বগুড়া: ধনী-গরীব নেই। মানুষ মারা গেলে জানাজায় উপস্থিত ব্যক্তিরাসহ এলাকার সবাইকে দাওয়াত করে সার্মথ্য অনুযায়ী, খাওয়ানো হয়।
তবে এ ধরনের অনুষ্ঠান আজো গ্রামবাংলার ঐতিহ্য বহন করে চলছে। ব্যাপকভাবে না হলেও এখনও এসব অনুষ্ঠানের প্রচলন রয়েছে। এখনও অনেক গ্রামে বড় বড় মজলিস বা তামদারির আয়োজন করা হয়। এসব অনুষ্ঠানে খাবার পাত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় কলাপাতা।
যদিও এক সময় গ্রামের নানা অনুষ্ঠানে কলাপাতাই ছিলো একমাত্র খাবার পাত্র। কিন্তু কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে এখনও অনেক গ্রামে মজলিস, তামদারি বা মেজবান অনুষ্ঠানে কলাপাতার ব্যবহার দেখা যায়।
বগুড়া জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলা ঘুরে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যখ্যাত কলাপাতার মেজবান সম্পর্কে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মাথার ওপরে দেওয়া হয়েছে সামিয়ানার ছাউনি। তার নিচে সারিবদ্ধভাবে খড়কুটা বিছানো হয়েছে। খড়ের ওপর পিঠের সঙ্গে পিঠ লাগিয়ে সারিবদ্ধভাবে মানুষ বসেছেন।
বেশির ভাগ মজলিস বা তামদারির অনুষ্ঠানে ছাউনি ছাপিয়ে মানুষকে বসতে হয়। এরপর সবার হাতে হাতে কলাপাতা পৌঁছানো হয়। এসব কলাপাতা সুন্দরভাবে খাবার উপযোগী করে কেটে নেওয়া হয় আগেই।
এরপর শুরু হয় খাবার দেওয়ার পালা। এ দায়িত্বে থাকেন গ্রামের পারদর্শী ব্যক্তিরা। প্রথমে একদল পানি দিয়ে যান। পরের দল ভাত দেওয়ার কাজ করেন। ডালভর্তি বালতি হাতে ঢুকে পরে আরেক দল। তারপর শুরু হয় মাংস-তরকারি দেওয়ার পালা।
চামচ হাতে লোহার কড়াইয়ের হাতল ধরে সামনের দিকে এগোচ্ছেন একজন। আরেকজন কড়াইয়ের হাতল ধরে পিছনের দিকে ছুটছেন। এক হাতে কড়াই ধরে অন্য হাতে চামচ দিয়ে কড়াই থেকে চামচে মাংস-তরকারি তুলে পাতায় পাতায় দিয়ে যাচ্ছেন তারা। পারদর্শী হওয়ায় অতি অল্প সময়েই কয়েক হাজার লোকের পাতে পৌঁছে যায় তরিতরকারি।

এ সময় তরকারির যোগানদার হিসেবে পেছনে পেছনে দুই-তিন জন লোক সার্বক্ষণিক থাকেন। তারাও তরকারির বড় বড় গামলা বা কড়াই হাতে সমানতালে পেছনে ছুটে চলেন। কড়াইয়ের তরকারি শেষ হওয়ার আগেই গামলা থেকে ঢেলে দেন তারা।
এখানে ধনী-গরীব সবাই সমান। তরকারি দেওয়ার সময় তারা কারো মুখের দিকে তাকান না। তাদের চোখ থাকে কলাপাতায় দেওয়া ভাতের ওপর।
মঙ্গলবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) শেরপুর উপজেলার সীমাবাড়ি ইউনিয়নের ধনকুণ্ডি গ্রামের মরহুম আবুল কাশেমের তামদারি (স্থানীয় ভাষায়) অনুষ্ঠানে গেলে এমন দৃশ্য দেখা যায়।
স্থানীয় আল মাহমুদ ও গোলাম নবী বাংলানিউজকে জানান, এ ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য কয়েকদিন ধরে প্রস্তুতি নিতে হয়। একদিন আগেই রান্নার যাবতীয় জিনিসপত্র প্রধান বাবুর্চির হাতে বুঝিয়ে দিতে হয়। সন্ধ্যা থেকে প্রধান বাবুর্চির নেতৃত্বে তার সহকারীরা রান্নার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। দাওয়াতে কতো সংখ্যক লোক উপস্থিত হতে পারেন- তা জেনে তারা চুলা তৈরি করেন।

তারা আরো জানান, সারিবদ্ধভাবে বসানো ২৫-৩০টি চুলায় মধ্যরাত বা ভোর রাত (দাওয়াতের সময় অনুযায়ী) থেকে একযোগে রান্না শুরু হয়। প্রথমে তরকারি রান্নার কাজ শেষ করা হয়। পরে ভাত রান্নার কাজ চলে একই চুলায়।
মোজাহার আলী ও আব্দুল ওহাব বাংলানিউজকে জানান, বর্তমানে সবকিছুতেই আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। ফলে পুরনো ধাঁচের এসব রান্না উঠে যাচ্ছে। এছাড়া কলাগাছের সংকটের কারণে আগের মতো কলাপাতাও পাওয়া যায় না।
সবমিলিয়ে মানুষের রুচিতে পরিবর্তন আসায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যখ্যাত কলাপাতায় খাওয়ার রীতিও উঠে যাওয়ার পথে, বলেন তারা।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৬
এমবিএইচ/আরএম