কলকাতা: ‘ময়লা ঢিলা কাপড় পরা, পাগড়ি মাথায়, ঝুলি ঘাড়ে, হাতে গোটা দুই-চার আঙুরের বাক্স, এক লম্বা কাবুলিওয়ালা মৃদুমন্দ গমনে পথ দিয়া যাইতেছিল। ’
১৮৯২ সালে প্রকাশিত ‘কাবুলিওয়ালা’য় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার কাবুলিওয়ালাদের বর্ণনা দিয়েছিলেন এভাবেই।
তার কলমে ১৯শতক থেকে চলে আসা কলকাতার নগর জীবনের এক রোমান্টিক এবং লক্ষণীয় অংশের জীবনযাত্রাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
আর বিখ্যাত ইংরেজি উপন্যাস ‘কাইট রানার’-এর আফগান লেখক খালেদ হোসাইনি লিখেছেন ১৯৭০ সালে আফগানিস্তানে এক ঘুড়ি পাগল বারো বছরের কিশোর আমিরের কথা।
কলকাতার ময়দান অঞ্চলে গ্রীষ্মের আগে চৈত্রের মাঝামাঝি রোববার (২৯ মার্চ) বিকেলে দেখা মিলবে নাটাই হাতে ঘুড়িবাজদের আনাগোনা। দেখা মিলবে কাবুলিওয়ালাদেরও সংস্কৃতি চর্চার হৈ-হুঁল্লোড়ও!
আকাশে ভাসমান চারকোণা সবুজ, লাল, হলুদ ঘুড়ির মতোই ভাসমান তাদের জীবন। তবে কবিগুরুর দেখা কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গে আজকের কাবুলিওয়ালাদের বেশ ফারাক রয়েছে।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কিছু আগে ব্রিটিশ শাসনামলে প্রথম কলকাতায় আসে এই কাবুলিওয়ালারা। প্রায় দু’শ বছর ধরে তাদের কয়েকটি প্রজন্ম বাস করছে এই কলকাতায়।

ইতিহাস বলছে, বহু যুগ আগে থেকেই আফগানরা গোটা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে শুকনো ফলের ব্যবসা করতেন। যদিও তাদের কলকাতায় আসার পেছনে দেশটির রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
তবে দেশ ভাগের পর আফগানিস্তান থেকে ভারতে আসায় সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় এই কাবুলিওয়ালাদের। কারণ এখন আর ইচ্ছে করলেই আফগানিস্তানের গ্রাম থেকে সরাসরি ভারতে প্রবেশ করতে পারে না।
সূত্রগুলো বলছে, কাবুলিওয়ালা বলা হলেও তারা অনেকেই কাবুলের বাসিন্দা নয়। আফগানিস্তানের কান্দাহার, জালালাবাদ থেকেও অনেকেই এসেছেন কলকাতায়।
এদিকে কলকাতার কাবুলিওয়ালারা নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে বাঁচিয়ে রাখছেন। এর মধ্যে ঘুড়ি উড়ানো, আন্ডা কুস্তি এবং আট্টান।
‘আট্টান’ কাবুলিদের একধরনের নাচ। আন্ডা কুস্তি এক জাতের অদ্ভূত খেলা। এই খেলায় একজন কুস্তিগির অন্য জনের সিদ্ধ ডিম ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেন।
খেলার শেষে যিনি সবচে’ বেশি ডিম রক্ষা করতে পারেন, তিনিই বিজয়ী বলে গণ্য হন।
এখন তো আগের মতো আনাগোনা দেখা যায় না কাবুলিওয়ালাদের! তবে কীভাবে চলে তাদের জীবন-জীবিকা? বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে তিলোত্তমা কলকাতার বড়বাজারে কাবুলিওয়ালাদের ডেরায় হাজির হয়েছিল বাংলানিউজ।
আলাপ-চারিতায় জানা যায়, বেশির ভাগ কাবুলিওয়ালা তাদের পরিবার-পরিজনকে নিজের ওদেশ আফগানিস্তানে রেখে এসেছেন। তারা এক একটি বাড়িতে ‘মেস’ বানিয়ে থাকেন।
একই সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া এবং থাকা। খানিকটা ‘কমিউন’। তবে যারা পরিবারকে নিয়ে কলকাতায় থাকেন, তারা নিজেদের মতো করে আলাদা বাড়িতে বসবাস করেন।
শুধু বড়বাজারই নয়, কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন এই কাবুলিওয়ালারা। সবমিলিয়ে প্রায় দুই হাজারের বেশি আফগান থাকেন এখানে।
কবিগুরুর কাবুলিওয়ালা তার ঝুলিতে করে বিক্রি করতেন আফগানের স্বাদ আর গন্ধ। পেস্তা, বাদাম, কিসমিস আখরোটসহ আরও হরেক রকম শুকনো ফল। তবে এই কাবুলিদের মূল পেশা সুদের বিনিময়ে টাকা ধার দেওয়া।
আর এই সুদে টাকা ধার দেওয়ার ব্যবসাটিও চলে এক ‘অনন্য’ পদ্ধতিতে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই সুদের ব্যবসা চালাতে ‘গদি’ বা 'ডেরা' তৈরি করেছে আফগানরা। এক একটি ডেরা একেকজনের। তবে যার নামে ডেরা তিনি হয়তো আর কলকাতায় নেই। দেশে ফিরে গেছেন। তবে তার নামেই চলছে এই ব্যবসা।
কাবুলিওয়ালারা জানালেন, এই ব্যবসা কঠোর নিয়মের মধ্যে করতে হয়। একজন কাবুলিওয়ালার কাছ থেকে টাকা নিলে অন্য কাবুলিওয়ালা সেই লোককে আর টাকা দিতে পারবে না।
এ নিয়ম ভঙ্গ করলে শাস্তি দেওয়া হয়। আর এই শাস্তি কখনও সব ডেরার লোকজনকে বিরিয়ানি খাওয়ানো কিংবা ছুটির দিনে একটা খাসির দাম দেওয়া।
কলকাতার কাবুলিওয়ালাদের কথা বলতে গেলে আবশ্যিকভাবে চলে আসে বিখ্যাত লেখিকা প্রয়াত সুস্মিতা ভট্টাচার্যের ‘কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ’ এর প্রসঙ্গ।
এদিকে কলকাতায় পাকাপোক্তভাবে অনেক আফগানই সংসার সংসার গড়ে তুলেছেন। মিশে গেছেন কলকাতার অন্তরাত্মার সঙ্গে।
এরপরও আকাশে ঘুড়ি চোখে পড়লেই তাকিয়ে তাকেন তার দিকে। কেউ হয়তো একবার খুলে দেখে নেন পাসপোর্টের ভেতর রাখা স্ত্রী কিংবা দেশে ফেলে আসা সন্তানের ছবি।
আর মনে মনে ভাবেন, হয়তো ঘুড়ির সঙ্গে কাবুল কিংবা জালালাবাদ থেকে আসমানে ভেসে আসবে আফগানিস্তানে শান্তি ফেরার খবর। আর সেই প্রতীক্ষাতেই থাকেন তারা।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৫