ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

পাকিস্তান ছেড়ে অজানার পথে দাউদ ইব্রাহিম

আহ্সান কবীর, কান্ট্রি এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৯ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১১
পাকিস্তান ছেড়ে অজানার পথে দাউদ ইব্রাহিম

ঢাকা: আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের মত একই পরিণতির ভয়ে মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিম (৫৬) পাকিস্তান ছেড়েছেন। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এরকমই জানিয়েছে।



একটি হিন্দি ওয়েবসাইট জানিয়েছে, ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত ২ মে পাকিস্তানে মার্কিন কমান্ডো হামলায় ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর থেকে সেখানে আশ্রয় নেওয়া সন্ত্রাসীরা আতংকে দিন কাটাচ্ছে। এর মধ্যে দুবাইর আস্তানা ছেড়ে গত কয়েক বছর ধরে পাকিস্তানে আশ্রয় নেওয়া ‘ডি কোম্পানি’ বস দাউদ ইব্রাহিম তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় শেষ পর্যন্ত তিনি আপাত নিরাপদ আশ্রয় পাকিস্তান ছেড়েছেন। তিনি বিগত কিছুদিন ধরে ভয়ে ছিলেন যে, পাকিস্তানে থাকলে তারও ওসামা বিন লাদেনের মত পরিণতি হতে পারে।

উল্লেখ্য, ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে যে মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীদের তালিকা হস্তান্তর করা হয়- তাতে এক নাম্বারে ছিল দাউদের নাম। ভারতের এ তালিকা হস্তান্তরের ঘটনাও দাউদকে পেরেশানিতে ফেলে দিয়েছিল।

ওই লিস্টে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি এবং কাশ্মীরি স্বাধীনতা সংগ্রামীও রয়েছে; যাদের ভারত সন্ত্রাসী বলে গণ্য করে। তালিকায় এ ধরনের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন লস্কর-ই-তৈয়বার প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ সাঈদ ও জাকিউর রহমান লখভী। তালিকায় দাউদ ইব্রাহিমের মত আরও কয়েকজন ভারতীয়র নাম রয়েছে যারা ভারতে অপরাধ সংঘটনের পর পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে।

ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পাকিস্তানকে দেওয়া ভারতের ওই তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীরা আতংকে আছে এটা ভেবে যে, যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে যে কোনও সময়ে ভারতীয় কমান্ডোরা পাকিস্তানে হানা দিয়ে লাদেনের মতই ওদেরও হত্যা করতে পারে ।

আর অন্যদিকে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক যে আচরণ তা দেখে সেখানে আত্মগোপন করে থাকা সন্ত্রাসীরা  পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের ওপর এখন আর ভরসা রাখতে পারছে না। তাদের আশংকা, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিজেদের শক্ত ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তান এখন মরিয়া। তাই যে কোনও সময় পাকিস্তান তাদের বলির পাঁঠা বানিয়ে ফেলতে পারে- ।

তাই ওদের চোখে ঘুম নেই।

দাউদের বিশ্বস্ত লোকদের কেউ যে কোনও সময়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসতে পারে। এমনটি হলে করাচির নিরাপদ আশ্রয়ে ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ নিধনযজ্ঞ- --এই ভীতি ‌`ডি কোম্পানি`কে বেসামাল করে দিয়েছে।

সূত্র জানায়, সার্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায় দাউদ বাহিনী আশংকা করছিল যে, তাদের করাচির সুরক্ষিত আস্তানায় আগামী ক`দিনের মধ্যেই হামলা হতে পারে। এ আশংকায় তড়িঘড়ি পাকিস্তান ছেড়েছেন দাউদ ও তার শীর্ষ স্যাঙ্গাতরা। কিন্তু তারা পাকিস্তান ছেড়ে কোথায় গিয়েছে তা জানাতে পারেনি সূত্র।

তবে অনেকেই অনুমান করছেন, দাউদ ইব্রাহিম আফ্রিকার কোনও দেশ, অস্ট্রেলিয়া, উপসাগরীয় কোনও দেশ, ইউরোপের কোনও দেশ এমনকি যক্তরাষ্ট্রেও আত্মগোপনে গিয়ে থাকতে পারেন। বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রে মাদক চোরাচালানে তার শক্ত নেটওয়ার্ক রয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, দাউদ সম্ভবত আপদকালীন ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তান ছেড়ে অন্য কোথাও আত্মগোপন করেছে। বিপদের ধাক্কাটা কেটে যাওয়ার পরপরই আবার ফিরে আসবে তুলনামূলক নিরাপদ এ আস্তানায়।

দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মাদক চোরাচালানি রিং পরিচালনাকারী হিসেবে কথিত ‘ডি কোম্পানি’ বস দাউদ ইব্রাহিমের আস্তানা ছিল ভারতের চলচ্চিত্রনগরী মুম্বাই। গোয়েন্দা সূত্রের মতে, ১৯৮৬ সালে মুম্বাই ছেড়ে আরব সাগরের ওপারের তেলসমৃদ্ধ দেশ আরব আমিরাতের দুবাইতে গিয়ে আস্তানা গাড়ে দাউদ।

১৯৯৩ সালে মুম্বাইতে সিরিয়াল বোমা হামলার পরিকল্পনাকারী হিসেবে ভারতের করা দাগী আসামিদের তালিকায় ১ নম্বরে আছেন দাউদ। ১৯৯২ সালে গুজরাটের দাঙ্গায় সাম্প্রদায়িক দল শিবসেনা ও উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে শত শত মুসলিম নিধনের প্রতিশোধ হিসেবে নেওয়া ওই সিরিজ বোমা হামলায় ২৫৭জন নিহত ও আহত হন ৭শ’রও বেশি।

এ ঘটনার পর আরব আমিরাতসহ উপসাগরীয় দেশগুলোতে ভারতীয় গোয়েন্দা এবং ওইসব দেশের পুলিশি তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে দাউদ পাকিস্তানে পালিয়ে যান।

উল্লেখ্য, ওইসব দেশের সঙ্গে ভারতের বন্দি বিনিময় চুক্তি রয়েছে।
 
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে, দাউদ ইব্রাহিম পাকিস্তানে আল কায়েদা ও নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামী জঙ্গী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। দিল্লি বারবার ইসলামাবাদকে তাগাদা দিয়েছে তাকে হস্তান্তরে। জবাবে পাকিস্তান প্রতিবারই জানিয়েছে দাউদ ইব্রাহিম পাকিস্তানে নেই।

পাকিস্তানের খ্যাতিমান ক্রিকেটারদের সঙ্গে দাউদ ইব্রাহিমের সম্পর্ক বেশ আলোচিত। এদের মধ্যে সবার আগে নাম আসে লিজেন্ড ক্রিকেটার জাভেদ মিয়াঁদাদের। ২০০৬ সালের জুলাইয়ে দুবাইয়ে এক চোখ ধাঁধানো পার্টিতে জাভেদের ছেলে জুনাইদ বিয়ে করেন দাউদ ইব্রাহিমের মেয়ে মাহরুখ ইব্রাহিমকে। সে হিসেবে দাউদ ও জাভেদ সম্পর্কে পরস্পর বেয়াই হন।

একজন পুলিশ কনস্টেবলের সন্তান এবং স্কুল থেকে ঝড়ে পড়া দাউদ অপরাধী হিসেবে নজরে আসে মুম্বাইর এক সময়ের ডন করিম লালার ক্যাডার হিসেবে। দাউদ ইব্রাহিমের জীবন নিয়ে গবেষণাকারী পাকিস্তানি সাংবাদিক গুলাম হাসনাইনের মতে- দাউদ ইব্রাহিমের জীবন অনেকটাই মারিয়ো পুজো’র ক্লাসিক উপন্যাস গডফাদারের ডন ভিটো কর্লিয়নির মত। হাসনাইন বলেন, ‘তিনি জীবন যাপন করেন রাজার মত। ’  

তবে সেই রাজা- একসময়ে এবং সত্যি করে বলতে গেলে এখনও যার ভয়ে আতংকে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়েছে অনেকের, এখন তিনিই আছেন আতংকে- এটা এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অবশ্যই।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৪ ঘণ্টা, ১৯ জুন, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।