কলকাতা: উত্তর কলকাতার বুক চিরে আরও উত্তরে শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়। এ মোড় পেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই টালার জলাধার।
ইতিহাসের এ গম্বুজ সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা উপেন তরফদার রচনা করেছিলেন আরেক ইতিহাস। বাংলাদেশের পদ্মাপাড়ের মানিকগঞ্জে তার পূর্বপুরুষের ভিটা। স্ত্রী শুক্লা তরফদারকে পাশে নিয়ে তার শ্যামবাজারের বাসায় বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেন উপেন।
উপেন তরফদার আকাশবাণী কলকাতার অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। শুধু এটুকু বললে তার সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলা হয় না। তিনি বাংলাদেশের ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’প্রাপ্তদের একজন, এটা বললেও সম্ভবত সবটা বলা হয় না। আসলে তিনি এক জীবন্ত ইতিহাস। তার স্মৃতির ঝুলিতে আছে এমন অনেক তথ্য, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস।
মুক্তিযুদ্ধে আকাশবাণী কলকাতার অবদানের বিষয়ে উপেন তরফদার মেলে ধরলেন তার স্মৃতির ঝুলি। বলতে লাগলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের খবর প্রচার করার জন্য কোনো সরকারি বিশেষ নির্দেশনা ছিল না। কিন্তু আকাশবাণী কলকাতার শুধু এক বা দু’জন নয়, গোটা রেডিও স্টেশনের সব কর্মচারীর আবেগ জড়িয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। সেই সময় টেলিভিশন আসেনি। ঘরে ঘরে রেডিওই ছিল একমাত্র ভরসা। ’

উপেন বলেন, ‘তখন প্রতিদিন ভারতীয় সময় রাত ১০টা থেকে ১০টা ৫ মিনিট পর্যন্ত একটি অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো। নাম ‘সংবাদ পরিক্রমা’। ১০টা ৫ মিনিট থেকে ১০টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত পড়া হতো ‘স্থানীয় সংবাদ’। আর ১০টা ১৫ মিনিট থেকে ১০টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত পড়া হতো ‘সংবাদ বিচিত্রা’।
‘সংবাদ বিচিত্রা’ অনুষ্ঠানটির প্রায় পুরোটাই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর। এছাড়া সেই সময় ‘সংবাদ পরিক্রমা’ ও ‘স্থানীয় সংবাদের’ বেশিরভাগটা জুড়েও থাকত যুদ্ধের খবর।
-কী ছিল সেই জাদুমন্ত্র, যার ফলে এপার বাংলার (পশ্চিমবঙ্গ) সরকারি সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা জড়িয়ে পড়েছিলেন ওপার বাংলার (বাংলাদেশ) মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে?
-প্রশ্ন শুনে একটু হাসলেন আশি বছর বয়সী এই চিরতরুণ। বললেন, ‘আবেগ। আসলে আবেগই দুই বাংলাকে এক করেছিল। মনে হয়েছিল, ওরা আমাদেরই ভাই, বন্ধু। ওদের পাশে দাঁড়াতেই হবে। ’
-এর কারণ কি তৎকালীন পদ্মাপাড়ের মানিকগঞ্জে ফেলে আসা শিকড়?
-‘শুধু তাই নয়। প্রখ্যাত বাচিকশিল্পী ও সেই সময়ে আকাশবাণীর অন্যতম কর্মচারী দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন এপার বাংলার (পশ্চিমবঙ্গ) মানুষ। কিন্তু বেতারের মাধ্যমে তিনিও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এই যুদ্ধে। সেই সময়ে প্রায় ১ কোটি মানুষ ওপার বাংলা ছেড়ে শরণার্থী হয়ে এসেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যদি তাদের বুক পেতে না দিতো, ওই সময় সরকারের পক্ষে পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব হতো না। ’

-কবে থেকে আপনারা অনুভব করলেন যে, এটা বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম?
-‘সেটা ছিল ২৩ মার্চ। ইউএমআই’র টেলিপ্রিন্টারে আসা এক লাইনের একটা ফ্ল্যাশ নিউজ আমাদের আলোড়িত করে তুলল। ‘MUJIBUR RAHAMAN DECLARES BANGLADESH INDEPENDENT’। ওপারে
শুরু হলো প্রতিরোধ। যার যা কিছু ছিল তা-ই নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লেন বাঙালিরা। প্রতিরোধ যতো বাড়ল ততো বাড়ল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পৈশাচিক তাণ্ডব। ’
-কিভাবে পেতেন ওপার (বাংলাদেশ) বাংলার খবর?
-‘২৫ মার্চের তাণ্ডবলীলার কয়েক দিন পরে এক তরুণ আকাশবাণীতে এসে আমার কাছে পৌঁছে দিলেন একটি ক্যাসেট। যাতে রেকর্ড করা ছিল, সেই অভিশপ্ত রাতের ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলোর ওপর হানাদারদের আকস্মিক হামলা ও মানুষের আর্তনাদের শব্দচিত্র। সেই গোলাগুলির শব্দ, করুণ আর্তনাদ তুলে ধরেছিলাম ‘সংবাদ-বিচিত্রা’ অনুষ্ঠানে। মনে পড়ে, অনুষ্ঠান চলাকালে অনেক শ্রোতা সেই দুঃসহ আর্তনাদ সহ্য করতে না পেরে ফোন করে অনুষ্ঠান বন্ধ করার অনুরোধ করেছিলেন। ’
-এপারে চলে আসা মানুষদের সঙ্গে আপনি বহুবার কথা বলেছেন। তখন কেমন ছিল তাদের পরিস্থিতি?
-‘কতো স্বামীহারা তরুণীর কান্না, কতো সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ শুনতে হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। বুলেটবিদ্ধ কতো তরতাজা তরুণের শেষ উচ্চারিত শব্দ, ‘জয় বাংলা’, কতোবার যে রেকর্ড করতে হয়েছে, তা আমি নিজেও জানি না। সেই কান্নার, সেই আর্তনাদের শব্দ আজও আমার কানে ভেসে আসে। (চোখ বন্ধ করলেন। কয়েক মুহূর্ত চুপ) তাদের কথা রেকর্ড করে রাতে এসে অনুষ্ঠানে বাজিয়ে শোনানো হতো। ’
-আকাশবাণীতে কেমন ছিল ১৬ ডিসেম্বরের দিনটি?
-‘শুধু আমরা নয়, প্রতিটি বিভাগে ছিল চূড়ান্ত আবেগ। সবাই খুশিতে ভাসছিল। মনে হলো, আমিই জিতেছি যুদ্ধে। সেদিন ছিল আমাদেরও বিজয়ের দিন। ’
বাংলাদেশ সময়: ১২৩২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৫
আরএম/এএসআর