ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

পোড়াদহ মেলায় ৪০ কেজির মারলিনের দাম ৬০ হাজার!

কাওছার উল্লাহ আরিফ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৪
পোড়াদহ মেলায় ৪০ কেজির মারলিনের দাম ৬০ হাজার!

বগুড়া: পোড়াদহ মেলা মানেই বিশাল আকৃতির, বিভিন্ন প্রজাতির মাছের মেলা। প্রায় ৪০০ বছরের গ্রামীণ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে বগুড়ায় প্রতিবছর মাঘের শেষ অথবা ফাল্গুনের প্রথম বুধবার অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী ‘পোড়াদহ’ মেলা।

 

বাঙালি জীবনের সঙ্গে মেলার যোগ দীর্ঘকালের। এ সম্পর্ক নিবিড় ও আত্মিক।  

প্রতিবছর এ মেলাকে কেন্দ্র করে জমে ওঠে মাছের বাজার। ব্যতিক্রম হয়নি এবারও। বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) মেলায় সবার নজর কেড়েছে এক মণ ওজনের একটি মারলিন ফিস (পাখি মাছ)। যেটির দাম হাঁকা হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। আবু হেনা নামে একজন ক্রেতা ৩০ হাজার টাকা দাম তুললেও দিতে রাজি হননি বিক্রেতা মো. শরিফ তালুকদার।

এদিকে ২৫ কেজি ওজনের আরেকটি ব্ল্যাক কার্প মাছের দাম হাঁকা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। মাছটি কিনতে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম দিতে চেয়েছেন শাজাহান আলী নামে এক ক্রেতা। বিক্রেতা মোজাম্মেল ২০ হাজার টাকার কমে মাছটি বিক্রি করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন।

বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলায় এসে দেখা মেলে এমন চিত্র।

দেখা যায়, পোড়াদহ মেলা প্রাঙ্গণে কয়েকশ খুচরা মাছ বিক্রেতা এসেছেন। বড়, ছোট, মাঝারি- বিভিন্ন জাতের মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছেন তারা।

মেলার পশ্চিমপ্রান্তে উত্তর-পশ্চিমে লম্বালম্বিভাবে বসেছেন একাধিক দোকানি। তাদেরই একজন শরিফ তালুকদার। তিনি টাঙ্গাইল জেলার বাসাইল উপজেলার জশিহাটি এলাকার বাসিন্দা। তিনি ও তার ভাই অনলাইনে মাছের ব্যবসা করেন। তারা এ মেলায় মারলিন মাছ বিক্রি করতে এনেছেন। বিশাল আকারের এ মাছটি দেখতে সকাল থেকেই ভিড় করছেন দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা। ক্যামেরায় মাছের ছবি ধারণ করছেন তারা। মোজাম্মেলের দোকানে গিয়েও দেখা যায় একই দৃশ্য।

বিক্রেতা শরিফ তালুকদার বাংলানিউজকে জানান, এ বছর মেলায় প্রথম তিনি মাছটি নিয়ে এসেছেন। এখানে বড় আকারের মাছ বেশি বিক্রি হয়। ক্রেতারা দামাদামি করলেও বড় মাছ কিনতেই বেশি পছন্দ করেন। তাই তারা বিভিন্ন জাতের বড় মাছ এ মেলায় উঠিয়েছেন। এর মধ্যে মারলিন মাছটি এ মেলার সবচেয়ে বড় মাছ।

তিনি জানান, দেড় হাজার টাকা কেজি হিসেবে মাছটির দাম হাঁকিয়েছেন ৬০ হাজার টাকা। সকাল ১১টা পর্যন্ত বেশ কয়েকজন ক্রেতা মাছটি কিনতে দামাদামি করেছেন। এর মধ্যে একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা দাম বলেছেন।

এদিকে মেলায় আসা আসাদুর রহমান, সামছুল আলম, বেলালসহ একাধিক মাছ বিক্রেতা বাংলানিউজকে জানান, ঐতিহ্যবাহী এ মেলায় রুই, কাতলা, মৃগেল, গাঙচিল, চিতল, বোয়াল, হাঙড়ি, গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প, বিগহেড, কালিবাউশ, পাঙ্গাসসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাঝারি ও বড় মাছ পাওয়া যাচ্ছে। এসব মাছের ওজন পাঁচ থেকে ২০ কেজির মধ্যে।

তারা জানান, প্রতিকেজি রুই ৩০০-৬০০ টাকায়, কাতলা ৩৫০-৮০০, মৃগেল ২৫০-৪০০, গাঙচিল ৩০০, চিতল ৩০০-৬০০, বোয়াল ৬০০-১২০০, হাঙড়ি ২০০-৪০০, গ্রাস কার্প ২৫০-৩৫০, সিলভার কার্প ৩০০-৪৫০, বিগহেড ২৫০-৪০০, কালিবাউশ ২৫০-৪০০, পাঙ্গাস ১৫০-৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

প্রতিবছর ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলার প্রধান আকর্ষণ হয়ে থাকে বড় বাঘাইড় মাছ। তবে, গেল দুই বছর আগে মহাবিপন্ন বাঘাইড় মাছ প্রদর্শন ও বিক্রি বন্ধ করতে সংশ্লিষ্টদের চিঠি দেয় বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। এতে বলা হয়- বাঘাইড় মাছ একটি মহাবিপন্ন প্রাণী। তাই পোড়াদহ মেলায় মহাবিপন্ন বাঘাইড় কেনা-বেচা বন্ধ করতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হলো। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০০২ অনুযায়ী মেলায় মহাবিপন্ন বাঘাইড় কেনা-বেচা করা হলে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

মেলায় মাছ কিনতে আসা কামরুজ্জামান, সৈয়দ কবির, তামিম নামে একাধিক ব্যক্তি বাংলানিউজকে জানান, প্রতিবছর আমরা এ মেলায় মাছ কিনতে আসি। এবারও এসেছি। এদের মধ্যে কামরুজ্জামান আলী ১২ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ কিনেছেন।

মেলায় আসা আহম্মেদ খাজা, ইসতিয়াক হোসেন, তোজাম্মেল খানসহ কয়েকজন ব্যক্তি বাংলানিউজকে বলেন, পোড়াদহ মেলা বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা। প্রতিবছর আমরা এ মেলায় মাছ কিনতে আসি। এবারও এসেছি। মেলায় গত বছর বড় বড় মাছ উঠেছে। এবারের মেলায় বড় মাছ তুলনামূলক কম।  

মহিষাবান এলাকার শামীম আহম্মেদ বাংলানিউজকে জানান, ১৩ কেজি ওজনের একটি বিগহেড মাছ কিনেছেন। পরিবার নিয়ে আত্মীয়ের বাড়ি এসছেন তিনি। মেলায় এসে মাছের দরদাম করছেন। কয়েকটা মাছের দোকান ঘুরেই পছন্দমতো একটা বিগহেড মাছ কিনেছেন। বিভিন্ন দোকান ঘুরে কোনোটা দামে আবার কোনোটা মানে মিলছিল না তার।  

বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করছেন। এখন কিছু মিষ্টি নিয়ে ফিরবেন বলেও জানান তিনি।

স্থানীয় ও মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, অনেক মাছচাষি কেবল মেলায় বেশি দামে বিক্রির জন্য মাছ বড় করেন। মেলায় বিক্রির জন্য বেশ আগে থেকেই নদী থেকে আইড়, বোয়াল ইত্যাদি মাছ ধরে পুকুরে বা জলাশয়ে বেঁধে রাখা হয়। মেলাকে কেন্দ্র করে আশপাশের গ্রামগঞ্জের সবাই তাদের মেয়ে, জামাইসহ আত্মীয়-স্বজনদের নিমন্ত্রণ করেন। অতিথিদের বড় মাছ আর মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।

আগের মতো বড় পরিসরে মেলাটি হচ্ছে না এবার। বিগত বছরগুরোর তুলনায় এবার মাছও কম বলে মন্তব্য করেন মেলায় মাছ কিনতে আসা অনেক ক্রেতা।  

অর্থনৈতিকভাবে এ মেলার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতি বছর এ মেলায় কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়। লেনদেনের বড় অংশ উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তগামী হওয়ায় এর গুরুত্ব আরও অনেক বেশি।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৪
কেইউএ/এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।