ঢাকা, শুক্রবার, ৬ চৈত্র ১৪৩১, ২১ মার্চ ২০২৫, ২০ রমজান ১৪৪৬

জাতীয়

ছেলের কারণে মানবেতর জীবন, হিটুর বিচার চান মা

সুব্রত চন্দ ও জয়ন্ত জোয়াদ্দার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪১ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০২৫
ছেলের কারণে মানবেতর জীবন, হিটুর বিচার চান মা

মাগুরা থেকে: শহর থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে নিজনান্দুয়ালী গ্রাম। আড়াই কিলোমিটার আঁকাবাঁকা চিকন পাকা রাস্তা পেরিয়ে নামতে হবে ধুলোমাখা মাটির রাস্তায়।

প্রায় এক কিলোমিটার সেই রাস্তা পেরুলে মিলবে আলোচিত ৮ বছরের শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলার প্রধান আসামি হিটু শেখের বাড়ি।

নির্মম পাশবিকতার শিকার হয়ে ছোট শিশুটি মারা গেলে গত ১৩ মার্চ ওই বাড়িটি ভেঙে গুড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। পেট্রোল ঢেলে করা হয় অগ্নিসংযোগ। যার চিহ্ন এখনো রয়েছে বাড়িটিতে। পোড়া স্তূপ আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাঙা দেয়ালের অংশ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই সেই বাড়িতে। এমনকি বাড়ির আঙিনায় থাকা মেহগনি, বরই, আমড়া, আম, কাঁঠাল, তেঁতুল, লিচু ও কাঠ জাতীয় অনেক গাছ কেটে নিয়েছে সুযোগ সন্ধানীরা।

বুধবার (১৯ মার্চ) ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হিটু শেখের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা বাড়ির পাশের খালি জায়গায় প্লাস্টিকের চটের ওপর একা বসে আছেন ৭৫ বছর বয়সী রোকেয়া বেগম। তিনি হিটু শেখের মা।

ধর্ষণের ঘটনার পূর্বাপর পরিস্থিতি জানতে চাইলে রোকেয়া জানান, ৫ শতাংশ জায়গার ওপর নির্মিত তিন কক্ষের বাড়িটির পুরোটাই ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘরের টিনের চাল, লোহার দরজা, খাট, ফ্যান, জামাকাপড় সব নিয়ে গেছে বিক্ষুব্ধরা। এখন তার থাকার আর কোনো জায়গা নেই। তাই সারাদিন বাড়ির খালি জায়গায় প্লাস্টিকের চটে একা বসে থাকেন। আশপাশের বাড়ি থেকে কিছু খাবার দিলে খান। রাতে যখন সব নির্জন হয়ে যায় তখন পাশের এক বাড়িতে গিয়ে ঘুমান। সকাল হলে আবার সেই চটের ওপর বসে থাকেন।

ছেলের অপকর্মের ঘটনায় তার বিস্তর রাগ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আক্ষেপ আছে রোকেয়ার। তিনি বলেন, কেউ যদি আমাক এখানে থাকার কোনো ব্যবস্থা কইরে দেয় তাইলি আমার জন্য এট্টু সুবিধা হয়। তা না হলে আর কিছু করার নেই। আমার তো টাকা পয়সা নেই যে কিছু একটা করবো। সামনে ঝড়-বৃষ্টির দিন। আমি কোহানে গিয়ে থাকবো? ভয়তি কেউ আমাক থাকার জায়গা দেচ্ছে না।

বাড়ি ভাঙার দিনের ঘটনা জানতে চাইলে হিটুর মা জানান, সেদিন সন্ধ্যার আগে দুটি ছেলে তাকের তার বাড়ি থেকে সরিয়ে দেয়। তারা বলে, ‘দাদি তুমি চলে যাও, লোকজন ইফতারির পর আসছে। ’ সেই কথা শুনে রোকেয়া পাশের পাকা রাস্তায় চলে যান। এর মধ্যেই লোকজন তার বাড়িতে এসে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন, লোকজন বলছে- ‘হিটুর মা কনে গেল। বুড়িরে ধরে এনে আগুনে চেলে ফেলে দে। ’

রোকেয়া বলেন, বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার পর লোকজন দরজা-গ্রিল সব নিয়ে গেছে। পরদিন এসে বাড়ির সব গাছ কাইটে নিয়ে গ্যাসে। মেহগনি, বরই, আমড়া, আম, কাঁঠাল, তেঁতুল, লিচু গাছ ছেলো। সব ভ্যানে করে নিয়ে গ্যাসে। আমার ঘর-বাড়ি পোড়ানো, লুটপাট করার কোনো মানে ছিল না।

নিজের অপূরণীয় ক্ষতি হলেও ছেলের অপকর্মের জন্য তার বিচার চান রোকেয়া বেগম। তিনি বলেন, আমি আমার ছেলের বিচার চাই। তারে জবাই করে দিলি পারেও কিছু বলবো না। ওই মায়েডার যে অবস্থা হইছে, আমার ছেলেরও একই অবস্থা হোক। শিশুটির মতো সেও কবরে যাক। যে অন্যায় করেছে তার শাস্তি চাই। কিন্তু আমার নাতি দুডো কোনো দোষ করেনি।

বাড়ি ভাঙা নিয়ে এলাকাবাসীর মিশ্র প্রতিক্রিয়া-
জানা গেছে, প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে উৎসুক জনতা ও গণমাধ্যমকর্মীরা হিটু শেখের ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া বাড়িটি দেখতে যান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাগুরার অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষক বলেন, কারও বাড়ি ভাঙা মোটেও উচিত হয়নি। প্রত্যেকেরই বাঁচার অধিকার রয়েছে। বাড়িটি ভাঙার পর এখন এই বৃদ্ধ মানুষটি কোথায় যাবে? যারা অপরাধ করছে, তাদের তো আইনের মাধ্যমে বিচার চলছেই। তিনি তো অপরাধ করেনি।

এলাকার বাসিন্দা আজগর শেখ বলেন, হিটু ও তার ছেলে যে কাজ করেছে, তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু তার মায়ের তো কোনো দোষ ছিল না। উনার ঘরটা ভাঙা উচিত হয়নি। থাকার একটা জায়গা থাকলে এই বৃদ্ধ বয়সে তিনি ভিক্ষা করে হলেও খেতে পারতো। কিন্তু তার তো এখন থাকার জায়গাও নেই। সরকারের উচিত তাকে অন্তত থাকার জন্য কিছু একটা করে দেওয়া। যাতে তিনি যত দিন বেঁচে থাকেন ততদিন মাথা গোঁজার ঠাই পান।

এ ছাড়া হিটু ও তার ছেলেদের নিয়ে বিষেদাগার করেন এলাকার কয়েকজন। তাদের ভাষ্য, নিহত শিশুর যে পরিণাম হয়েছে হিটুরও একই পরিণাম হওয়া উচিৎ। তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত। এটি তাহলে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

এ বিষয়ে মাগুরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আইয়ুব আলী বলেন, আমরা এ ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি) নিয়ে রেখেছি। কেউ যদি এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেয়, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব। এখন পর্যন্ত আমরা কোনো অভিযোগ পাইনি।

মাগুরা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মিরাজুল ইসলাম বলেন, শিশুটির মৃত্যুর দিন আশপাশের মানুষ জনরোষ থেকে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই তারা চলে গেছে। একটি জিডি হয়েছে। তবে এ ব্যাপরে কেউ অভিযোগ করেনি।

উল্লেখ্য, গত ৫ মার্চ মাগুরার নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হয় ৮ বছরের একটি শিশু। পরদিন ৬ মার্চ তাকে অচেতন অবস্থায় প্রথমে স্থানীয় একটি মাদরাসার ইমামের কাছে নিয়ে যান হিটু শেখের স্ত্রী জাহেদা বেগম। পরে তাকে সেখান থেকে মাগুরা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। সেখান তার অবস্থার অবনতি ঘটলে ওইদিনই প্রথমে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ও পরে রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কয়েকদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৩ মার্চ মারা যায় পাশবিক নির্যাতনের শিকার শিশুটি। সেদিনই তার মরদেহ সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে মাগুরা এনে নিজ গ্রামে দাফন করা হয়।

এই ঘটনায় ৮ মার্চ মাগুরা সদর থানায় মামলা করেন শিশুটির মা আয়েশা আক্তার। মামলায় আসামি করা হয় শিশুটির বোনের স্বামী সজীব শেখ, ভাসুর রাতুল শেখ, শ্বশুর হিটু শেখ ও শাশুড়ি জাহেদা বেগমকে। বর্তমানে তারা সবাই রিমান্ড শেষে জেলা কারাগারে আছেন। এর মধ্যে মামলার প্রধান আসামি হিটু শেখ মাগুরা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪২ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০২৫
এসসি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।