার মা রওশন আরা (৪২) বাদী হয়ে ফরিদপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। ওই কিশোরী এখন ফরিদপুর শিশু সংশোধনাগারে রয়েছে।

নেপথ্যে কে-কারা
জানা যায়, ফাঁদে ফেলে ধর্মান্তরকণের এই চক্রের মূল ব্যক্তি হিসেবে কাজ আলোচনায় আসছে রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দের নূরা পাগলার ছেলে মেহেদী নূরতাজের। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের নাম লিখেছেন নূরতাজ নোভা। তার কর্মকাণ্ডের বিষয়টি জানাজানি হলে নূরতাজের বাবা বাড়ি থেকে তাকে তাড়িয়েও দেন বলে জানা গেছে। বর্তমানে ঢাকায় বসে ঈসা (আ.)-এর ধর্মের নামে কার্যক্রম চালাচ্ছেন তিনি। এক্ষেত্রে তার বাবার নামে দরবার শরিফ বানিয়ে মানুষকে ভক্ত-অনুসারী বানাচ্ছেন। তার অনুসারী হিসেবে দুর্গাপুর গ্রামের আম্বিয়া বেগম ও শরিফুল ইসলাম বাবু ওরফে ঐন্দ্রিস নোভাসহ বিভিন্ন এলাকার ২৪ জন ব্যক্তি এসব কার্যক্রম চালাচ্ছেন।

সম্প্রতি নূরতাজ নোভা নামে ওই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে বিভিন্ন ধরনের ছবি ভাইরাল হয়। যা আলোচনার জন্ম দেয়। সেখানে দেখা যায়, তারা বাউলবেশে চলাচল করেন এবং অনেক সময় গ্রুপ ধরে বিভিন্ন গ্রামে গানের আসরের নামে অবস্থান করেন। তারা নারী-পুরুষ দলবদ্ধভাবে ঘোরেন এবং সবাই সাদা পোশাক পরে প্রচারণা চালিয়ে থাকেন।  

দুুর্গাপুর গ্রামের সেই কিশোরীর মা রওশন আরা বলেন, আমার ভাবি (আম্বিয়া) ছিলেন নূরতাজ নোভার ভক্ত। আমাদের কাছে এসে একদিন গল্প করে বলেন, আমরা ২৪ জনকে নিয়ে চট্টগ্রামে খ্রিস্টানদের একটি চার্চে গিয়ে এসব শিখেছি। তাদের সঙ্গে শরিফুল ইসলাম বাবুও চট্টগ্রামে যান। এরপর ফিরে এসে ৪০ দিন উপোস ছিলেন। তখন শুধু পানি আর ফল খেয়ে থাকতেন তারা। এরপর থেকে আমাদের ভালো ভালো কথা বলতেন এবং অনেক কিছু শেখাতেন। এরপর থেকে তারা সবাই ভাঙ্গায় আলমগীর নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে মাঝে মধ্যে চার-পাঁচদিন করে অবস্থান করতেন। একদিন সবাই মাথার চুলও কেটে ফেলেন। এরপর তারা খ্রিস্টান ধর্ম পালনের বিষয়ে কথা বলেন।

রওশন আরও বলেন, গত রমজান মাসে আমার মেয়েকে বুঝিয়ে একটি মাইক্রোবাসে করে তারা নিয়ে যায়। এরপর থেকে আমার মেয়েও তাদের সঙ্গে খ্রিস্টান ধর্ম পালন করতে থাকে। আমার মেয়ে এখন আমাদেরই চেনে না।

ফাঁদে পড়েছিল আরেক কিশোরী, ফিরেছে ঘরে
এভাবে ধর্মান্তকরণের প্রচারণা চলছে বলে স্থানীয় আরও অনেকে অভিযোগ করেছেন। ওই চক্রের ফাঁদে পড়ে আরও এক কিশোরীও ধর্মান্তরিত হতে উৎসাহিত হয়েছিলেন। পরে ওই কিশোরী ফিরে আসেন। তার মা বন্যা বেগম বলেন, আমার মেয়ে মাঝে মধ্যে বলতো খ্রিস্টান ধর্ম ভালো। তখন তাকে বিভিন্নভাবে আমি বোঝাতাম, কিছুদিন হলো সে ওই পথ থেকে ফিরে এসেছে।

আব্দুল করিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, তারা আমাদের সঙ্গে নামাজ পড়তো না, নামাজ পড়ার কথা বললে বলতো, আমরা রোববারে প্রার্থনা করি। একদিন আলমগীর আমাকেও বলে, আমরা খ্রিস্টান ধর্ম পালন করি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় মসজিদের ইমাম বলেন, তাদের চালচলন ও কালচার স্পষ্ট খ্রিস্টানদের মতো। বিষয়টি বুঝতে পেরে স্থানীয় হুজুররা শরিফুল ইসলামকে ডাকেন। সেখানে ভুল স্বীকার করে তওবাও করেন তিনি। এভাবে দুইবার তওবা করেন। কিন্তু আবারও সেই একই কাজে ফিরে যান শরিফুল।

স্থানীয়রা জানান, কথিত দরবার শরিফ খুলে সাধারণ জনগণকে ঈসা নবীর উম্মত হওয়ার দীক্ষা দেওয়ার আড়ালে খ্রিস্টান বানাচ্ছে একটি চক্র। এক্ষেত্রে তারা মানুষের দারিদ্র্যকে পুঁজি করছে। তাদের অপতৎপরতায় অনেকে ধর্মান্তরিত হয়েছেন এবং অনেকেই ঘর বাড়ি স্বামী/স্ত্রী বা বাবা, মা পরিবার ত্যাগ করে খ্রিস্টানদের গোপন আশ্রমে চলে গেছে। তাদের কর্মসংস্থানসহ যাবতীয় দায়িত্ব মিশনারিদের পক্ষ থেকে নেওয়া হচ্ছে বলেও কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে শরিফুল ইসলাম বাবু ওরফে ঐন্দ্রিস নোভার বাড়িতে গেলে কথা হয় তার মায়ের সঙ্গে। তার মা মেঘলা বেগম বলেন, আমার ছেলে নূরা পাগলার বাড়িতে যেত। কিন্তু কখনো তেমন কিছু দেখিনি।

শরিফুল ইসলাম বাবু ওরফে ঐন্দ্রিস নোভা বলেন, সম্মানিত আলেম-ওলামা ভাইদের সঙ্গে সমসাময়িক বিতর্কগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। আমরা কেউ খ্রিস্টান না, সবাই মুসলমান। চলাফেরা করতে গিয়ে কিছু বিষয় আলেম-ওলামাদের দৃষ্টিতে একটু ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছিল, যা আলোচনার মধ্য দিয়ে সেই ধোঁয়াশার অবসান ঘটে।

দারিদ্র্যকে পুঁজি করে হতদরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষকে টার্গেট করে অর্থবিত্তের লোভ দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে ধর্মান্তকরণ চক্রের ব্যাপারে জানতে চাইলে আইনজীবী ইমরান হোসেন রিম বাংলানিউজকে বলেন, এ চক্র ইসলাম ধর্ম থেকে ইতোমধ্যে ৫-৭ জনকে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করেছে। তারা হতদরিদ্র, গরিব ও অসহায়দের টার্গেট করে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করছে। এমন একটি ঘটনার একটি মামলা ফরিদপুরের আদালতে চলমানও রয়েছে। যে মামলার শুনানি আগামী ১০ অক্টোবর ধার্য করা হয়েছে।

যা বলছে পুলিশ-প্রশাসন
এ ব্যাপারে জানতে চাইলেও ফরিদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তামান্না তাসনীম কোনো মন্তব্য করেননি।

তবে ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. ইয়াসিন কবীর বলেন, এভাবে ধর্মান্তরিত করার কোনো ঘটনা এ পর্যন্ত আমাদের কেউ জানাননি কিংবা লিখিত অভিযোগও কেউ দেননি। কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ফরিদপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আব্দুল জলিল বাংলানিউজকে বলেন, বিষয়টি আমাদের নলেজে আছে। এ সংক্রান্ত একটি মামলাও হয়েছে। আমরা এ সংক্রান্ত আরও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।