ঢাকা: বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমানকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া নিয়ে নানা আলোচনা তৈরি হয়েছে। চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশন সাইফুর রহমানকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোয় বিএসইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার (৪ মার্চ) বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ স্বাক্ষরিত এক আদেশে সাইফুর রহমানকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। আদেশে বলা হয়েছে, জনস্বার্থে বিএসইসির কর্মচারী চাকরি বিধিমালার ৬৩ ধারা ও সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ এর ৪৫ ধারার ক্ষমতাবলে সাইফুর রহমানকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু যে দুই বিধি বা আইনে তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা প্রয়োগের যথার্থতা নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়েছে।
বিএসইসির কর্মচারী চাকরি বিধিমালার ৬৩ ধারায় বলা হয়েছে, কর্মচারীদের অবসর গ্রহণ ও এরপর তাদের পুনর্নিয়োগের বিষয়ে সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ এর ৫৭ ধারা প্রযোজ্য হবে। এ ধারায় শাস্তি প্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর পুনর্বিবেচনার আবেদনের সুযোগের কথা বলা হয়েছে। যেটার পর আদেশকারী তার আদেশ সংশোধন, বাতিল বা বহাল রাখতে পারবে।
অর্থাৎ এই আইনে বাধ্যতামূলক অবসরের সিদ্ধান্তের বিষয়ে আবেদন করা হলে তা পুনর্বিবেচনার সুযোগ রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ এর ৪৫ ধারার ক্ষমতাবলে সাইফুর রহমানকে বাধ্যতামূলক অবসরের যে আদেশ দেওয়া হয়েছে, সেই ধারায় বিএসইসির কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কারণ না দেখিয়ে চাকরি থেকে অবসর দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে বিএসইসি যেহেতু একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ, বাতিল, পুনর্নিয়োগ কমিশনের ওপর অর্পিত করা হয়েছে। এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের নন, কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী। এদের জন্য বিএসইসির নিজস্ব আইন আছে। যেখানে বিএসইসির চাকরি বিধিমালার ৫০ এর (খ) এর (ই)-তে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের সুযোগ রাখা হয়েছে। যা গুরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত।
এই গুরুদণ্ড কার্যকরে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অভিযোগনামা অবহিত করার ১০ কার্যদিবসের মধ্যে আত্মপক্ষ সমর্থনে লিখিত বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দেওয়া এবং প্রস্তাবিত দণ্ড কেন তার ওপর আরোপ করা হবে না, সে সম্পর্কে কারণ দর্শানোর কথা বলা হয়েছে। এমনকি অভিযুক্ত ব্যক্তি সময় বাড়াতে আবেদন করলে সেই সুযোগ দিতে হবে। তবে সাইফুর রহমানের বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কমিশন তাদের এই নিজস্ব আইনকেই অনুসরণ করেনি।
তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এবং আরও কয়েকজনের বিষয়ে একই ধরনের পরিকল্পনার অভিযোগ এনে বুধবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিএসইসির চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের অবরুদ্ধ করে রাখেন বিএসইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারা সাইফুর রহমানের অবসরের আদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের অবরুদ্ধ করে নানান স্লোগান দেন।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মাহবুবুর রহমান বুধবার বিকেলে গণমাধ্যমকে বলেন, বর্তমান কমিশন নিয়ে বিএসইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে হতাশা তৈরি আছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ—কমিশনারদের খারাপ আচরণ, বিভিন্ন কোম্পানির তদন্তের আলোকে কর্মকর্তাদের ধারাবাহিক শোকজ করা এবং নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমানকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর আদেশ জারি করা। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বিএসইসির চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের কাছে পাঁচ দফা দাবি জানাই। তবে তারা এ দাবি মেনে নেননি। এ পরিস্থিতিতে আমরা বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সঙ্গে কাজ করতে পারছি না। তাই, আমরা বিএসইসির চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের পদত্যাগ দাবি করছি।
তিনি বলেন, তারা যদি বুধবারের মধ্যে পদত্যাগ না করেন তাহলে বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) থেকে পুরো কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করবেন। আমরা সরকারের কাছে গণমাধ্যমের মাধ্যমে এ বিষয়টি তুলে ধরছি। সরকারকে এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখার জন্য বিএসইসির সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পক্ষ থেকে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।
ঘটনাটির বিষয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বিএসইসি। এতে বলা হয়েছে, বর্তমান কমিশন পুঁজিবাজারে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ায় বিএসইসির কিছু উশৃঙ্খল কর্মকর্তা ও কর্মচারী এই রূপ অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি করেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বিগত দিনের পুঁজিবাজারের বিভিন্ন অনিয়ম অনুসন্ধানে কমিশন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ১২টি লিস্টেড কোম্পানির বিভিন্ন অনিয়ম তদন্ত করে। এ পর্যন্ত তদন্ত কমিটি সাতটি তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে অভিযোগ গঠনের প্রক্রিয়া চলমান, যার আওতায় রয়েছে পুঁজিবাজারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং বিএসইসির কিছু কর্মকর্তা। এ ছাড়া বিভিন্ন অভিযোগ এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ বছর চাকুরি সমাপ্ত করায় বিধি মোতাবেক কমিশনের নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমানকে গত ৪ মার্চ অবসর দেওয়া হয়।
বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খাদেমুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের চাকরি বিধিমালা নিয়ে নিজস্ব কোনো আইন থাকে, তাহলে সেই আইন অনুযায়ী শাস্তি বা বাধ্যতামূলক অবসর দিতে হবে। কাউকে বিএসইসির আইন দ্বারা নিয়োগ করে অন্য আইনে শাস্তি দেওয়া যাবে না। এমনটি করা হয়ে থাকলে তা অবৈধ হবে। সেক্ষেত্রে ভুক্তভোগী আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব নিয়েই গত বছরের ২২ আগস্ট নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমানকে ইস্যুয়ার কোম্পানি অ্যাফেয়ার্স বিভাগ থেকে আরঅ্যান্ডডি বিভাগের দায়িত্ব দেয়। তখনই মূলত তাকে এক প্রকার ওএসডি করা হয়। তবে ৯ সেপ্টেম্বর সেই দায়িত্ব থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। সেই থেকে সাইফুর রহমান নিয়মিত অফিসে আসছিলেন, কিন্তু কোনো কাজ করতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত তাকে মঙ্গলবার বাধ্যতামূলক অবসরেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ সময়: ২০২৩ ঘণ্টা, মার্চ ০৫, ২০২৫
এসএমএকে/এইচএ