ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস

মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১৩

আলম শাইন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৪
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১৩

দশ-বারো মিনিট পর্যন্ত হুঁশ ছিল না অর্পিতার। কী বীভৎস, কী জঘন্য হত্যাকাণ্ড; মানুষ মানুষের মাংস খায়, এটা কী করে সম্ভব! পৃথিবীর বুকে এমন হিংস্র মানুষজন থাকতে পারে, এটা ওর কল্পনারও বাইরে ছিল।

ভাবছে রাক্ষস গোত্রের কেউ হবে হয়তো এরা! মনে হচ্ছে এদের পূর্ব পুরুষরাই ছিল রূপকথার গল্পের সেই রাক্ষস-খোক্কস। চেহারায়ও সভ্য মানুষের সঙ্গে কোনো মিল নেই।

অর্পিতা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখানে আর এক মুহূর্তের জন্যেও থাকবে না। দূরে কোথাও চলে যাবে। একেবারে পাহাড় পেরিয়ে ওপারের বনে। সমস্যা হচ্ছে, ওই বনেও যে সে নিরাপদ থাকবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। সৈকতে ঘুরে বেড়ানো তো আরও বিপজ্জনক। অথচ সৈকতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে বেশি উপকার হতো। সামুদ্রিক জলযান নজরে পড়লে সাহায্য চাইতে পারত। দ্বীপে এমন কোনো নিরাপদ জায়গা নেই, যেখানে ও পালিয়ে থাকতে পারে। সব মিলিয়ে ভীষণ ঝুঁকিতে আছে অর্পিতা।

নরখাদকদের দিকে নজর রেখে গাছ থেকে নামার চেষ্টা করছে অর্পিতা। হঠাৎ মনে পড়লো খাওয়া-দাওয়া শেষ ওদের, এখন নিশ্চয়ই পানি খাবে। তাই গাছ থেকে না নেমে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পানির সন্ধানে। বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি অর্পিতাকে। মিনিট খানেক অপেক্ষা করতেই দেখতে পেল কয়েকজন নরখাদক খোঁয়াড়ের পেছনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। ওদের গতিবিধির দিকে নজর রাখল অর্পিতা। দেখতে পেল সামান্য দূরে গিয়ে ছোট একটা ডোবায় নেমে উপুড় হয়ে পানি খাচ্ছে চার-পাঁচজন। ডোবাটা আগে নজরে পড়েনি, কয়েকজন একত্রে সেদিকে যাওয়ায় কেবল তা নজরে পড়েছে। পানির সন্ধান পেয়েও অর্পিতা খুশি হতে পারেনি। উল্টো দুশ্চিন্তায় পড়েছে। ওখানে গিয়ে পানি খাওয়া কোনোমতেই সম্ভব নয়। পানি খেতে যাওয়ার মানে হচ্ছে সরাসরি ওদের হাতে নিজকে সমর্পণ করা। তাছাড়া অনুমান করা যাচ্ছে পানি যথেষ্ট নোংরা। বনে এই জলাশয়টা ছাড়া যদি আর কোনো জলাশয় না থাকে, তাহলে প্রচণ্ড বিপদে পড়তে হবে। তবে অর্পিতার বিশ্বাস বনে ঘুরলে আরও জলাশয়ের সন্ধান পাবে। কারণ সমস্ত দ্বীপের পশু-পাখিরা একটা জলাশয়ের ওপর নির্ভর হওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে জঙ্গলাবৃত এই জায়গায় পাখ-পাখালির পক্ষে প্রবেশ করাও সম্ভব নয়। পাখিদের জলপানের জন্য প্রয়োজন খানিকটা খোলামেলা জায়গা। নিশ্চয়ই দ্বীপে জলপানের আরও ব্যবস্থা আছে।

অর্পিতার আর ইচ্ছে নেই গাছে বসে থাকার। গাছ থেকে নেমে দ্রুত পালিয়ে যেতে চায় সে। গাছটার অবস্থান গভীর জঙ্গলে নয়; বলতে গেলে নরখাদকদের ডেরা-কুটিরের কাছাকাছি। তাই এদিকে ওদের যাতায়াত বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

যতটা সম্ভব দ্রুত নামতে হবে গাছ থেকে। অর্পিতা গাছ থেকে নামার প্রস্তুতিও নিলো। কিন্তু নামতে গিয়ে বাঁধল বিপত্তি। গাছে চড়তে যতটা সহজ হয়েছে, ততটা সহজে নামতে পারছে না এখন। হেলেপড়া বাঁকানো গাছ হলেও যুৎসই জায়গায় পা ঠেকিয়ে নামতে পারছে না। আবার অত উপর থেকে লাফিয়ে নামাও ওর পক্ষে সম্ভব নয়। লাফিয়ে নামলে হাত-পা ভেঙে যেতে পারে।

ধীরে ধীরে চেষ্টা করতেই নামার একটা মাধ্যম পেয়েছে। এক পা পিছলে কিছুটা নেমেছেও, আর অমনি দেখতে পেলো বনের দিকে দুইজন নরখাদক এগিয়ে আসছে। ওদের দেখেই অর্পিতার শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। কপালের দুর্ভোগ ঠেকানো যাচ্ছে না বুঝি আর। ধরা পড়তে যাচ্ছে এখুনি। এমতাবস্থায় গাছ থেকে নামার মানে হচ্ছে নিজ থেকেই ওদের হাতে ধরা দেওয়া। এখন কি করার আছে, তা মাথায় ঢুকছে না অর্পিতার। সেকেন্ডের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কিছু একটা। দৌড়ে পালাবে, না কি গাছে বসে থাকবে। নিজের ওপরে যথেষ্ট রাগ হচ্ছে অর্পিতার। এতক্ষণ পর্যন্ত গাছে বসে না থাকলেই পারত। এতসব রহস্য উদঘাটনের প্রয়োজন ছিল না। বেশি সতর্কতার পরিণতি উল্টো ভয়াবহ হতে যাচ্ছে।

উপায়ান্তর না দেখে অর্পিতা সিদ্ধান্ত নিয়েছে গাছেই বসে থাকবে। নামতে গেলে ওরা দেখে ফেলবে, দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারবে না। তাই চুপচাপ গাছে বসে রইল অর্পিতা। পাতার আড়ালে একটা তে-ডালে বসেছে। এই মুহূর্তে হাঁচি—কাশি এলে নিঃসন্দেহে ধরা পড়ে যাবে। তাই যতটা সম্ভব অর্পিতা নিজকে নিয়ন্ত্রণ করে পাতার আড়ালে বসে রইল। আনুমানিক ১০-১২ ফুট উঁচুতে বসেছে। নরখাদকেরা উপরে তাকালেই ধরা পড়ে যাবে। ভালোয় ভালো ওরা উপরে না তাকালেই হয়। মিনিট খানেক বাদেই দেখতে পেল দুই জনের পেছন পেছন আসছে আরেকজন নরখাদক। ক্রমশ দল ভারী হচ্ছে, বিষয়টা কী! চোখের পলকেই দেখতে পেল দুইজন নারীও ওদের পেছন পেছন আসছে। তবে কারো হাতেই তীর-ধনুক জাতীয় কোনো ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নেই। ঘটনাটা কি ঘটতে যাচ্ছে তা বুঝতে পারছে না। ওদের অনাবৃত শরীর দেখে লজ্জায় ভয়ে অর্পিতা চোখ বন্ধ করে ফেলল। এই প্রথম কাছ থেকে দেখেছে নরখাদকদের। কী ভয়ংকর, কী বীভৎস চেহারা; দেখেই ভিরমি খেলো অর্পিতা!

নরখাদকেরা বনে ঢুকেছে। সবাই গাছের নিচে, অর্পিতা সামান্য উঁচুতে। জীবন-মরণের ফারাক মাত্র কয়েক ফুট। গাছে লুকিয়ে থাকায় বরং বেশি ঝুঁকি বেড়েছে। পাখি শিকারের উদ্দেশে উপরে তাকালেই স্পষ্ট দেখতে পাবে ওকে। পাতার আড়ালে লুকালেও ধরা পড়ে যাবে নিশ্চিত।

নরখাদকেরা বনে পা রেখেই এদিক-সেদিক তাকিয়ে আগে নিশ্চিত হতে চেষ্টা করল হিংস্র জানোয়ারের আনাগোনা আছে কি না। যখন নিশ্চিত হলো আশপাশে ক্ষতিকর কোননো জানোয়ার নেই, তখন মনের আনন্দে হাসতে হাসতে নারী-পুরুষ মিলে আদিম বাসনায় লিপ্ত হলো। কিছু সময় অতিবাহিত হতেই উৎসুক দৃষ্টিতে নিচে তাকালো অর্পিতা। যদিও চোখ খুলতে লজ্জা পাচ্ছে সে। কিন্তু ওদের অবস্থান জানতে হলে চোখ খুলে নিচে তাকাতেই হবে। বাধ্য হয়ে চোখ খুললেও অর্পিতা ভীষণ লজ্জিত হলো। ওদের অপকর্ম নজরে পড়তেই অর্পিতা সঙ্গে সঙ্গে দু’হাতে নিজের চোখ ঢেকে ফেলল। পশুসুলভ বাজে একটা অপকর্ম দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। যা দেখে শঙ্কিত হয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল অর্পিতা।

নরখাদকেরা বনের কিনারে এসে প্রায়ই দলবদ্ধভাবে আদিম বাসনায় লিপ্ত হয়। দিনের বেলায় কুটিরে বিরক্তকর অবস্থায় পড়তে হয় ছোটদের আনাগোনা থাকায়। তাই একান্তে সময় কাটাতে বনের দ্বারপ্রান্তে চলে আসে কয়েকজন মিলে। বিষয়টা এদের কাছে একেবারেই সাধারণ। রাখঢাক করার মতো কোনো কিছু নেইও নরখাদকদের কাছে।

অর্পিতা একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে, এরা সব ধরনের কাজকর্ম দলবদ্ধ হয়েই করে। যেমন কিছুক্ষণ আগে পানি খেতে দেখেছে। তারও আগে গোলাকার হয়ে বসে সবাই নরমাংস মুখে দিয়েছে। শুরুর দিকে দলবদ্ধ হয়ে সৈকত থেকে বহিরাগত লোকটাকে ধরে আনতেও দেখেছে। অর্থাৎ এই পর্যন্ত ওদের চারবার দেখেছে দলবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন কাজকর্ম করতে। অর্পিতা বুঝতে পেরেছে ওদের জীবধারায় পশুসুলভ আচরণের প্রভাব রয়েছে। পশুদের মতোই দলবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করতে পছন্দ করে।

অপকর্ম শেষে নিজেদের মতো করেই বনত্যাগ করল নরখাদকের দল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল অর্পিতা। অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। কী বিচিত্র ওদের আদিমপ্রীতি, বিষয়টা ভাবতেও ঘৃণা লাগছে। তবে অর্পিতার ভাগ্য ভালো যে, এখনো সে নিরাপদে আছে।

নরখাদকের দল বন থেকে বেরিয়ে কিছু দূর যেতেই অর্পিতা নিচে নামলো। এবার পালাতে হবে। ডেরা-কুটিরের আশপাশেও থাকা যাবে না। এদিকে থাকা মোটেও নিরাপদ নয়। বনের অন্যত্র চলে যাবে। বিশাল বনে পালিয়ে থাকা তেমন কঠিন কাজও নয়। হিংস্র প্রাণীর সামনে না পড়লে লুকিয়ে-চুকিয়ে থাকা যাবে। শুধু খেয়াল রাখতে হবে ওদের গতিবিধি। যদিও সেটা কঠিন; তারপরেও চোখকান খোলা রাখতে পারলে পালিয়ে থাকা যাবে।

অর্পিতার ইচ্ছে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ওপারে যাওয়ার। ওর ধারণা ওপারের বনে নরখাদক দলের যাতায়াত কম। যেহেতু ওরা দলবদ্ধ জাতি, সেমতে পাহাড়ের ওপারে কেউ একাকী থাকার কথাও নয়। এখন কথা হচ্ছে, ওখানে যদি অন্যান্য গোত্রের বসবাস থাকে সেক্ষেত্রে বিপদ পিছু ছাড়বে না; বরং বাড়বে। তারপরেও অর্পিতা ঝুঁকি নেবে। পাহাড় ডিঙিয়ে ওপারে যাবে। ভাগ্যে যা আছে, তাই-ই হবে। ভাগ্য নিয়ে আর চিন্তিত নয় সে। সে ভালো করেই বুঝতে পেরেছে, ঝুঁকি না নিলে দ্বীপে টিকে থাকতে পারবে না এক মুহূর্তের জন্যেও।

বেলা বেড়েছে; মধ্য দুপুর এখন। পিপাসায় কাতর অর্পিতা। বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে পিপাসায়। দুই-একটা রসালো ফল খেতে পারলে ভালো হতো। এদিকে ফল-টলও নজরে পড়ছে না। বনের সব জায়গায় সব ধরনের ফল গাছ জন্মেও না অবশ্য। অনুকূল পরিবেশের ব্যাপার-স্যাপার আছে। তাছাড়া পাখ-পাখালির বিচরণের উপরও নির্ভর করে বনের ফল গাছের বিস্তৃতি।

অর্পিতা পাহাড়ের চূড়া বরাবর নিচে দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ের নিচু টিলার খোঁজ করছে। যদিও দ্বীপের এই পাহাড় ততটা উঁচু নয়, পুরুষ মানুষের জন্য ওঠানামা সাধারণ ব্যাপার। নারীদের জন্য কিছুটা কঠিন অবশ্য। তারপরেও উঠতে চেষ্টা করবে অর্পিতা। তাই সে পাহড়ের নিচু দিকের সন্ধান করছে। হাঁটতে হাঁটতে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পাহাড়ের পশ্চিম প্রান্তে চলে এসেছে সে। এদিকের পাহাড় খানিকটা নিচু। আরও কয়েক মিনিট হাঁটতেই লক্ষ্য করল ক্রমশ নিচু হতে হতে পাহাড়টা সৈকতে গিয়ে ঠেকেছে। তাছাড়া এদিকের পাহাড় ততটা খাড়াও নয়। চেষ্টা করলেই উপরে উঠতে পারবে। কোন মতে উপরে উঠতে পারলে ওপারে যেতে তেমন কষ্ট হবে না। চোখের দেখায়ও ভরসা পাচ্ছে অর্পিতা।

ধীরে ধীরে পাহাড়ে উঠল অর্পিতা। খুব বেশি কষ্ট হয়নি উঠতে। উপরে উঠতে পেরে খানিকটা আনন্দ লাগছে। সৈকত, সমুদ্র, নারকেল গাছ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের উপর থেকে। আশার কথা হচ্ছে, নারকেল গাছের নিচে অনেকগুলো শুকনো ডাব-নারকেল দেখতে পেয়েছে অর্পিতা। হাতে স্বর্গ পেয়েছে এবার। যাক, পানির তৃষ্ণা মিটবে নারকেল তলায় গেলে। ধারালো পাথরখণ্ড দিয়ে ডাব ফাটানোর চেষ্টা করবে। দ্বীপের সর্বত্রই প্রচুর ছোট-বড় ধারালো প্রবাল পাথর রয়েছে। সেরকম দুটি পাথর সংগ্রহ করলেই চলবে। হাতুড়ির কাজ হয়ে যাবে। বিশেষ করে ডাব ফাটাতে সমস্যা হবে না। কাজেই দুশ্চিন্তার কিছু নেই। খানিকটা সাহস ফিরে এসেছে অর্পিতার। সারা দিন খাবার পানির সন্ধানে কাটিয়েছে। পানি না পেয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিল। দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে এলেও এখনো পানি খেতে পারেনি। পিপাসায় জিভ ভারী গেছে। তৃষ্ণা সইতে পারছে না আর। দ্রুত নিচে নামার চেষ্টা করছে অর্পিতা। অল্প সময়ের প্রচেষ্টায় সফলও হয়েছে সে। ততক্ষণে অবশ্য বিকেল হয়ে এসেছে।

পাহাড়ের পাদদেশ থেকে কিছুটা দূরে নারকেলতলা। সৈকত লাগোয়া। নারকেল তলায় যাওয়ার কথা ভাবতেই হাত-পা কাঁপতে লাগল অর্পিতার। কারণ সৈকতের খোলামেলা জায়গায় দাঁড়ালেই নরখাদকদের নজরে পড়ার সম্ভাবনা আছে। যদিও সে এখনো নিশ্চিত হয়নি এদিকে ওদের আনাগোনা আছে কি না; তথাপিও সতর্ক হয়ে এগোতে হচ্ছে। এদিকে বিকেলও পেরিয়ে গেছে। বনে আঁধার নেমে এসেছে অনেক আগেই। ভাগ্য ভালো এখনো ভয়ংকর কোনো হিংস্র প্রাণীর মুখোমুখি হয়নি। কয়েকটা শেয়াল নজরে পড়েছিল একবার, তখন সে পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে ছিল। শেয়ালগুলো পলকেই কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। প্রাণীগুলো শেয়াল নাকি বুনো কুকুর তা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি অর্পিতা। অনুমানে ধরে নিয়েছে ওগুলো শেয়াল-টেয়াল হবে। বাঘ বা চিতা থাকলে ভয়ংকর বিপদে পড়বে নিশ্চিত। তবে মনে হচ্ছে না ভয়ংকর হিংস্র প্রাণীর অস্তিত্ব আছে বনে। ওরকম প্রাণী থাকলে এতক্ষণে দুই-একবার হলেও হাঁকডাক শোনা যেত। তাছাড়া কয়েকজন নরখাদক একত্রিত হয়ে তখন খালি হাতে বনে প্রবেশ করত না। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, ভয়ংকর প্রাণীর বিচরণ থাকলে ডেরা-কুটির এতটা ঠুনকো হতো না। উঁচু শক্ত মজবুত ঘর বানাতো। বিষয়গুলো চিন্তাভাবনা করেই অর্পিতা অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছে বনে হিংস্র প্রাণীর আনাগোনা নেই।

নিরাপত্তার ছক কষা শেষ করে অর্পিতা বনপ্রান্তরে বসে আছে। কষ্ট হচ্ছে আরেকটু হোক। সামনে ডাব-নারকেল দেখা যাচ্ছে; খাবার পানির ব্যবস্থা হবে নিশ্চয়ই। ধারালো দুইটা পাথরের টুকরো কুড়িয়ে এনেছে, যাতে ডাব থেঁতলে পানি-শাঁস খেতে পারে। আবছা আঁধার নেমে এলে নারকেলতলায় যাবে। তারপর খেয়েদেয়ে বালিঘরে আশ্রয় নেবে। এই হচ্ছে মোটামুটি ওর পরিকল্পনা।

ইতোমধ্যে সূর্য রক্তিমাভ ছড়িয়ে বঙ্গোপসাগরের বুকে হারিয়ে গেছে। জলের রংও পাল্টে গেছে। জলের দিকে তাকিয়েই অর্পিতা আঁতকে উঠল। কী ভয়ংকর রূপ সাগরের! অথচ এই সাগরেই কয়েক ঘণ্টা ভেসেছিল অর্পিতা। বিষয়টা ভাবতেই পারছে না আর, ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। তার ওপর রয়েছে ভূতপ্রেতের ভয়। সব মিলিয়ে অর্পিতার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। এমতাবস্থায় মনে সাহস ধরে রাখার চেষ্টা করছে সে। এদিকে আকাশ পরিষ্কার থাকায় এখনো পুরোপুরি আঁধার নেমে আসেনি সৈকতে। তাই আবছা আঁধারের অপেক্ষায় রইল। আঁধারে সৈকতের খোলা জায়গায় দাঁড়ালে দূর থেকে কেউ দেখবে না সহজেই। এতে করে নিরাপদে রাত কাটাতে পারবে বালিঘরে ঢুকে।

দেখতে দেখতে আঁধার নেমে এসেছে। প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে অর্পিতা। গা ছমছমে পরিবেশ। পেছনে গহীন বন, সামনে সমুদ্র। হিংস্র প্রাণী, নরখাদক, ভূতপ্রেত নানান কিছুর মোকাবিলা করে রাত কাটাতে হবে। খুব কঠিন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে সে। একজন বীর পালোয়ানের পক্ষেও এমন পরিবেশে রাত কাটানো সম্ভব নয়। ভয়েডরে অর্পিতা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

আশপাশে তাকিয়ে অর্পিতা চুপিচুপি এগিয়ে গেলো নারকেল তলায়। অনেক ডাব-নারকেল পড়ে আছে। গাছের নিচে শুকনো নারকেল পড়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে বড়োসড়ো ডাব পড়ে থাকার রহস্যটা বুঝতে পারছে না অর্পিতা। কাজটা যে নারকেল কাঁকড়ার তাও অর্পিতার জানা নেই। জানা নেই দ্বীপের ভয়ংকর ত্রাস নারকেল কাঁকড়ার হিংস্রতা সম্পর্কেও। তাছাড়া নারকেল কাঁকড়া নিশাচর প্রাণী বিধায় এখনো ওর নজরে পড়েনি। রাত নামলেই কেবল সৈকতে বিচরণ করে এই কাঁকড়ারা। দিনে লুকিয়ে-চুকিয়ে থাকে পাথরের খাঁজে অথবা বালির গর্তে।

অর্পিতার খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে, এখন সে কিছুটা খোশ মেজাজে আছে। তবে একটা কাজ বাকি আছে। যাচাই করে দেখতে হবে ডাবে পানি আছে কি না। পানি ছাড়া ডাব-নারকেল পড়ে থাকলে প্রচণ্ড দুর্ভোগ পোহাতে হবে। দ্রুত ওজন যাচাই করতে একটা ডাব হাতে নিলো সে। ডাবটা ওজনদার হওয়ায় ঘোর বিপদেও মুখে হাসি ফুটে উঠল অর্পিতার। দেরি না করে ধারালো পাথরটা ডাবের মুখের উপরে রেখে আরেকটা বড় পাথর দিয়ে জোরে জোরে আঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে মুখটা ফেটে পানি ছিটকে পড়ল। নাকে-মুখে পানির ছিঁটা লাগতেই অর্পিতা খুব আনন্দিত হলো। দেরি না করে ঢক ঢক করে পানিটুকু গিলে ফেলল। মুহূর্তেই তৃষ্ণা কেটে গেল। এবার শাঁস বের করে পেট ভরে খাবে। প্রয়োজনে একাধিক খাবে, এখানে ডাবের অভাব নেই। অসংখ্য ডাব-নারকেল পড়ে আছে সৈকতে। চলবে...

মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-১
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-২
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৩
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৪
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৫
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৬
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৭
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৮
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৯
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১০
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১১

মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১২

আলম শাইন: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট

বাংলাদেশ সময়: ০৭২৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০২৪
এমজেএফ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।