পণ্য রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচার এবং পাচারকৃত অর্থে যুক্তরাজ্যে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে ইকবাল আহমেদ ওবিইর বিরুদ্ধে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেখ হাসিনা-রেহানার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত ছিলেন এই বিতর্কিত ব্যবসায়ী।
‘সব কাজের কাজি’ সেই ইকবাল আহমেদকে পরিচালনা পর্ষদে রেখে পর্ষদ গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংকটির ভবিষ্যত্ নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে।
জানা যায়, চতুর্থ প্রজন্মের এনআরবি ব্যাংকে সুশাসন ফেরাতে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে পর্ষদ গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পরিচালক করা হয়েছে সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদ ওবিইকে।
এ ছাড়া স্বতন্ত্র পরিচালক করা হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ফেরদৌস আরা বেগম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শেখ মো. সেলিম, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক এমডি কামরুল ইসলাম চৌধুরী, প্রাইম ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি শেখ মতিউর রহমান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শরীফ নুরুল আহকাম ও হিসাববিদ মিজানুর রহমানকে।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের মতো জুলাই বিপ্লবে পাওয়া নতুন বাংলাদেশে ফের এই ইকবালদের মাধ্যমে লুটপাট হোক, তা চাইছেন না ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের লুটপাটের সহযোগী, হিমায়িত মাছ ব্যবসার আড়ালে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে যাওয়া ইকবালকে কেন ব্যাংকের শীর্ষ পদে বসানো হলো? তাঁর ক্ষমতার উৎস কী?
তাঁদের দাবি, অতি দ্রুত ইকবাল আহমেদ এবং তাঁর দুই ভাই কামাল আহমেদ ও বিলাল আহমেদের সম্পদের উৎস খুঁজে বের করে তাঁদের আইনের আওতায় আনা জরুরি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ইকবাল আহমেদ, কামাল আহমেদ ও বিলাল আহমেদ তিন ভাই এবং তাঁরা এনআরবি ব্যাংকের উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার।
১৭ মার্চ ২০২৫ শেষে তাঁরা যথাক্রমে ৩.৮০ শতাংশ, ১.৫১ শতাংশ ও ২.১৩ শতাংশ শেয়ারের অংশীদার। এ ছাড়া সিমার্ক (বিডি) লিমিটেড, আইবিসিও লিমিটেড, আইবিসিও এন্টারপ্রাইজ, আইবিসিও ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ম্যানরু ইন্টারন্যাশনাল ও ম্যানরু শপিং সিটিতেও তাঁদের যৌথ বিনিয়োগ রয়েছে। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, যুক্তরাজ্যে একাধিক কম্পানি রয়েছে তাঁদের। এর মধ্যে রয়েছে সিমার্ক পিএলসি, আইবিসিও হোল্ডিংস, এমএআই ইনভেস্টমেন্ট হোল্ডিংস, ভার্মিলিয়ন গ্রুপ লিমিটেড, ফ্লাইং ইউনিকর্ন, ওপেনশ হোল্ডিংস লিমিটেড, আইবিসিও লিমিটেড, ইউকেবিসিসিআই, ইউকে বাংলাদেশ ক্যাটালিস্টস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং নিউ ইস্ট ম্যানচেস্টার লিমিটেড। এই কম্পানিগুলো মূলত রিয়েল এস্টেট, বিনিয়োগ ও আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত।
শেখ রেহানাসহ শেখ পরিবারের অন্য সদস্যদের নামেও এই কম্পানিগুলোতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করা হয়েছে। এ ছাড়া লন্ডন-ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক সম্পদের মালিকানা গড়ে তুলেছেন। শুধু লন্ডনেই তাঁর প্রায় দুই ডজন বাড়ি ও অত্যাধুনিক প্রপার্টি রয়েছে।
সূত্র জানায়, বিগত এক দশক ধরে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে নিজের অবস্থান গড়ে তোলেন ইকবাল। তাঁর ফেসবুক প্রফাইলজুড়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে অসংখ্য ছবি শেয়ার করা হতো, যা তাঁকে ‘হাসিনা বিশ্বস্ত’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। যদিও ৫ আগস্টে হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ফেসবুক থেকে ছবিগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার শীর্ষ ২০ জন অর্থদাতার মধ্যে ওবিইও একজন। পতিত সরকারের আমলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সিমার্ক গ্রুপের আড়ালে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের অর্থপাচারের ক্যারিয়ার (বাহক) হিসেবেও কাজ করতেন ওবিই। ইকবাল সিমার্ক গ্রুপের প্রধান ব্যবসা হলো মাছ রপ্তানি। মাছের আড়ালে তিনি বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস ও সোনা চোরাচালান করতেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ভাড়া চুক্তির অতিরিক্ত অর্থ ব্যাংক থেকে গ্রহণ করায় গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ইকবাল আহমেদ, কামাল আহমেদ ও বিলাল আহমেদ—তিন ভাইকে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছে এনআরবি ব্যাংক। লিগ্যাল নোটিশে বলা হয়, নোটিশ পাওয়ার পর অতিদ্রুত অতিরিক্ত ভাড়া বাবদ ব্যাংক থেকে নেওয়া চার কোটি ৫১ লাখ টাকা ফেরত দিতে হবে। না দিলে ফৌজদারি আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে নোটিশদাতা ব্যারিস্টার হেলাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, আইনি নোটিশ দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত বিবাদীপক্ষ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
ইকবাল আহমেদ ক্ষমতার জোরে করেছেন নানা অভাবনীয় কাণ্ডও। ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সে অনিয়ম করে গায়েব করেন দুই লাখ পাউন্ড। এরপর ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের নেতারা ইকবাল আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করলে তিনি মামলায় হেরে যান। দেশটির আদালত ইকবাল আহমেদকে পাঁচ লাখ পাউন্ড জরিমানা করেন এবং চেম্বার অব কমার্স থেকে আজীবন বহিষ্কার করেন। এর আগে ব্রিটেনের কনজারভেটিভ পার্টির গোপন অর্থদাতা ওবিই দলটিকে ১২ হাজার পাউন্ড ডোনেশন দেওয়ার পর খরচ ফেরতের দাবি করে বিতর্কিত হয়েছেন।
ডেইলি মেইলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই দাতা তাঁর বিলাসবহুল জীবনযাত্রার জন্য পার্টির তহবিল ব্যবহারের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। তাঁর এই আচরণ নিয়ে ব্রিটিশ রাজনীতিতে সমালোচনার ঝড় উঠেছে, যেখানে জনগণের করের টাকা দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তীব্র হয়েছিল।
এই ঘটনা ঘিরে দলটির অভ্যন্তরীণ আর্থিক নীতিমালা ও নৈতিকতা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। স্থানীয় গণমাধ্যম ও সুধীসমাজের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থায়নে কঠোর নিয়মকানুন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছিল।
এদিকে ওবিইর অর্থপাচারের অভিযোগ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ফিন্যানশিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের সাম্প্রতিক রিপোর্টে বাংলাদেশকে ‘ধূসর তালিকা’ থেকে মুক্ত করতে ওবিইর কেলেঙ্কারি দ্রুত বিচারাধীন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অর্থপাচার ও ব্যাংকের অর্থ লুটে কারো বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে, সে ক্ষেত্রে এমন ব্যক্তিকে পুনারায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হলে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই তদন্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার চলছে। বিতর্কিত ব্যক্তিকে ব্যাংকের শীর্ষ পদে দিয়ে ব্যাংকটির সংস্কার সম্ভব হবে না।
তবে অভিযোগ প্রসঙ্গে ইকবাল আহমদ ওবিইর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে এনআরবি ব্যাংকের সচিব রেজাউল করিমকে ফোন দেওয়া হলে তিনি জনসংযোগ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। জনসংযোগ বিভাগের প্রধান সালাউদ্দিন মুরাদকে ফোন দেওয়া হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
সূত্র: কালের কণ্ঠ
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০২৫
এসআই