ঢাকা, শনিবার, ১ চৈত্র ১৪৩১, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১৪ রমজান ১৪৪৬

ইসলাম

ঐতিহ্যের ধারক বাখরপুর জামে মসজিদ

মুহাম্মদ মাসুদ আলম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫০ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০২৫
ঐতিহ্যের ধারক বাখরপুর জামে মসজিদ

চাঁদপুর: নৌ যোগাযোগ সহজ হওয়ার কারণে চাঁদপুর জেলার ব্যবসা বাণিজ্যের ঐতিহ্য রয়েছে। ফলে এ এলাকায় ভারতীয় মুসলমানদের আগমন ঘটে।

তারা অস্থায়ীভাবে এ জেলায় অবস্থান করলেও বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করে যান।  

তারাই জেলার বিভিন্ন এলাকায় চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি করেছিলেন মসজিদ। মুঘল আমলের মসজিদ নামে এসব স্থাপনাগুলো পরিচিত। তেমনি চাঁদপুর সদর উপজেলার বাখরপুর গ্রামে রয়েছে প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যের ধারক বাখরপুর জামে মসজিদ। গায়েবি মসজিদ নামেও স্থানীয়ভাবে পরিচিত এটি।

সম্প্রতি ওই মসজিদ এলাকা ঘুরে, মসজিদ পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও মুসল্লিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এ মসজিদ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য।

জেলা সদর থেকে এ মসজিদের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। সদরের দক্ষিণে সদর-হাইমচর সড়ক হয়ে চান্দ্রা বাজার চৌরাস্তা থেকে দক্ষিণে বাখরপুর গ্রাম। মূল সড়ক থেকে গ্রামীণ সড়ক দিয়ে চান্দ্রা ইউনিয়নের বাখরপুর পশ্চিম পাড়ায় মেঘনা নদীর খুব কাছে মসজিদটির অবস্থান।

স্থানীয়দের তথ্য মতে এ মসজিদের নির্মাণ সালের সঠিক তথ্য সংরক্ষিত নেই এবং পাওয়া যায়নি। তবে ইতিহাস পর্যালোচনা ও প্রবীণ লোকদের মতে মুঘল আমলেই এ মসজিদ নির্মাণ হয়েছে। কারণ এটির নির্মাণ শৈলী দেখে তাই মনে হয়।

মসজিদের উন্নয়নমূলক কাজে জড়িতদের মধ্যে রয়েছেন মুসল্লি নাজির পাটওয়ারী (৬৫)। তিনি বলেন, মসজিদ কমপ্লেক্সটি ২৮ শতাংশ জমির ওপর অবস্থিত। এর মধ্যে তিন গুম্বজ বিশিষ্ট মসজিদ ভবনটি ছয় শতাংশ জমির ওপর নির্মিত। প্রায় ৩০ বছর আগে মসজিদের পূর্ব দিকে আট শতাংশের মধ্যে পাঁচতলা ভিতের ওপর একতলা ভবনের কাজ করা হয়েছে। পাশে ঈদগাহ ও পুকুর মিলিয়ে রয়েছে ১৪ শতাংশ।

মুঘল আমলের নকশায় করা এ মসজিদটিতে রয়েছে তিন গুম্বজ ও তিন তারকা। আর এ নির্মাণ কাজ হয় শুধুমাত্র চুন-সুরকি দিয়ে। পুরো মসজিদের চারপাশে ২৮টি চুন-সুরকির তৈরি খুটি রয়েছে। আর এসব খুটির সঙ্গে দেয়ালের পুরুত্ব সোয়া তিন ফুট। পাঁচটি দরজা ও মূল মিম্বরের দুই পাশে দুটি মেহরাব। সোয়া তিন ফুট পুরুত্বের জুল বিম দুটি। মসজিদটি যখন নির্মাণ হয়, তখনকার নির্মাণ শৈলী এখন অনেকটাই আর নেই। শুধুমাত্র তিনটি গম্বুজের ভেতরের অংশে কিছু হাতে তৈরি নকশা রয়েছে বিভিন্ন রঙের।

মুসল্লিরা জানালেন, এ মসজিদের মূল অংশে একসঙ্গে দেড় শতাধিক মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। বর্তমানে বর্ধিতাংশসহ প্রতি জুমায় প্রায় ৩০০ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।

মুসল্লি নাজির পাটওয়ারী বলেন, এ মসজিদটি সংস্কার না করায় ৩০-৩৫ বছর আগে মসজিদের ওপরে বিভিন্ন ধরনের গাছ ও আবর্জনা ছিল। অনেকের কাছেই এটি জিনের কিংবা গায়েবি মসজিদ নামে পরিচিত। যে কারণে এক সময় ভয়ে লোকজন মসজিদের কাছে তেমন আসতেন না। এটি মেঘনার উপকূলীয় এলাকা। নদী ভাঙনে অনেক পরিবার বসতিবাড়ি ছেড়ে অন্যস্থানে বসতি গড়েছে। বিগত প্রায় ৩০-৩৫ বছর আগে মসজিদটি সংস্কার করেন এলাকার লোকজন।

মসজিদ পরিচালনা পর্ষদের সহ-সভাপতি হাফেজ আহম্মেদ পাটওয়ারী বলেন, এ মসজিদ নির্মাণের প্রকৃত সাল তারিখ কেউ বলতে পারে না। তবে আমরা ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানতে পারি, মুঘল সাম্রাজ্যের আমলে বণিকরা এ দেশে ব্যবসা করতে এসে এসব মসজিদ নির্মাণ করে। এ মসজিদের অনেক ঐতিহ্য ও সুনাম রয়েছে। অনেক দূর থেকে লোকজন মসজিদটি দেখার জন্য আসে।

মসজিদ পরিচালনা পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক মো. ইউসুফ গাজী বলেন, অনেকেই এ মসজিদকে গায়েবি কিংবা জিনের মসজিদ বলেন। আসলে তা নয়, আমাদের পূর্ব পুরুষদের সঙ্গে কথা বলেও নির্মাণ সাল জানা যায়নি। তবে অনেকের তথ্যমতে এটি মুঘল আমলেই তৈরি। তখন তারা মসজিদের উত্তর ও পূর্বে পুকুর খনন করে ওই মাটির ওপর মসজিদ নির্মাণ করেন। চুন ও সুরকি দিয়ে পুরো মসজিদ নির্মাণ হয়। এতে কোনো রড ও সিমেন্ট ব্যবহার হয়নি। তবে চুন ও সুরকির দেয়াল থেকে পানি চুইয়ে চুইয়ে পড়ার কারণে গত প্রায় ৩০-৩৫ বছর আগে এটি সংস্কার করা হয়। মূল স্থাপনা ঠিক রেখে ওপরে টাইলস বসানো হয়।

তিনি আরও বলেন, এ মসজিদ কমিটির সভাপতি মওদুদ আহম্মেদ দুদু খানসহ আমরা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করেছি। এতে স্থানীয় মুসল্লিদের দান অনুদানের পাশাপাশি সরকারিভাবে পুকুরঘাট ও ঈদগাহ নির্মাণের জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ থেকে প্রায় নয় লাখ টাকা অনুদান পেয়েছি।

গত দুই মাস আগে এ মসজিদের ইমাম ও খতিব হিসেবে যোগ দিয়েছেন পাশের দক্ষিণ বালিয়া গ্রামের বাসিন্দা মাওলানা শফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, এ মসজিদ স্থানীয়দের কাছে বেশ পরিচিত। অনেক লোক দূর থেকে এ মসজিদ দেখতে আসেন এবং এখানে এসে নামাজ পড়েন। এমন প্রাচীন মসজিদের খেদমত করতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত এবং আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি।

চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাখাওয়াত জামিল সৈকত বলেন, বাখরপুরে এমন একটি পুরনো ঐতিহ্যবাহী মসজিদ রয়েছে শুনেছি। মসজিদটি দেখতে খুবই সুন্দর। এ মসজিদে আরও কীভাবে উন্নয়ন করা যায়, সেটি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে এবং মসজিদে যাতায়াতের রাস্তাটি দ্রুত সংস্কার করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০২৫
এসআই/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।