ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩ শাবান ১৪৪৬

ফিচার

পোড়াদহ মেলায় এক বাঘাইড়ের দাম ৬৪ হাজার টাকা!

কাওছার উল্লাহ আরিফ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫
পোড়াদহ মেলায় এক বাঘাইড়ের দাম ৬৪ হাজার টাকা!

বগুড়া: প্রায় চারশ বছরের গ্রামীণ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে বগুড়ায় প্রতিবছর মাঘের শেষ বুধবার আয়োজন করা হয় ‘পোড়াদহ’ মেলার।  

পোড়াদহ মেলা মানেই বিশাল আকৃতির বিভিন্ন প্রজাতির মাছের মেলা।

 

প্রতিবছর পোড়াদহ মেলাকে কেন্দ্র করে জমে ওঠে মাছের অস্থায়ী বাজার। ব্যতিক্রম হয়নি এবারও। মেলার প্রথমদিনই সবার নজর কেড়েছে এক মণ ওজনের বিশাল বাঘাই মাছ। যেটির দাম হাঁকা হয়েছে ৬৪ হাজার টাকা। সিরাজগঞ্জের সদর উপজেলার মো. জমির উদ্দিন নামে একজন বিক্রেতা মাছটি নিয়ে এসেছেন৷ আলী হায়দার নামে এক ক্রেতা মাছটির দাম ৩৩ হাজার টাকা বললেও দিতে রাজি হননি বিক্রেতা।

এদিকে ২৪ কেজি ওজনের আরেকটি কাতল মাছের দাম হাঁকা হয়েছে ৩৭ হাজার টাকা। মাছটি কিনতে ১৯ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম বলেছেন আবু হেনা নামে এক ক্রেতা। বিক্রেতা আল-আমিন ৩৫ হাজার টাকার কমে মাছটি বিক্রি করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন।

বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৯টার দিকে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলায় এসে দেখা মেলে বড় এসব মাছের।

মেলায় গিয়ে দেখা যায়, পোড়াদহ মেলা প্রাঙ্গণে কয়েকশ খুচরা মাছ বিক্রেতা এসেছেন। সারিবদ্ধভাবে দোকান বসিয়েছেন তারা। দোকানে বিভিন্ন জাতের ছোট, বড়, মাঝারি মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছেন তারা।

মেলার পূর্বপ্রান্তে উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বিভাবে বসেছেন একাধিক দোকানি। তাদেরই একজন জমির উদ্দিন।  
সিরাজগঞ্জ জেলা থেকে তিনি বাঘাইড় মাছ এ মেলায় বিক্রি করতে এনেছেন। বিশাল আকারের এ মাছটি দেখতে সকাল থেকেই ভিড় করছেন ক্রেতা ও দর্শনার্থীরা। ক্যামেরায় মাছের ছবি ধারণ করছেন অনেকে। মোজাম্মেলের দোকানে গিয়েও দেখা যায় একই দৃশ্য।

মেলায় বাঘাইড় মাছ নিয়ে আসা বিক্রেতা জমির উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, মেলায় তিনি প্রতিবছরই মাছ বিক্রি করতে আসেন। এখানে বড় মাছ বেশি বিক্রি হয়। ক্রেতারা দামাদামি করলেও বড় মাছ কিনতেই বেশি পছন্দ করেন। তাই তিনি বিভিন্ন জাতের বড় মাছ এ মেলায় উঠিয়েছেন। এর মধ্যে বাঘাইড় মাছটি এ মেলার সবচেয়ে বড় মাছ।

তিনি জানান, এক হাজার ৬০০ টাকা কেজি হিসেবে মাছটির দাম হাঁকিয়েছেন ৬৪ হাজার টাকা।  

মাছ বিক্রেতা হাবিবুর রহমান, আব্দুল মমিনসহ একাধিক মাছ বিক্রেতা বাংলানিউজকে জানান, ঐতিহ্যবাহী এ মেলায় রুই, কাতল, মৃগেল, গাঙচিল, চিতল, বোয়াল, হাঙড়ি, গ্রাসকার্প, সিলভার কার্প, বিগহেড, কালিবাউশ, পাঙ্গাসসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাঝারি ও বড় আকারের মাছ পাওয়া যাচ্ছে। এসব মাছ ওজনে পাঁচ থেকে ২৫ কেজি পর্যন্ত।

তারা জানান, প্রতিকেজি রুই বিক্রি হচ্ছে আকার ভেদে ৩০০-৮০০ টাকায়, কাতল ৩৫০-৮০০ টাকায়, মৃগেল ২৫০-৪০০, গাঙচিল ৩০০, চিতল ৩০০-৬০০, বোয়াল ৬০০-১২০০, হাঙড়ি ২০০-৪০০, গ্রাসকার্প ২৫০-৫৫০, সিলভার কার্প ৩০০-৫০০, বিগহেড ২৫০-৫০০, কালিবাউশ ২৫০-৪০০, পাঙ্গাস ১৫০-৬০০ টাকায়।

প্রতিবছর ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলায় প্রধান আকর্ষণ হয়ে থাকে বড় বাঘাইড় মাছ। তবে গেল তিন বছর আগে মহাবিপন্ন বাঘাইড় মাছ ধরা, প্রদর্শন ও বিক্রি বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চিঠি দেয় বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। এতে বলা হয়- বাঘাইড় মাছ একটি মহাবিপন্ন প্রাণী। তাই পোড়াদহ মেলায় মহাবিপন্ন বাঘাইড় কেনা-বেচা বন্ধ করতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হলো। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন- ২০০২ অনুযায়ী মেলায় মহাবিপন্ন বাঘাইড় কেনা-বেচা করা হলে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে। গেল তিন বছর পর মেলায় এবার বাঘাইড় মাছের দেখা মিলল৷

মেলায় মাছ কিনতে আসা শাহাদাত হোসেন, সায়েম রহমান নামে একাধিক ব্যক্তি বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিবছর আমরা এ মেলায় মাছ কিনতে আসি। এবারও এসেছি।  

শাহাদাত হোসেন ১২ কেজি ওজনের একটি কাতল মাছ কিনেছেন। পোড়াদহ মেলা বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা। মেলায় আগে বড় বড় মাছ উঠত। এবারের মেলায় সে তুলনায় বড় মাছ ওঠেনি। তারা মেলায় ঘুরে সামর্থ্য অনুযায়ী মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।

গাবতলী সদরের আনিছুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, ১১ কেজি ওজনের একটি বিগহেড মাছ কিনেছেন। পরিবার নিয়ে আত্মীয়ের বাড়ি এসেছেন তিনি। মেলায় এসে মাছের দরদাম করছেন। কয়েকটা মাছের দোকান ঘুরেই পছন্দমত একটা বিগহেড মাছ কিনেছেন। বিভিন্ন দোকান ঘুরে কোনোটা দামে আবার কোনোটা মনে মিলছিল না তার। বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করছে। এখন কিছু মিষ্টি নিয়ে ফিরবেন তিনি।

মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, তাদের মধ্যে অনেক মাছচাষি কেবল মেলায় বেশি লাভে বড় মাছ বিক্রির জন্য মাছ বড় করেন। অনেকে মেলায় বিক্রির জন্য বেশ আগে থেকেই নদী থেকে আইড়, বোয়াল ইত্যাদি মাছ ধরে পুকুরে বা জলাশয়ে বেঁধে রাখেন। মেলাকে কেন্দ্র করে আশপাশের গ্রামগঞ্জের সবাই তাদের মেয়ে, জামাইসহ আত্মীয়-স্বজনদের নিমন্ত্রণ করেন। অতিথিদের বড় মাছ, মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এ মেলার আমেজ চলে সপ্তাহব্যপী।

অর্থনৈতিকভাবেও এ মেলার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিবছর এ মেলায় কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়। লেনদেনের বড় অংশ উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবৃত্তগামী হওয়ায় এ মেলার গুরুত্ব আরও অনেক বেশি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫
কেইউএ/এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।