ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আদ্যোপান্ত

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৮
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আদ্যোপান্ত ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা।

ঢাকা: ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হালানো হয়। এতে আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ প্রাণ হারান ২৪ জন। অল্পের জন্য বেঁচে যান শেখ হাসিনা।

এ ঘটনায় দায়ের হওয়া দুই মামলার দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর পর বিচার প্রক্রিয়া শেষে বুধবার (১০ অক্টোবর) রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেছেন আদালত। পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এ রায় দেওয়া হবে।

কী ঘটেছিলো সেদিন। পাঠকদের জন্য ভয়াবহ সেই ক্ষণ থেকে রায় পর্যন্ত তুলে ধরা হলো-

ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা

বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে দলটির উদ্যোগে সমাবেশ চলছিলো। সমাবেশের প্রায় শেষ পর্যায়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

একটি ট্রাকের ওপর তৈরি অস্থায়ী মঞ্চে তিনি বক্তব্য দেওয়ার সময় তাকে ঘিরে পাশে ছিলেন দলীয় নেতারা। সামনে ছিলেন হাজার হাজার নেতাকর্মী। বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ হয়।

ঘটনাস্থলে থাকা ফটো সাংবাদিক জিয়াউল ইসলাম বলেন, ‘এমন নৃশংসতা কখনো হতে পারে আমার কল্পনাতেও ছিলো না। আমি মঞ্চেই ছিলাম। চেয়ারে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলাম। হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। হুড়োহুড়ি আর ধাক্কায় চেয়ার থেকে নিচে পড়ে যাই। আমার ওপরে পড়ে অনেকে। হঠাৎ ট্রাকের পাটাতনের ফাঁকে চোখে পড়লো একটা গ্রেনেড। ’

‘সেটি বিস্ফোরিত হলে কি হতো ভাবতেই শিউরে উঠি এখনো। শেখ হাসিনা কয়েক হাত দূরে। তাকে ঘিরে মানব ঢাল তৈরি করেছেন দলের নেতারা। গ্রেনেডের শব্দ শেষে শুরু হলো গুলির শব্দ। এক পর্যায়ে উঠে দাঁড়াই এবং গুলি থামলে ট্রাক থেকে নেমে আসি। নামার পর যা দেখি সেটি আরেক বিভীষিকা। চারদিকে আর্তনাদ, আহত মানুষের গোঙ্গানি। রক্তাক্ত পড়ে আছে বহু নারী-পুরুষ। কে জীবিত কে মৃত বোঝা মুশকিল। নিজে বেঁচে আছি বুঝতে পেরে আবার ক্যামেরার শাটারে ক্লিক করতে আরম্ভ করি। ’

এ হামলায় অল্পের জন্যে বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিনের সেই গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং আহত হন কয়েকশ নেতাকর্মী। এর মধ্যে এখনও অনেকে দুঃসহ সেই ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন।

হামলার ঘটনায় পৃথক তিন মামলা

ভয়াবহ এ গ্রেনেড হামলার পরদিন অর্থাৎ ২২ আগস্ট মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এ মামলাটির প্রথমে তদন্ত শুরু করে থানা পুলিশ।

পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ হয়ে তদন্তের দায়িত্ব গড়ায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে। অবশ্য এর মধ্যে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুল জলিল ও আওয়ামী লীগ সাবের হোসেন চৌধুরী আরও দু’টি মামলা করেছিলেন। পরে এসব মামলা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।

এদিকে ২০০৪ সালের ২২ আগস্ট বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে সরকার। মাত্র এক মাস ১০ দিনের মাথায় ওই বছরের ২ অক্টোবর কমিশন সরকারের কাছে ১৬২ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিশনের সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণ সন্দেহাতীতভাবে ইঙ্গিত করে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পেছনে একটি শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত।

‘অভিযানটি পরিচালনা করা হয় ভাড়া করা দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে। এসব লোক প্রধানত একটি সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারদের মধ্য থেকে অংশ নেয়। ’ তবে ওই প্রতিবেদনে বিদেশি শক্তি বলতে কোনো দেশের নাম উল্লেখ করা হয়নি।

আলোচিত জজ মিয়া ‘নাটক’

ভয়াবহ এ হামলা মামলার তদন্তের এক পর্যায়ে ২০০৫ সালের ৯ জুন জজ মিয়াকে আটক করা হয়। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলার সেনবাগের একটি চায়ের দোকান থেকে তাকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে নেওয়া হয় সেনবাগ থানায়।

পরবর্তীতে সিআইডি পুলিশের হেফাজতে থাকার পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের গ্রেনেড হামলা মামলায় তিনি ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ দিয়েছেন বলে জানায় পুলিশ। পরে ফাঁস হয়ে যায় ‘জজ মিয়ার বিষয়টি পুলিশের সাজানো নাটক। ’

এ নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনা সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে নানা ঘটনাপ্রবাহের পর ২০০৮ সালে জজ মিয়াকে আসামির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। পরে আদালত এ মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেন। ২০০৯ সালে মুক্তি পান জজ মিয়া।

২০০৮ সালের জুনে প্রথম অভিযোগপত্র

দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১১ জুন মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন সিআইডির জ্যেষ্ঠ এএসপি ফজলুল কবির।

২০০৯ সালের ৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন। এরপর মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আখন্দ।

তিনি ২০১১ সালের ৩ জুলাই বিএনপি নেতা তারেক রহমানসহ ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ৫২ জনের বিরুদ্ধে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দু’টি অভিযোগপত্র দেন।

সম্পূরক চার্জশিট

গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক চার্জশিট (অভিযোগপত্র) জমা দেয় সিআইডি। এতে নতুন করে ৩০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

এর আগের চার্জশিটে ২২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। নতুনভাবে অভিযুক্তদের মধ্যে স্থান পাওয়া উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছেন- বিএনপির তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ।

তবে মানবতাবিরোধী মামলায় জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং অন্য মামলায় জঙ্গি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান ও জেএমবি সদস্য শহিদুল আলম বিপুলের মৃত্যুদণ্ড ইতোমধ্যে কার্যকর হওয়ায় এ মামলা থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে এ মামলার আসামি সংখ্যা ৪৯। এর মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৮ জন পলাতক রয়েছেন। বাকি আসামিদের মধ্যে কারাগারে আছেন ২৩ জন এবং জামিনে ছিলেন ৮ জন। জামিনে থাকা আটজনের জামিন গত ১৮ সেপ্টেম্বর বাতিল করে আদালত।

সাত বছরে ৬ তদন্ত কর্মকর্তা

গ্রেনেড হামলার পর পুলিশের একটিসহ মোট তিনটি মামলা করা হয়। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তদন্ত শুরু হয়,  যদিও কোনো প্রতিবেদন দাখিল হয়নি।

এর মধ্যে প্রথম সাত বছরের মোট ছয়বার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়। এরপর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে নতুন তদন্তে সিআইডির এএসপি ফজলুল কবীর ২০০৮ সালের ১১ জুন অভিযোগপত্র জমা  দেন।

পরবর্তীতে ১৩ দফা সময় বাড়িয়ে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ।

‘শেখ হাসিনাকে হত্যা করতেই এ হামলা’

মামলা চলাকালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, তারা মনে করেন ওই হামলার উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করা৷

তারা আদালতকে জানান, হামলার আগে ঢাকায় ১০টি বৈঠক হয় এবং এসব বৈঠকে তারেক রহমান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, হারিছ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। টাকা ও গ্রেনেড আসে পাকিস্তান থেকে।

‘পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিনের আব্দুল মজিদ বাট এই কাজে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল। এ হামলা চালায় জঙ্গি সংগঠন হরকতুল জিহাদের সদস্যরা। ’

২০০৭ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ মামলার ফের তদন্ত শুরু হলে অনেক নতুন তথ্য সামনে আসে। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সম্পূরক চার্জশিটে তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে আরো অনেকের নাম প্রকাশ পায়।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ এসব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করা হয়েছে। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের দাবি, মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছে।

মামলার বিচার কাজ

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ ৫২ জন আসামির বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ২৮ মার্চ বিচার কাজ শুরু হয়।   বিশেষ ট্রাইব্যুনালে এই মামলায় ওই বছরের ৯ এপ্রিল পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেন আদালত।

বর্তমানে আলোচিত এ মামলার বিচার শুরু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত বিশেষ ট্রাইবুনালে। এ মামলায় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারেক রহমানসহ ২২ আসামির বিরুদ্ধে বিচারকার্য শুরু হয়েছিলো। তখন ৬১ জন সাক্ষীর জবানবন্দি নেন আদালত।

পরে ৫১১ সাক্ষীর মধ্যে ২২৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে আরও ২০ জনের সাফাই সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন বিচারক।

বাংলাদেশ সময়: ০০১৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৮
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।