ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

বুনোকন্যা মাঠ থেকে যেভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মাসুম বিল্লাহর শিষ্যরা

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২২ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০২৪
বুনোকন্যা মাঠ থেকে যেভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মাসুম বিল্লাহর শিষ্যরা

সাতক্ষীরা: স্বপ্ন ছিল জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে মাঠ কাঁপানো। ঢাকায় লীগে খেলার সময় পায়ে চোট লেগে সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হলেও দমেননি তিনি।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলের শিশু-কিশোরদের প্রতিভা বিকাশে গড়ে তুলেছিলেন বেসিক ফুটবল একাডেমি নামের একটি ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণার্থীরা আজ তার সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিয়েছে। চর্চার সুযোগ পেলে উপকূলের শিশু-কিশোরেরাও দেশের নাম উজ্জ্বল করতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ তৈরি করেছেন তিনি।

বলছি, অনূর্ধ্ব ১৬ জাতীয় ফুটবল দলের গোলকিপার আব্দুর রহমান এবং অনূর্ধ্ব ১৬ জাতীয় নারী ফুটবল দলের কৃতি খেলোয়াড় সাথী মুন্ডার স্থানীয় কোচ জি এম মাসুম বিল্লাহ’র কথা।

ছোট বেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি ঝোঁক ছিল জি এম মাসুম বিল্লাহর। পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থাতেই গ্রামের মাঠ কাঁপিয়ে দর্শকদের মন জয় করেছিলেন তিনি। এরপর উপজেলা-জেলার গণ্ডি পেরিয়ে রাজধানীতে খেলতে শুরু করেন তিনি। ভালোই চলছিল সব কিছু। হঠাৎই তার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায় ২০১৩ সালে ঢাকা লীগের একটি ম্যাচে। পায়ে চোট লেগে ফুটবল থেকে ছিটকে পড়েন তিনি। পরে অনেক চেষ্টা করেও আর মাঠে ফিরতে পারেননি সাতক্ষীরার শ্যামনগরের যুবদের আইকন জিএম মাসুম বিল্লাহ।

এরই মধ্যে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য সংসারের হাল ধরতে হয় সাত ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় মাসুম বিল্লাহকে। অল্প কিছু টাকা দিয়ে একটি পুরোনো মোটরসাইকেল কিনে ভাড়ায় চালাতে শুরু করেন তিনি। কিন্তু ফুটবলের নেশা পিছু ছাড়তো না তার।

নিজে খেলতে না পারলেও ২০১৩ সালে স্থানীয় ১২-১৩ জন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে শুরু করেন নতুন সংগ্রাম। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় গড়ে তোলেন বেসিক ফুটবল একাডেমি। প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন শিষ্যদের। দিনের প্রথম বেলা কাটতো ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে, পরের বেলায় ফুটবল প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি।  

স্থানীয়দের কাছে বিষয়টি যেমন ছিল উপহাসের, তেমনি ছিল বিরক্তির কারণও।

তাদের প্রশ্ন ছিল, এখানে ছেলে-মেয়েরা খেলা করে কী করবে? কাজ কাম বাদ দিয়ে কী শুরু করলো? সহ নানা প্রশ্ন।

তখন বেসিক ফুটবল একাডেমির ছেলে-মেয়েরা অনুশীলন করতো বুনোকন্যার মাঠে। যেখানে বছরের অর্ধেক সময় পানিতে থৈ থৈ করে। খেলার উপযোগী থাকে মাত্র পাঁচ মাস। তাও বালুতে ভরা।

বালু ভর্তি এই মাঠে প্রশিক্ষণ নিয়েই আজ জাতীয় দলের হয়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে আব্দুর রহমান, সাথী মুন্ডারা।

বেসিক ফুটবল একাডেমি থেকে উঠে আসা আব্দুর রহমান ২০২৩ ভুটানে অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব ১৬ চ্যাম্পিয়নশিপে জাতীয় দলের হয়ে অংশ নেয়। বর্তমানে আব্দুর রহমান অনূর্ধ্ব ১৭ টিমের হয়ে বাংলাদেশ এলিট ফুটবল একাডেমিতে প্রশিক্ষণরত রয়েছে।

অপরদিকে, সর্বশেষ নেপালে অনুষ্ঠিত নারী অনূর্ধ্ব ১৬ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেওয়া সাথী মুন্ডারও ফুটবলে হাতেখড়ি হয় বেসিক ফুটবল একাডেমিতে।  

এছাড়া জিএম মাসুম বিল্লাহর আরেক শিষ্য খাদিজা খাতুন বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর্চারি বিভাগে খেলছে।

শুধু আব্দুর রহমান, সাথী মুন্ডা বা খাদিজা নয়, বেসিক ফুটবল একাডেমির অসংখ্য প্রশিক্ষণার্থী খেলছে দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন পর্যায়ে।  

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলের কিশোর-কিশোরীদের দক্ষ খেলোয়াড় তৈরি করতে ক্রীড়া সামগ্রী যোগানের জন্য এক সময় নিজের উপার্জনের মাধ্যম মোটরসাইকেলটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন মাসুম বিল্লাহ। অনেক সময় খেলোয়াড় বাছাই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে শিষ্যদের নিয়ে ঢাকা, যশোর, খুলনা গিয়েছেন তিনি। থেকেছেন স্কুলের বারান্দায় বা দোকানের সামনে।

এরই মধ্যে ২০২২ সালে অভাবের তাড়নায় একাডেমি রেখেই ছোট্ট একটি চাকরি নিয়ে খুলনায় চলে যান জিএম মাসুম বিল্লাহ। সেখানে তার একাডেমির সফলতার গল্প শুনে অনুপ্রাণিত হন খুলনা বিএল কালেজের প্রভাষক শংকর মল্লিক, দেবপ্রসাদ বিশ্বাস, মিজানুর রহমান লিখন, সোহেল রানা ও মাধব চন্দ্র রুদ্র। তারা তার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। নতুন করে একাডেমি পরিচালনা করার জন্য জিএম মাসুম বিল্লাহকে কিনে দেন একটি পুরোনো মোটরসাইকেল।

মোটরসাইকেলটি পেয়ে এলাকায় ফিরে আবার শুরু করেন ভাড়া মোটরসাইকেল চালানো। পাশাপাশি নতুন উদ্যমে শুরু করেন বেসিক ফুটবল একাডেমির প্রশিক্ষণ কার্যক্রম।

বেসিক ফুটবল একাডেমি এখন প্রতিদিন মুখরিত হচ্ছে খোলপেটুয়া নদীর পাড়ের শিশু-কিশোরদের পদচারণায়।

জাতীয় অনূর্ধ্ব ১৭ দলের গোল কিপার আব্দুর রহমানের বাবা হান্নান মল্লিক বলেন, মাসুম বিল্লাহ না থাকলে আমার ছেলে জাতীয় দলে খেলতে পারত না। সাথী মুন্ডার মতো খেলোয়াড় পাওয়া যেত না। বেসিক ফুটবল একাডেমির কোচ মাসুম বিল্লাহ আমাদের গর্ব।

একান্তে আলাপকালে জি এম মাসুম বিল্লাহ বলেন, এক সময় আমার স্বপ্ন ছিল জাতীয় দলে খেলার। দরিদ্রতা আর পায়ের চোটের কারণে সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে পারিনি। কিন্তু আমাদের আব্দুর রহমান, সাথী মুন্ডারা আমার স্বপ্ন পূরণ করেছে। আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি একটু চর্চার সুযোগ পেলে আমাদের ছেলে-মেয়েরাও দেশের নাম উজ্জ্বল করতে অবদান রাখতে পারে। বেসিক ফুটবল একাডেমির অনেক প্রশিক্ষণার্থীই বিকেএসপিতে চান্স পেয়েছে। তারাও আশা করি ভালো করবে।  

তিনি আরও বলেন, উপকূলের ছেলেমেয়েদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এখানে একটি মাঠের অভাবে ছেলে-মেয়েরা অনুশীলন করতে পারে না, খেলতে পারে না। তাদের ফুটবলের প্রতি আকর্ষণ করতে এখানে একটি ভালো মাঠ দরকার।

শ্যামনগর উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজিবুল আলম বলেন, বেসিক ফুটবল একাডেমির সাফল্যে আমরা গর্বিত। তাদের উদ্যোগ ও কার্যক্রম এগিয়ে নিতে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩২২ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।