ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

ইট-বালু গিলছে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের স্মৃতি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৬
ইট-বালু গিলছে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের স্মৃতি দিঘলিয়ার সেনহাটীতে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার স্মৃতিফলক। ইনসেটে কবির ফাইল ছবি। ছবি: আসিফ আজিজ

খুলনা ঘুরে: ‘যে জন দিবসে মনের হরষে/ জ্বালায় মোমের বাতি/ আশু গৃহে তার দেখিবে না আর/ নিশীথে প্রদীপ ভাতি।’ শৈশবে অপব্যয় নিয়ে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের এ কবিতা পড়ে বড় হননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শুধু এ কবিতা নয়, কালজয়ী আরও অনেক কবিতায় সমৃদ্ধ কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষক কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের জীবন।

খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ঈর্ষণীয় সমৃদ্ধ সেনহাটীতে শৈশবস্মৃতির এ কবির শেষ স্মৃতিচিহ্নগুলোও হুমকির সম্মুখীন। অযত্ন-অবহেলায় দরিদ্রদশা।

এভাবেই ইট গিলছে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের স্মৃতিচিহ্ন।  ছবি: আসিফ আজিজদৌলতপুর খেয়াঘাট থেকে ভৈরব নদী পেরিয়ে ভ্যানে মিনিট দশেকের পথ সেনহাটী। তিনদিকে নদীবেষ্টিত এ উপজেলা থেকে বিভিন্ন সময় বেরিয়েছে বহু বিখ্যাত মানুষ।

‘চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন/ ব্যথিতবেদন বুঝিতে পারে। / কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে/ কভূ আশীবিষে দংশেনি যারে। ’  মনে মনে চিরঅমর এসব নীতিকবিতা আওড়াতে আওড়াতে একসময় পৌঁছানো গেলো ভৈরবতীরে কবির পৈত্রিকভিটায়। ভিটা বলতে শুধু নামেই। কবির কোনো আত্মীয়-স্বজন এখানে থাকেন না। বসতভিটার কোনো চিহ্নও নেই। যে পুকুরটি ছিল সেটি দখল করে ভরাটের পর উঠেছে পাকা দালান। সামনের মাঠের দুই প্রান্তে দুটি প্রায় শতবর্ষী মন্দিরও ধুঁকছে। এখন যেখানে বাড়ি দেখা যাচ্ছে, সেখানে ছিল কবি কৃষ্ণ চন্দ্র মজুমদারের পিতৃপুরুষের পুকুর।  ছবি: আসিফ আজিজকবির কিছু স্মৃতি টিকে আছে জেনেই সেখানে যাওয়া। কিন্তু কই! একটু হতাশা নিয়েই আশপাশের মানুষের কাছে খোঁজ করা। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করতেই তাদের চোখে-মুখেও ফুটে উঠলো আতঙ্কের ছাপ। সব যে তারাই লুটেপুটে খাচ্ছেন তাতে সন্দেহের অবকাশ রইলো না।

একজন নদীর পাড়ের রাস্তার পাশে রাখা নতুন ইটের স্তূপ দেখিয়ে বললেন, ওখানে কিছু স্মৃতি আছে। খুঁজে দেখেন। একটু এগিয়ে গিয়ে সত্যি খুঁজে দেখতে হলো। জানা ছিল কবির প্রিয় কামিনী গাছের একটি স্মৃতিচিহ্ন আছে এখানে। কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পাশের এক চায়ের দোকানি ডেকে বললেন, ভাই এদিকে এসে দেখেন। ইটে সব ঢাকা পড়ছে। দেখবেন কীভাবে। কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের স্মৃতি বিজড়িত কামিনী গাছের স্মৃতি বাঁচানো ফলকের হাল।  ছবি: আসিফ আজিজসত্যি গিয়ে দেখা গেল, একটি স্মৃতিফলক। ছাল-চামড়া বলতে কিছু নেই। ধুলা-বালিতে ঢাকা। একটি খোদাই করা ফলকে লেখা, ‘বাংলার অমর মঙ্গল কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার এর প্রিয় কামিনী ফুল গাছের স্মৃতি রক্ষার্থে দ্বিতীয় গাছটি রোপণ করেন জনাব এসএম ফিরোজ আলম, জেলা প্রশাসক খুলনা’।

এ লেখাটিও উদ্ধার করতে ধুলো-বালি ঝাড়তে হলো। ২০০৮ সালের এ ফলকটির অবস্থা দেখে গাছটির কি অবস্থা তা আর জানতে ইচ্ছে হলো না। স্পষ্ট বোঝা গেল, ইট ইজারাদাররা ইট ফেলতে ফেলতে এর আর কিছু অবশিষ্ট রাখেননি। টাইলসগুলো ভেঙেছে সব। কংক্রিটের ঢালাইও পায়নি রেহাই। অথচ এখানে যে কামিনী গাছটি ছিল তার নিচে বসেই কবি অনেক কবিতা লিখেছেন। কুমুদবন্ধু মন্দিরের পেছনের কোনো জায়গায় ছিল কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের বাড়ি।  ছবি: আসিফ আজিজ আর কবির জীবনের একমাত্র ছবিটি সেই কামিনী গাছের নিচে বসেই তোলা। কবির জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে এমফিল করা একমাত্র ব্যক্তি আলহাজ সারওয়ার খান ডিগ্রি কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপাল মো. আলতাফ হোসেন জানাচ্ছিলেন এমনটাই। তিনি আরও জানান, চেহারা খুব ভালো ছিল না বলে কবি আয়নায় নিজের চেহারাও দেখতেন না। ছবি তোলায়ও ছিল অনীহা। আর প্রথম জীবনে অনেক দুষ্টু থাকলেও পরে এতো সৎ হয়ে যান যে, তার বহু উদাহরণ হয়ে ওঠে অনুকরণীয়।

পাশেই কবির স্মরণে নির্মিত স্মৃতিফলকটির অবস্থাও করুণ। ধূলাধূসর লাল ইটের গুঁড়ায়। বাঁধানো টাইলস ভেঙেছে কোথাও কোথাও।

কারা এসব ইট রেখেছে জানতে চাইলে এলাকাবাসী সেনহাটী শিবমন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক তারক দাশের দোকান দেখিয়ে দেন। তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের মন্দিরের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাই না। গোল চিহ্নিত ফলকটিই কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের স্মৃতি বিজড়িত কামিনী স্মৃতি ফলক।  ছবি: আসিফ আজিজ তাই এ জায়গা ইজারা দেওয়া হয়েছে। বছরে ২২ হাজার টাকার মতো পাওয়া যায়। বছর ছয়েক হলো এভাবে চলছে।

এ জায়গা ছাড়াও মাঠ রয়েছে, সেখানে কেন রাখা হয়নি জানতে চাইলে, সেখানে বাচ্চারা খেলে বলে দায় এড়িয়ে যান। মহান এ কবির স্মৃতির কি হবে সেদিকে কোনো মাথাব্যথা নেই তার।

এখান থেকে হতাশ হয়ে এবার যাওয়া কবির স্মৃতির উদ্দেশ্যে গড়া ইনস্টিটিউটে। কিন্তু চাবি পাওয়া গেল না শত বছরের বেশি বয়সী ভবনটির। ১৯১৪ সালে কবির নামে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এ ইনস্টিউটটি করলেও বর্তমানে সেখানে জুয়ার আসর আর আড্ডাবাজি ছাড়া কিছুই হয় না বলেই অভিযোগ এলাকাবাসীর।

গবেষক আলতাফ হোসেন বলেন, যে বছর মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ বধ কাব্য প্রকাশিত হয়, সেই ১৮৬১ সালেই কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের কাব্য সদ্ভাবশতক প্রকাশিত হয়। ১৯১৪ সালে স্থাপিত কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ইনস্টিটিউট।  ছবি: আসিফ আজিজ কিন্তু প্রচার পছন্দ করতেন না বলেই তিনি পিছিয়ে পড়েন। ঢাকা প্রকাশের মতো একটি নামি পত্রিকার প্রথম সম্পাদকও ছিলেন তিনি। অথচ তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে বানানো ইনস্টিটিউটে কবির কিছুই নেই। ইনস্টিটিউটের নামে জায়গা। অথচ কমিটির লোকজন সব লুটে খাচ্ছে। সরকার যদি এটা নিয়ে নেয় তাহলে সমৃদ্ধ হবে। ভালো চলবে বলেই আশা।

এ বিষয়ে খুলনার জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসানের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, বিষয়টি জানা ছিল না। শিগগিরই সেখানে যাবো। গিয়ে দেখে প্রয়োজন হলে জায়গা উদ্ধার করে কিংবা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সহযোগিতা নিয়ে তার স্মৃতি সংরক্ষণে সব চেষ্টা করা হবে।

আরও পড়ুন:

**খুলনায় বসে ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ দেখা!

**দাদার লাশ টোপ দিয়ে বাঘ শিকার করেন পচাব্দি গাজী
** ওষুধিগুণে চাহিদা বাড়ছে খুলনার চুইঝালের
** ষাটগম্বুজ মসজিদে কত গম্বুজ!
** চিনে খান খুলনার বিখ্যাত চুইঝাল
** ট্যাংরা-পারসের ছটফটানি বাগেরহাট বাজারে (ভিডিও)
** ‘উলুঘ খানের’ ঘোড়া দীঘি টানছে পর্যটক (ভিডিও)
** বাগেরহাটের মিনি কুয়েত!
** পরিযায়ী পাখি যাচ্ছে পর্যটক-ব্যবসায়ীর পেটে
** সুন্দরে এতো হিংসে কেন!

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৬
এএ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ