ঢাকা: দেশের তৈরি পোশাকশিল্পে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। তৈরি পোশাকের ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দিকেই ঝুঁকছে।
উদ্যোক্তারা মনে করেন, আধুনিক মেশিন তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং খরচ কমাতে সহায়ক হবে। তাদের আশা, প্রযুক্তির কল্যাণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প আরও একধাপ এগিয়ে যাবে।
বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় (আইসিসিবি) অনুষ্ঠিত ‘১৯তম ঢাকা আন্তর্জাতিক টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট মেশিনারি এক্সিবিশন (ডিটিজি) ২০২৫’-এ গিয়ে পোশাকশিল্প সংক্রান্ত প্রযুক্তির এক ঝলক দেখা যায়।
চীন, জার্মানি, ভারত, ইতালি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্কসহ ৩৩টি দেশের এক হাজার ৬০০টি স্টল এবং ১১০০-এরও অধিক ব্র্যান্ড তাদের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি প্রদর্শন করে আয়োজনে।
দেশের তৈরি পোশাকের মধ্য দুই ধরনের ফেব্রিক্স রয়েছে- নিট ও ওভেন। এর মধ্যে ওভেন ফেব্রিক্স থেকে তৈরি পোশাকে তুলনামূলক প্রবৃদ্ধি কম হলেও নিট ফেব্রিক্স থেকে তৈরি পোশাকে প্রতিবছরই উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। বাংলাদেশের এই ক্রমবর্ধমান বাজারকে মাথায় রেখে ক্যাপিটাল মেশিন (মূলধনী যন্ত্র) প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এসেছে প্রদর্শনীতে।
এমনই একটি চীনা প্রতিষ্ঠান হাইক্রপ। কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির বৈদেশিক মার্কেটিং বিভাগের পরিচালক যুলি পিং ও কারিগরি পরামর্শ প্রকৌশলী মো. শাহ জামানের সঙ্গে৷
তারা বাংলানিউজকে বলছিলেন, নতুন প্রযুক্তির মেশিনে লেবার কম প্রয়োজন হয় এবং ওয়েস্টেজও (অপচয়) আগের থেকে অনেকাংশে কম হয়। বাংলাদেশের যত ইয়র্ন (সুতা) তৈরির কারখানা আছে সেগুলোর বেশিরভাগই অটোমেশনে চলে যাচ্ছে।
তারা বলেন, আমরা এই প্রদর্শনীতে এসেছি আইডিয়া এক্সচেঞ্জ করার জন্য। এই ডিটিজির প্রায় সব প্রদর্শনীতে আমরা অংশ নিয়েছি৷ সাধারণত প্রযুক্তি সেবা দিয়ে থাকি আমরা। তাই মেলায় আমাদের বিক্রিটা মুখ্য নয়, প্রযুক্তি প্রদর্শনী করছি, পরে যারা বায়ার তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে৷
প্রদর্শনীতে সোয়েটার বুননের অটোমেশিন নিয়ে এসেছে লিয়ান জিং নামের চায়না কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটির মার্কেটিং অফিসার মো. নিরব বলেন, এ বছরের শুরু থেকে আমাদের প্রায় দুইশ মেশিনের ক্রয়াদেশ হয়েছে। আমরা যে মেশিন এনেছি সেগুলো এক সময় ম্যানুয়ালি (হাতে) চলতো। প্রযুক্তির উন্নতি হওয়ায় এখন এসব মেশিন অটোম্যাশন হয়েছে। আগে ম্যানুয়াল মেশিন এক থেকে দেড় লাখ টাকায় পাওয়া যেত। তবে অটোমেশিনগুলো দশ থেকে পনেরো লাখ টাকার মধ্যে পাওয়া যাবে। আগে ম্যানুয়াল অবস্থায় একটি মেশিন একজন অপারেটর চালাতেন। এখন অটোম্যাশন হওয়ার পর একজন অপারেটর দশটি মেশিন চালাতে সক্ষম।
হাতে বোনা তাঁতের জায়গায় স্থান নিয়েছে অটোমেটিক মেশিন। এই মেলায় এমনই আধুনিক মেশিন নিয়ে এসেছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান।
এর মধ্যে রিফা টেক্সটাইল মেশিনারি কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার নুরুল আমিন বাংলানিউজকে বলেন, গত বছর ২০০ মেশিন বিক্রি করা হয়েছে। এ বছর আমাদের প্রত্যাশা এর থেকে বেশি ক্রয়াদেশ পাবো। তবে মেলায় বিক্রি আমাদের মূল লক্ষ্য নয়, প্রদর্শনীটা লক্ষ্য। আগের মেশিনের তুলনায় বর্তমানের মেশিনগুলোতে বেশ কিছু আপগ্রেডেশন হয়েছে। বর্তমান মেশিনগুলোতে ফেব্রিক্সে বিভিন্ন রকমের ডিজাইন করা যায়।
দেশে তৈরি পোশাকসহ প্রায় সব ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানে অত্যাবশ্যক হচ্ছে এয়ার কম্প্রেসার মেশিন। এ প্রদর্শনীতেও এমন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য প্রদর্শন করছে।
প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া প্রাইম এন্টারপ্রাইজের সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার সংকর দাশ বাংলানিউজকে বলেন, আমরা স্ক্রু এয়ার কম্প্রেশন মেশিন নিয়ে মেলায় এসেছি। এই মেশিন টেক্সটাইলসহ সব ধরনের ফ্যাক্টরিতে ব্যবহার করা হয়। গতবারের মেলায় পাঁচটি মেশিন বিক্রি করা হয়েছিল। এবার আশা আরও বেশি হবে।
দেশে দুই-তৃতীয়াংশ রপ্তানিকৃত তৈরি পোশাকের ফেব্রিক আসে তুলার তৈরি কাপড় থেকে। বিশ্ব বাজারে পরিবর্তিত তৈরি পোশাকের বাজারে সুতার কাপড়ের তুলনায় ম্যান-মেইড ফাইভার তৈরি কাপড়ের চাহিদা বেড়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারাও ম্যান-মেড ফাইবারের দিকে ঝুঁকছে।
এ অবস্থায় ইন্দোনেশিয়াভিত্তিক ম্যান-মেইড ফাইভার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এপিআরের ভাইস প্রেসিডেন্ট (মার্কেটিং ও ডাউনস্ট্রিম ডেভেলপমেন্ট) তপন সন্নিগ্রহী বাংলানিউজকে বলেন, এ পর্যন্ত আমরা চারবার মেলায় অংশ নিয়েছি৷ আমরা মূলত ম্যান-মেইড সেলুলোজ ফাইবার বিক্রি করে থাকি। এটি মূলত এক ধরনের গাছের ছাল থেকে প্রক্রিয়া করে প্রথমে পাল্প, পরে পাল্প থেকে ফাইভার ও ফাইভার থেকে কৃত্রিম সুতা তৈরি হয়। যা দিয়ে কাপড় তৈরির কাচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়ে থেকে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে ম্যান-মেইড ফাইভারের ব্যবসা আমাদের অনেক ভালো হচ্ছে। গত বছর প্রায় পাঁচ টনের বেশি ফাইভার বিক্রি হয়েছে। বাংলাদেশে ম্যান-মেইড ফাইভার থেকে তৈরি পোশাকের যে সেক্টর সেটিকে আমরা সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে দেখছি।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এবং ইয়র্কার্স ট্রেড অ্যান্ড মার্কেটিং সার্ভিস কোং লিমিটেড হংকং-এর যৌথ আয়োজনে ২০০৪ সাল থেকে ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট মেশিনারি এক্সিবিশন’ (ডিটিজি) আয়োজিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ২১১৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৫
ইএসএস/এইচএ/