ঢাকা: অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মানুষের সীমাহীন লোভ, মড়ক, সেনাশাসনামলে নিরাপত্তার উদ্ভট কারণ দেখিয়ে শতবর্ষী বৃক্ষের নির্বিচার নিধন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে এক সময়ের সবুজ ঢাকা এখন অনেকটাই প্রাণহীন, রুক্ষ ও ম্যাড়ম্যাড়ে। ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে বৃক্ষের শীতল ছায়া।
ঢাকা শহরে এখনো যত গাছ আছে সেগুলোর একটি বড় অংশ উজার হওয়ার হুমকির মুখে। এসব বৃক্ষের স্থান দখল করে নিচ্ছে অপরিকল্পিত বাড়িঘরের বিস্তার। ফলে বৃক্ষশোভিত ঢাকার অপরূপ নিসর্গ ক্রমশ হয়ে উঠছে ছায়াহীন উষর। বিমল বায়ুর বদলে ঢাকার আকাশ ঘিরে আছে দূষিত বায়ুর বিষবাষ্পে। আর এই অবস্থাটা ভাবিয়ে তুলেছে প্রকৃতিপ্রেমী , পরিবেশবাদী, উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও সচেতন মানুষদের।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক ড. কাজী জাকের হোসেনের মতে, একটি জনপদে জনসংখ্যার তিনগুণ গাছ অথবা মোট ভূমির ২৫% গাছপালা থাকা দরকার। অথচ সারাদেশে রয়েছে ১৬%। ঢাকার অবস্থা আরো খারাপ। সঠিক সংখ্যা কারো কাছে না থাকলেও তা দুই-তিন লাখের বেশি হবে না বলেই তিনি জানান।
ঢাকা শহরের অনেক বড় বড় গাছ মারা যাচ্ছে ৷ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান জানান, গত তিন বছরে রাজধানীর প্রায় দুই হাজারের বেশি গাছ মারা গেছে বলে পবা মনে করে ৷
বন বিভাগের হিসেবে হাইকোর্ট এলাকায় ৪-৫টি,পুলিশ হেডকোয়ার্টারের সামনে একটি, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথ, নির্বাচন কমিশনের উত্তর দিকের প্রবেশ পথ এবং নির্বাচন কমিশনের রাস্তার পাশে ৯-১০টি, উত্তরা বনবীথি কমপ্লে¬ক্সের দক্ষিণ দিকে এবং আবদুল্লাহপুর মোহাম্মদপুর হাউজিং-এ একটি, জুরাইন কবরস্থানে একটিসহ বেশ কয়েকটি রেইনট্রি গাছ সম্প্রতি মারা গেছে।
বন বিভাগের এ হিসেবকে হাস্যকর বলে মনে করেন আবু নাসের খান।
উদ্ভিদ বিজ্ঞানী অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা বলেন, ২০১০ সালে আমগাছকে দেশের জাতীয় বৃক্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ ঢাকায় আমগাছও চোখে পড়ে না। পার্ক ও রাস্তার দুই পাশের গাছ মরে যাচ্ছে। ভালো নেই ঢাকার গাছ। সব মিলিয়ে ভালো নেই রাজধানী।
গাছের সঠিক হিসাব নেই
ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার আয়তন ৩০৪ বর্গকিলোমিটার। এই আয়তনের ঠিক কতভাগ গাছ আছে তার কোনো হিসাব নেই বন বিভাগ বা খোদ সিটি করপোরেশনে। ডিসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলামও গাছের সঠিক হিসেব নেই বলে জানিয়েছেন।
ঢাকা সামাজিক বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা উম্মে হাবিবা বলেন, ঢাকা শহরে গাছের কোনো পরিসংখ্যান কখনোই করা হয়নি। এজন্য বলা যাচ্ছে না ঠিক কতভাগ এলাকায় গাছ আছে।
রাজধানীতে মূলত বোটানিক্যাল ও বলধা গার্ডেনের পাশাপাশি রমনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শেরে বাংলানগর ও এয়ারপোর্ট এলাকাতেই অধিকাংশ গাছ দেখা যায়।
মহানগরীর মধ্যে কেবল তেজগাঁও, কোতোয়ালি ও রমনা থানা এলাকায় ৯টি উদ্যান আছে। বাকি অঞ্চলে শুধু ইট-পাথরের বাড়ি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।
বন বিভাগের হিসেবে মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে ৭৫ হাজার ও বলধা গার্ডেনে প্রায় ১৭ হাজার গাছ আছে।
আরবরিকালচারের হিসেবে রমনা উদ্যানে পাঁচ হাজার ৫০টি ও সোহরাওয়ার্দীতে সাড়ে তিন হাজারের মতো গাছ আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরবরিকালচারের হিসাব অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গাছ আছে প্রায় পাঁচ হাজার।
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিজ্ঞান বিভাগের হিসেবে তাদের ক্যাম্পাসে প্রায় তিন হাজার গাছ আছে।
সিটি করপোরেশনের হিসেবে বঙ্গভবনে আট হাজার ৭শ ৮২, ধানম-ি লেক এলাকায় আছে চার হাজার ৮শ’ ৭০টি গাছ।
ওসমানী উদ্যানে গাছের কোনো হিসাব নেই সিটি করপোরেশনের কাছে। পাওয়া যায়নি গণভবন, চন্দ্রিমা উদ্যান ও সংসদ ভবন এলাকার গাছের সঠিক হিসাব।
বিগত পাঁচ বছরে সামাজিক বন বিভাগ ঢাকার রাস্তাঘাট ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গাছ লাগিয়েছে ৪৮ হাজার ৬শটি।
এছাড়াও গণপূর্ত বিভাগের আরবরিকালচার বিভাগ সচিবালয়, সরকারি অফিস, ওসমানী মিলনায়তন, হাইকোর্ট, ধানম-ি এলাকার ভিআইপি বিভিন্ন স্থাপনা, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন, মিন্টো রোড, ইস্কাটন ও সিদ্ধেশ্বরীর সরকারি বাড়ি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিভিন্ন সরকারি ভবনে বেশকিছু গাছ রোপন করেছে।
তবে সব মিলিয়ে ঢাকায় তিন লাখের বেশি বৃক্ষ নেই বলে ড. কাজী জাকের হোসেন ও আবু নাসের খান মনে করেন।
ক্রিকেট বিশ্বকাপ উপলক্ষে ঢাকা শহরে সৌন্দর্য বর্ধন ও উন্নয়নের নামে মিরপুর স্টেডিয়াম সংলগ্ন রাস্তা, প্রশিকা ভবন থেকে যে রাস্তা চিড়িয়াখানার দিকে চলে গেছে সেই হাজী রোডের দুই পাশের কয়েকশ’ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, রাজধানীর পরিবেশ উন্নয়ন ও সৌন্দর্যের জন্য গাছ লাগানো জরুরি। অথচ বিশ্বকাপে সৌন্দর্যের নামে পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে মিরপুর স্টেডিয়ামের বিপুল সংখ্যক গাছ হত্যা করা হয়েছে। যারা এ ঘৃণ্য কাজে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকা বলেন, নানা কারণে গাছপালা মরে যাচ্ছে। আমরা গাছ রক্ষার চেষ্টা করছি তবে এ ব্যপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে। শুধু সিটি কর্পোরেশনকে দায়ি করলে চলবে না।
রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের ডিভাইডারে ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগিয়েছে ডিসিসি, রাজউক ও সড়ক বিভাগ। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান গাছের যথাযথ পরিচর্যা নেয় না। অনেক সড়কদ্বীপেই চোখে পড়ে পাকুড়, মেহগনির মতো বৃহৎ গাছের চারা। কিন্ত এসব গাছের চেহারা একেবারেই মলিন ও জীর্ণ।
কবি শহীদ কাদরী ঢাকার গাছগাছালির দুর্দিনের কথা ভেবেই বোধহয় লিখেছিলেন-
"আমি করাতকলের শব্দ শুনে মানুষ
আমি জুতোর ভিতর মুজোর ভিতর সেঁধিয়ে যাওয়া মানুষ
এবার আমি গ্রামে গিয়ে, যদি ট্রাক ভর্তি গাঁদা নিয়ে ফিরি
হে শহরের মানুষ, তোমরা আমায় চিনতে পারবে তো"?
এখন ঢাকার চারপাশে গর্জে উঠছে কেবল করাতকল আর করাতকল। বৃক্ষের শোভন ছবি মুছে দিয়ে তাকে গ্রাস করছে কংক্রিটের জঙ্গল। আর তাতে সত্য হয়ে উঠছে ‘ ইটের পরে ইট /মধ্যে মানুষ কীট’।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৬ ঘণ্টা, মে ৬, ২০১১