ঢাকা: কোনো প্রকার সুপারসিড (জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন) ছাড়া কর্মে প্রবীণতম বিচারপতিকেই বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগের সুপারিশ করেছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও সংবিধান সংস্কার কমিশন। এর জন্য সংবিধানের ৯৫ (১) অনুচ্ছেদ সংশোধনের কথা উল্লেখ করেছে এ দুই কমিশন।
কারণ হিসেবে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন থেকে বলা হয়েছে, অতীতে বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে নির্বাহী কর্তৃপক্ষ নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা নানা সময়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
অপরদিকে সংবিধান সংস্কার কমিশন মনে করে, বর্তমান প্রক্রিয়া ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের শিকার হয়েছে। জ্যেষ্ঠতা বা মেধার ভিত্তির বিপরীতে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব এবং আনুগত্যের বিবেচনায় বিভিন্ন সময়ে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
কী আছে ৯৫ অনুচ্ছেদে
৯৫ (১) অনুচ্ছেদ অনুসারে, প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করবেন।
এই অনুচ্ছেদে কাকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন সেই বিষয়টি স্পষ্ট করে দেওয়া নেই। তাই রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের যে কোনো বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত করেন। এতে একাধিক বার সুপারসিড (জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন) করা হয়েছে।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের বক্তব্য
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন থেকে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি পদে এবং সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে বিচারকদের নিয়োগকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার পূর্বশর্ত। একই সঙ্গে, এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে এর জবাবদিহি কার্যকরভাবে নিশ্চিত করা আবশ্যক। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিভাগ বিভাগ সংস্কার কমিশন সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়োগ ও জবাবদিহির ক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যবস্থার অর্থবহ সংস্কার প্রস্তাব করছে।
প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা সমুন্নত রাখা এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করা অনেকাংশে নির্ভর করে বিচার বিভাগের নেতৃত্বদানকারী ও শীর্ষব্যক্তি প্রধান বিচারপতির ওপর। বিদ্যমান সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বা অন্য কারও পরামর্শ ব্যতিরেকে রাষ্ট্রপতি নিজস্ব প্রজ্ঞা অনুসারে এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু অতীতে বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে নির্বাহী কর্তৃপক্ষ নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা নানা সময়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
‘কমিশন মনে করে যে, বিচার বিভাগের ওপর জনগণের আস্থা বজায় রাখার জন্য প্রধান বিচারপতির নিয়োগকে নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রভাবমুক্ত রাখার লক্ষ্যে সংবিধানে এই মর্মে বিধান থাকা প্রয়োজন যে, রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারককেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন। অর্থাৎ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ বা অন্য কোনো বিকল্প পদ্ধতি রাখা যাবে না। এর ফলে প্রধান বিচারপতির নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রয়োগের সুযোগ বহুলাংশে লোপ পাবে। সেই লক্ষ্যে সংবিধানের ৪৮(৩), ৫৫(২) এবং ৯৫(১) অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। ’
সংবিধান সংস্কার কমিশনের বক্তব্য
সংবিধান সংস্কার কমিশন বলেছে, বর্তমান সংবিধান অনুসারে, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি (অনুচ্ছেদ ৯৫)। তবে এই প্রক্রিয়া ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের শিকার হয়েছে। জ্যেষ্ঠতা বা মেধার ভিত্তির বিপরীতে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব এবং আনুগত্যের বিবেচনায় বিভিন্ন সময়ে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
‘কমিশন আপিল বিভাগের বিচারকদের মধ্য থেকে মেয়াদের ভিত্তিতে জ্যেষ্ঠতম বিচারককে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদানের সুপারিশ করছে। এটি রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের স্বার্থে কনিষ্ঠ বিচারক কর্তৃক উপেক্ষার মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির নিয়োগে নির্বাহী/রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রোধ করবে। ’
সুপারিশের যৌক্তিকতায় বলা হয়েছে, সাংবিধানিক গণতন্ত্রে, যেখানে বিচার বিভাগ হচ্ছে সংবিধানের অভিভাবক এবং ন্যায়বিচারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তদাতা, সেখানে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়াতে অবশ্যই ন্যায্যতা, নিরপেক্ষতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠতম বিচারককে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের রীতি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সততার একটি মূল ভিত্তি হয়ে উঠেছে। জ্যেষ্ঠতার নীতি মেধা বা ব্যক্তিগত পছন্দের মতো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে না, বরং একটি নির্মোহ মানদণ্ডের ওপর নির্ভরশীল, সেটি হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টে কাজের মেয়াদ। একজন জ্যেষ্ঠ বিচারক দশকের পর দশক সাংবিধানিক ও আইনি সমস্যার ফয়সালা দেওয়ার কারণে অতুলনীয় অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। জ্যেষ্ঠতার নীতি নিয়োগপ্রক্রিয়ায় স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ হ্রাস করে, কেননা এটি বিচারকদের ধারাবাহিক কাজ এবং বিচারিক মনোভাব প্রদর্শনের কারণে পদোন্নতি নিশ্চিত করে।
‘জ্যেষ্ঠতম বিচারককে নিয়োগ দেওয়ার রীতি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার রক্ষাকবচ। এটি প্রধান বিচারপতির নিয়োগে রাজনৈতিক বা নির্বাহী এখতিয়ার ব্যবহার করার কোনো সুযোগ তৈরি হতে দেয় না। এই নীতি বিভিন্ন দেশের বিচারব্যবস্থায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভারতে দ্বিতীয় বিচারপতি মামলা (১৯৯৩) এবং পরবর্তী রায়গুলোতে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় বিচারিক প্রাধান্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। জ্যেষ্ঠতার প্রতি আনুগত্যের মাধ্যমে বিচার বিভাগ নিজেদের নির্বাহী ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে রক্ষা করে। আন্তর্জাতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অন্য দেশগুলো রাজনৈতিক নিয়োগের বিপদগুলো স্বীকার করে জ্যেষ্ঠতা বা নিরপেক্ষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারিক নেতৃত্ব নিয়োগের রীতি অনুসরণ করেছে। ’
কমিশন থেকে আরও বলা হয়, জ্যেষ্ঠতম বিচারক এরই মধ্যে আদালতের কার্যপ্রণালি, প্রটোকল এবং প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকেন। প্রধান বিচারপতি কেবল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান নন; তিনি বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, যেমন মামলার বরাদ্দ, বেঞ্চ গঠন এবং নিম্ন আদালতগুলো তদারকি করা তার কাজের আওতায় পড়ে। মেধার গুরুত্ব অপরিসীম হলেও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে উন্নীত (পদে আপগ্রেডেড) বিচারক নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা এবং প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেন। জ্যেষ্ঠতার নীতি বিচারকদের মধ্যে ন্যায়বোধ, পারস্পরিক সম্মান ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। প্রত্যেক বিচারক জানেন যে প্রধান বিচারপতির পদে তাদের উত্তরণ একটি নিরপেক্ষ নীতির ওপর নির্ভরশীল, কোনো ব্যক্তিগত যোগাযোগ বা নির্বাহী হস্তক্ষেপের ওপর নয়। এটি বিচার বিভাগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব হ্রাস করে।
সংশোধনী প্রস্তাব
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন সংবিধানের ৯৫ (১) অনুচ্ছেদে উপ-অনুচ্ছেদ যুক্ত করে রাষ্ট্রপতি ‘আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করিবেন’ মর্মে সংশোধন করতে সুপারিশ করে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বাংলানিউজকে বলেন, এই সুপারিশের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। প্রধান বিচারপতি নিয়োগ এভাবেই হওয়া উচিত। তাহলে রাজনৈতিক প্রভাব কমবে। এছাড়া প্রধান বিচারপতি হওয়ার জন্য কেউ ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করবেন না। একসময় বাংলাদেশে এভাবে নিয়োগ হতো। পরে সুপারসিডের চর্চা শুরু হয়। সেটা কখনো বিচার বিভাগের জন্য মঙ্গল বয়ে আনেনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫
ইএস/এইচএ/