ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর: দেশপ্রেমের কবিতা

মামুন রশীদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০২১
বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর: দেশপ্রেমের কবিতা

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে মহান বিজয় দিবসে প্রকাশ পেয়েছে কবি শিহাব শাহরিয়ার সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর: দেশপ্রেমের কবিতা’। বইটিতে সূচিভুক্ত হয়েছেন ১৫০ কবি।

২০২১ আমাদের জন্য স্মরণীয় বছর। অতিমারী করোনাকাল পেরিয়ে এসে আমরা ২০২১-এ উদযাপন করছি আমাদের বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী। এ বছরই আমরা উদযাপন করেছি আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এই একই বছর আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের প্রেরণা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ।

বাঙালির মুক্তিদাতা বঙ্গবন্ধু যে ভাষণের মাধ্যমে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, আমাদের স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষা দিয়ে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা দিয়েছেলেন সেই ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হয়েছে এবার। আমাদের মুক্তিসংগ্রাম, স্বাধীনতার এবং বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর সঙ্গে মিলিয়ে থাকা ২০২১, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষও। সব মিলিয়ে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ২০২১ বাঙালির জীবনের উদযাপনের বছর। এইসব আয়োজনকে সামনে রেখেই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রকাশনা দেশপ্রেমের কবিতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে একশ জন এবং বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে পঞ্চাশ জন মিলিয়ে দেড়শ জন কবির কবিতাকে দুই মলাটের ভেতরে রাখার এই আয়োজনের সম্পাদক কবি শিহাব শাহরিয়ার। ১৯৭১-২০২১ এই পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ অসংখ্য কবির উজ্জ্বল পঙ্‌ক্তি সমৃদ্ধ হয়েছে। তাদের মাঝে থেকে দেড়শ জনকে সূচিবদ্ধ করার কাজটি নিঃসন্দেহে দুরূহ। সেই দুরূহ এবং কঠিন কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন হওয়ায় বিজয়ের দিনেই প্রকাশ পেয়েছে বইটি।  

বাংলাদেশের অন্যতম কবি শামসুর রাহমানের ‘তিনি এসেছেন ফিরে’ শিরোনামের এই কবিতার মধ্য দিয়ে দেড়শ কবির সংকলনটি শুরু হয়েছে। বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতায় বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের কবি শামসুর রাহমানকে দিয়ে শুরু হওয়া সংকলনে এরপর একে একে সূচিভুক্ত হয়েছেন— আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, ফজল শাহাবুদ্দীন, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, আল মাহমুদ, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবুবকর সিদ্দিক, দিওয়ার, বেলাল চৌধুরী, ওমর আলী প্রমুখ।

বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে বইটি প্রকাশের প্রাসঙ্গিকতা প্রসঙ্গে সম্পাদক কবি শিহাব শাহরিয়ার ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আমরা মনে করি, প্রিয় মাতৃভূমির সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য দেশপ্রেমের কবিতা নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ হওয়া উচিত। কারণ, কবিতার মূলত কয়েকটি বিষয় যেমন: দেশ, সমাজ, মানুষ, প্রেম-প্রকৃতি এবং ধর্ম বা আধ্যাত্মিক চিন্তা। আমাদের কবিরা কবিতার ইত্যকার সব বিষয় নিয়েই কবিতা লিখেছেন বা লিখছেন, তবে এদেশের কবিদের লেখা স্বাধীনতা ও দেশাত্মবোধক কবিতা বাংলাসাহিত্যের একটি সমৃদ্ধ ফসল। সুতরাং বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আমি বিগত প্রায় এক বছর ধরে নিবিড় ভাবনা, চিন্তা ও পরিকল্পনায় দেশের প্রয়াত ও প্রবীণ এবং নবীন মিলিয়ে মোট ১৫০ জন দীপ্যমান কবির দেশপ্রেমের কবিতা (১৯৭১-২০২১) নিয়ে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজটি করেছি। এখানে উল্লেখ্য, এতে বিবেচনায় রেখেছি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ অর্থাৎ ১০০ বছর এবং বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী অর্থাৎ ৫০ বছর, এই সংখ্যা দুটি (১০০+৫০=১৫০) মনে রেখেই ১৫০ জন কবির ১৫০টি কবিতা নির্বাচন করা হয়েছে। শুরু করেছি বিভাগোত্তর বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের কবিতা দিয়ে এবং কবিদের বয়সানুক্রমে কবিতা উপস্থাপন করা হয়েছে। ’

স্বাধীনতার স্বপ্ন আমাদের আজন্ম। তারপরও বার বার নানাভাবে আমাদের শাসিত হতে হয়েছে। বারে বারে লুটেরা বণিকের দল এসে আমাদের ওপর শাসনের ছড়ি ঘুরিয়েছে। শাসিত এবং শোষিত বাংলার মানুষ স্বাধীনতার জন্য বার বার উদ্যমী হয়েছে। কখনো কখনো সাময়িক মুক্তি মিললেও, আবারো কোনো না কোনোভাবে বাঙালিকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা চলেছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ফসল ১৯৪৭-এর দেশভাগ। কিন্তু সেই দেশভাগও আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধনীতার পূর্ণ স্বাদ দিতে পারেনি। আমাদের ওপর আবারো শাসনের ছড়ি ঘোরাতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। দীর্ঘ তেইশ বছর আমাদের শোষণ করা পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি প্রকৃত মুক্তির স্বাদ পায়, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জন করে বিজয়, প্রিয় স্বাধীনতা। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সাক্ষী কবিরাও। আলোচ্য গ্রন্থে সম্পাদক সূচিভুক্ত করার সময়ে তাই বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি, নব্বই দশকের কবিদের যেমন রেখেছেন তেমনি একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দুটি দশকের কবিদের কবিতাও স্থান দিয়েছেন। পঞ্চাশের দশকের কবিরা, যেমন দেখেছেন দেশভাগ, তেমনিভাবে তাদের চেতনায় রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম। ষাট এবং সত্তরের দশকের অনেক কবির রয়েছে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা। আর আশি এবং নব্বইয়ের দশকের কবিদের রয়েছে বাংলাদেশের জন্মের পর, আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা, জাতির জনককে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে আমাদের আবারো পেছনের দিকে ঠেলে দেবার ষড়যন্ত্র, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম দেখা ও অংশ নেবার অভিজ্ঞতা। অন্যদিকে এশবিংশ শতাব্দীর প্রথম দুটি দশকের কবিরাও ইতোমধ্যে অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ, তারা দেখছেন অন্য বাংলাদেশ। যেখানে উন্নয়ন ও অগ্রগতির ত্বড়িৎ যাত্রায় বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে পৌঁছে গেছে।

তাই ‘বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর: দেশপ্রেমের কবিতা’ বইয়ে সূচিভুক্ত সাতটি দশকের কবিদের কবিতার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে সামগ্রিক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। উঠে এসেছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অমর অক্ষয় কীর্তিও।
এক্ষেত্রে কবি শামসুর রাহমানের ‘তিনি এসেছেন ফিরে’ কবিতাটি উদ্ধৃত করছি—

‘লতাগুল্ম, বাঁশঝাড়, বাবুই পাখির বাসা আর
মধুমতি নদীটির বুক থেকে বেদনাবিহ্বল
ধ্বনি উঠে মেঘমালা ছুঁয়ে
ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়।

এখন তো তিনি নেই, তবু সেই ধ্বনি আজ শুধু
তাঁরই কথা বলে;
মেঘনা নদীর মাঝি যখন নদীতে
ভাটিয়ালী সুর তোলে, তার
পালে লাগে দীর্ঘদেহী সেই পুরুষের দীর্ঘশ্বাস,
যখন কৃষক কাস্তে হাতে
ফসলের যৌবনের উদ্ভিন্ন উল্লাস দেখে মাতে,
তখন মহান সেই পুরুষের বিপুল আনন্দধ্বনি ঝরে
ফসলের মাঠে,
যখন কুমোর গড়ে মাটির কলস, ঘটিবাটি,
নানান পুতুল চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে,
তখন সৃজনশিল্পে তার
জেগে ওঠে মহান নেতার স্বপ্নগুলি,
উচ্ছ্বসিত লাউডগা, কচুপাতা, কুয়োতলা, পোয়াতি
কুমোর বউ।

ওরা তাঁকে হত্যা ক’রে ভেবেছিল তিনি
সহজে হবেন লুপ্ত উর্ণাজাল আর ধোঁয়াশায়,
মাটি তাঁকে দেবে চাপা বিস্মৃতির জন্মান্ধ পাতালে-
কিন্তু তিনি আজ সগৌরবে
এসেছেন ফিরে দেশপ্রেমিকের দীপ্র উচ্চারণে,
সাধারণ মানুষের প্রখর চৈতন্যে,
শিল্পীর তুলিতে, গায়কের গানে, কবির ছন্দের
আন্দোলনে,
রৌদ্রঝলসিত পথে মহামিছিলের পুরোভাগে। ’

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রকাশনা এবং শিহাব শাহরিয়ারের সম্পাদনায় ‘বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর: দেশপ্রেমের কবিতা’ নিঃসন্দেহে একটি ভালো কাজ। এই বইয়ের কবিতাগুলোর মধ্য দিয়ে পাঠক একই সঙ্গে বাংলা কবিতার সত্তর বছরের ধারাবাহিক একটি পাঠ-অভিজ্ঞতা যেমন অর্জন করতে পারেন, তেমনিভাবে এই দীর্ঘ সময় ধরে লিখতে থাকা কবিদের সঙ্গে সাম্প্রতিকতম কবির কবিতাকেও মিলিয়ে দেখার সুযোগ পান। সময়ের ব্যবধানে বাংলা কবিতার বাঁক বদলের, শব্দ ব্যবহারের দক্ষতায় ভাষার পরিবর্তনকেও যেমন উপলব্ধি করতে পারেন তেমনিভাবে দেশপ্রেমের প্রকাশেও কবিদের বৈচিত্র্যকে অনুভব করার সুযোগ পান।

বইটির প্রধান সম্পাদক লিয়াকত আলী লাকী, সহযোগী সম্পাদক সৌম্য সালেক। এছাড়া গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো নিয়ে মূল্যায়ন গদ্য লিখেছেন ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ। প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী ধ্রুব এষ।

বাংলাদেশ সময়: ১৪২৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০২১
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।