দেশে ওষুধের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে । গত কয়েক মাসে লাগানহীন দাম বেড়েছে অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের।
এদিকে হঠাৎ ওষুধের মূল্য অধিক বেড়ে যাওয়া এবং স্থানভেদে দামের ব্যাপক তারতম্যের কারণে ওষুধ কিনতে যেয়ে ভোক্তারা প্রতিনিয়ত নাজেহাল হচ্ছেন বলে তারা অভিযোগ করেছেন।
উৎপাদনকারীদের বক্তব্য, ‘ওষুধ তৈরির কাঁচামালের সরবরাহ কম এবং তার মূল্য বৃদ্ধির ফলে ওষুধের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ’
ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান সাইনবোর্ড পরিবর্তন করে পরিদপ্তর থেকে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর হলেও ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণে তা কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
সর্বশেষ ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার আগেই ওষুধের দাম বাড়া শুরু হয়েছে। কোনো কোনো ওষুধের সিঙ্গেল দাম ১০ পয়সা থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে বলে খুচরা বিক্রেতারা জানিয়েছেন।
ফার্মেসিগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত অরিয়েন্টাল কোম্পানির অ্যাবসরবেন্ট কটনের দাম ১০ টাকা থেকে বেড়ে ২০ টাকা হয়েছে। প্যাকেটের গায়ে ১০ টাকা লেখা থাকলেও আলাদা স্টিকার লাগিয়ে কোম্পানি দাম বাড়িয়েছে বলে জানান এক ফার্মাসিস্ট।
রাজধানীতে বেশ কয়েকটি এলাকা সরেজমিনে ঘুরে ওষুধের দামের তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। ওষুধ কোম্পানি স্কয়ারের ট্যাবলেট পাইলোট্রিপের প্রতি প্যাকেট নীলক্ষেত এলাকায় বিক্রি হচ্ছে ৩৯০ টাকায়। আবার নাখালপাড়ায় বিক্রি হচ্ছে ৪শ’ টাকা পর্যন্ত। আবার শাহ্বাগের দোকানগুলোতে ৩৯৪ টাকা করে।
ওষুধের পাইকারি বাজার বাবুবাজারে নিউলাইফ স্টোরে খবর নিয়ে জানা যায়, এই ওষুধটির দাম বেড়েছে ৩৩০ টাকা থেকে ৩৩৫ টাকা। আর এটির খুচরা মূল্য ৩৮৬ থেকে ৩৯০ টাকা পর্যন্ত। একই কোম্পানির জিপ ক্যাপসুলের দাম ২৫৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৬৫ টাকা। যার খুচরা মূল্য ২৯৮ টাকা।
রাজধানীর ওষুধের দোকানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, সর্দিকাশি আরোগ্যের অতি প্রয়োজনীয় ন্যাজেল ড্রপের দাম কয়েক দিন আগেও ছিল প্রতি ফাইল ৭ থেকে ৮ টাকা। এখন তা ২০ থেক ২৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। হার্টের রোগের সব ওষুধের দাম বেড়েছে। গ্যাসের ওষুধ সারজেল প্রতি পাতা ৩৫ টাকা বিক্রি হতো, এখন তা বেড়ে দাড়িয়েছে ৪২ টাকা।
রেনাটা উৎপাদিত লেটফোর্ড ও নোভিস্তা উৎপাদিত জোলেটা একই জেনেরিকের ওষুধ হলেও দামের ব্যবধান দ্বিগুণ। লেটফোর্ড ২০০ টাকা এবং জোলেটা ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অপসোনিন উৎপাদিত ওষুধ বোপাম ৫০ পিসের প্যাকেট ১৩০ টাকার বিপরীতে ১৭৫ টাকা হয়েছে।
সরজমিনে দেখা যায়, এসএমসি উৎপাদিত জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীগুলো নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। ফেমিকন প্যাকেটের গায়ে ২৫ টাকা লেখা থাকলেও মিটফোর্ডে তা ৩৮ টাকায় এবং খুচরা বাজারে তা ৪৫-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নরডেট-২৮ প্যাকেটের গায়ে ৩৮ টাকা দাম লেখা থাকলেও তা বিক্রি হচ্ছে ৯০ - ১০০ টাকায়।
উল্লেখযোগ্য দাম বৃদ্ধি হয়েছে ওরাল স্যালাইনের। এসএমসির যে ওরস্যালাইন ২০টির প্যাকেট ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হতো, বর্তমানে তা ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতারা বিক্রি করছে ১০০ টাকা প্যাকেট।
এসএমসির পণ্য সম্পর্কে বিক্রেতারা জানান, ‘কোম্পানির প্রতিনিধিরা দোকানে দোকানে না দিয়ে মিটফোর্ডে পাইকারি বাজারে ওষুধ দিয়ে দেন। এক্ষেত্রে কোম্পানির লোকদের সঙ্গে পাইকারদের যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ করেন বিক্রেতারা।
জীবন রক্ষাকারী অন্যতম ওষুধ ল্যাসিক্সের দাম বেড়েছে। প্যাকেটের গায়ে ১০০ ট্যাবলেটের দাম ৬৪ টাকা লেখা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১১০ টাকা।
বর্তমানে বাজারে অতি প্রয়োজনীয় যেসব ওষুধের সরবরাহ রয়েছে তার বেশিরভাগেরই মোড়কে লেখা দাম অনুযায়ী বিক্রি হচ্ছে না। দুই মাস আগে যে ওষুধ ১০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে, তার দাম এখন ২৫ টাকা।
সরজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত কয়েক মাসে বাজারে হার্ট, ডায়াবেটিস, অ্যাজমাসহ দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার ওষুধের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।
অ্যাজমা রোগিদের জন্যে অতি প্রয়োজনীয় ইনহেলারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্ল্যাক্সো ভেন্টোলি ইনহেলারের দাম ২৫০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৫৬০ টাকা হয়েছে। এ দাম অবশ্য নির্ধারিত নয়। ফলে যেমন ইচ্ছা দাম ধরেন বিক্রেতারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ওষুধ কোম্পানির একজন ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা বলেন, প্যাকেটের গায়ে যে দাম লেখা আছে তা থেকে কমিশন দিয়ে ওষুধ দিচ্ছেন পাইকারি বিক্রেতাদের। খুচরা বাজারে কী দামে বিক্রি হচ্ছে তা দেখার দায়িত্ব আমাদের না। এটি দেখবে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। তবে বিদেশি বাজারে ওষুধের কাঁচামালের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান তিনি।
ওষুধ বিক্রেতারা জানান, তারা মিটফোর্ড থেকে বেশি দামে কিনে এনে বিক্রি করছেন। প্যাকেটের গায়ে যা লেখা আছে সেই দামে তারা বিক্রি করতে পারছেন না। কোম্পানি উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে বলে কৃত্রিম সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বাবুবাজার ও মিডফোর্ডের পাইকারি দোকানগুলো ঘুরে কৃত্রিম সঙ্কটের কোন আলামতই পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যালস সোসাইটির (বিপিএস) তথ্যানুযায়ী দেশে রেজিস্ট্রেশনকৃত খুচরা দোকানের সংখ্যা মাত্র ৮৫ হাজার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা প্রায় সোয়া দুই লাখ। এসব দোকানে কীভাবে ও কত টাকায় ওষুধ বিক্রি হচ্ছে এর ওপর কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সেক্রেটারি আব্দুল মোক্তাদির অবশ্য ওষুধের দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ১৮ হাজার ব্রান্ডের ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত হয়। সেখানে সর্বোচ্চ ৫০টি ব্রান্ডের মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে। দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করায় সরকার লাভবান হয়েছে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক (অব.) মেজর জেনারেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ওষুধ প্রশাসনে জনবলের অভাব রয়েছে । তারপরও আমাদের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে মনিটরিং করে যাচ্ছি। ’
জনাব আজাদ বলেন, ‘প্যাকেটের গায়ে লেখা দামের চেয়ে ওষুধের দাম বেশি নিয়েছে এমন অভিযোগ নিয়ে কেউ যদি রিসিটসহ আমাদের কাছে আসেন, সে বিক্রেতার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে এবং দোকান বন্ধ করে দেয়া হবে। ’
এদিকে পরিদফতর থেকে অধিদফতরে রূপ নেয়ার এক বছর পরও গতিশীল হতে পারেনি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। সাইনবোর্ড ছাড়া তেমন কিছুর পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। জনবল, যন্ত্রপাতি ও অভিযান সহায়ক যানবাহনের অবস্থাও আগের মতো রয়েছে।
নি¤œমানের ওষুধ বিরোধী অভিযানের ঘোষণা দেওয়া হলেও তা পরিচালিত হয়নি। অধিদফতরের এমন দুর্বলতার সুযোগে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে ওষুধের বাজার।
ওষুধ প্রসাশন অধিদফতরই যদি রোগাগ্রস্ত হয় তবে ‘ওষুধের বাজারে ওষুধ দেবে কে’ এমন শংশয় সংশ্লিষ্ট সকলের মনে।
বাংলাদেশ সময় ১৮১৮ ঘণ্টা; ২১ জুলাই ২০১১