মৌলভীবাজার: মেছো বিড়ালকে অনেকেই ভুল নামে চিনেন। এই ভুল নামটি হলো মেছোবাঘ! ‘বাঘ’ শব্দটি যুক্ত করে পরিবেশবান্ধব এ প্রাণীটিকে মারাত্মক ভয়ংকর করে ফেলা হয়েছে।
‘মেছো বিড়াল’ প্রকৃতির উপকারী একপ্রাণী। প্রাণীজগতের খাদ্যশৃংখল রক্ষায় এর অবদান অনস্বীকার্য। এরা জলাভূমির মরা মাছ ও অসুস্থ প্রাণী খেয়ে নীরবে পরিবেশ-প্রকৃতির উপকার সাধন করে চলে। এরা নিরীহ প্রাণী, যা মানুষের জন্য কখনোই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে না।
মানুষের সঙ্গে সংঘাত বৃদ্ধি পাওয়া, আবাসন নষ্ট হওয়া, খাদ্যের অভাবসহ নানা কারণে মেছো বিড়ালসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীদের অস্তিত্ব আজ চরম হুমকির মুখে। প্রকৃতিতে বসবাস করা সব বন্যপ্রাণীদের প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করতে প্রতি বছর ৩ মার্চ বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস পালিত হয়ে আসছে।
বন্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী আদনান আজাদ এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, প্রখ্যাত প্রাণিবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. রেজা খান স্যারের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানতে পারি এরা আসলে মেছো বিড়াল। স্যারের কাছ থেকে এই তথ্য জানার পর থেকে আমি নিজেও এদের আর বাঘ বলে ডাকি না। এদের আমি যে আর বাঘ বলে ডাকি না, তার পেছনে কারণ আছে। কারণটা হলো, মেছো বিড়ালকে মেছো বাঘ নামে ডাকায় মানুষ ভয় পেয়ে অকারণে এদের মেরে ফেলে। মেছো বিড়ালকে মানুষ চেনে মেছো বাঘ নামে। অধিকাংশ মানুষ ভুল করে একে বাঘও ভেবে নেয়। ফলে অকারণে প্রাণীটিকে হত্যা করে। এদের সংখ্যাটা কমে যাওয়া একটাই অন্যতম প্রধান কারণ। এরা বর্তমানে বুনোপরিবেশের এক সংকটাপন্ন প্রাণী।
প্রাণীটির শারীরিক বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মেছো বিড়ালের ইংরেজি নাম Fishing Cat এবং বৈজ্ঞানিক নাম Prionailurus viverrinus। এরা আকারে গৃহপালিত বিড়ালের চেয়ে অনেকটা বড় হয়। শরীর ঘন, পুরু লোমে আবৃত। পুরুষ মেছো বিড়াল আকারে স্ত্রী মেছো বিড়ালের চেয়ে বড় হয়ে থাকে। এদের গায়ের রং ধূসর, সাথে বাদামি আভা আছে। পেটের নিচের রং সাদাটে। পুরা শরীরজুড়ে ছোপ ছোপ কালো দাগ আছে। চোখের ওপরে কপাল থেকে কানের দিকে কালো দুটি রেখা উঠে গেছে। গাল দুটি হালকা সাদাটে।
মেছো বিড়ালদের অনেকেই চিতা বিড়ালের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। দেখতে অনেকটা একই রকম হলেও এদের নাক কিছুটা চওড়া, দাঁত বড়, কান গোলাকার ও অপেক্ষাকৃত ছোট বলে জানান আদনান আজাদ।
প্রাণীটির শিকার সম্পর্কে তিনি বলেন, মেছো বিড়াল জলে ও স্থলে সমানভাবে তুখোড় শিকারি। সাধারণত খাল, বিল, নদী, পুকুর ও জলাভূমি আছে এমন জায়গাতেই এদের বসবাস। সুন্দরবনে বেশ ভালো পরিমাণেই আছে। মেছো বিড়াল মাছ, সাপ, ব্যাঙ, ইঁদুর, পাখি, খরগোশ, গুইসাপসহ মাঝারি আকারের অনেক প্রাণী শিকার করে থাকে। সুযোগ পেলে গৃহপালিত হাঁস-মুরগিও ধরে নিয়ে যায়। পানির ধারে ঝোপ অথবা কচুরিপানার ভেতরে এরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপ করে ঘাপটি মেরে শিকারের আশায় বসে থাকে। সুযোগ বুঝে থাবা দিয়ে মাছ ধরে। পানির নিচে ডুব দিয়ে মাছ ধরাতেও এরা বেশ পটু।
মেছো বিড়ালের প্রজনন এবং জীবনচক্র প্রসঙ্গে তিনি জানান, মেছোবিড়াল নিশাচর। দিনে ঘন ঝোপ, গাছের চওড়া ডালে অথবা গর্তে ঘুমিয়ে কাটায়। সূর্য ডোবার পরেই সাধারণত এরা শিকারে বের হয়। এলাকাভেদে একটি পুরুষ মেছো বিড়ালের সীমানা ২০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। যার প্রতি ৪-৫ বর্গকিলোমিটারের ভেতরে এক একটি স্ত্রী মেছো বিড়ালের বসবাস। মেছো বিড়াল নিজের সীমানা ঠিক করার জন্য শরীর থেকে এক প্রকারের সুগন্ধি (ফেরোমন) নির্গত করে। স্ত্রী বিড়াল প্রায় ৭০দিন গর্ভধারণের পর এক থেকে চারটি বাচ্চা প্রসব করে। বাচ্চারা জন্মের নয় মাস পর্যন্ত মায়ের সাথেই থাকে।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক খাল-বিলে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ হওয়ায় মেছো বিড়ালের সংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। মাছ চাষিদের খাল, বিল ও পুকুর থেকে মেছো বিড়াল মাছ খায় বলে এলাকাবাসী একত্রিত হয়ে ধাওয়া করে এদের পিটিয়ে অথবা বিষটোপ ও ফাঁদ পেতে ধরে মেরে ফেলে। এছাড়া পানি দূষণ, জলাভূমি ভরাট করে চাষের জমি বা বাড়ি নির্মাণ করাও এদের সংখ্যা কমে যাওয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ বলে জানান এই প্রাণী গবেষক।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৫ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০২৫
বিবিবি/এএটি