ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

সরেজমিন শাহপরীর দ্বীপ

‘লাইফ লাইনে গণ্ডগোল’

রহমান মাসুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ৬, ২০১৬
‘লাইফ লাইনে গণ্ডগোল’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শাহপরীর দ্বীপ, টেকনাফ থেকে ফিরে: দেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের শেষ প্রান্তের নাম বদর মোকাম। বঙ্গোপসাগরে নাফ নদীর পতন হয়েছে এখানে।

বদর মোকাম থেকে পরিষ্কার দেখা মেলে ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’ খ্যাত সেন্টমার্টিন দ্বীপের। সাগরের নীল পানির সঙ্গে নাফের দুধঘোলা রংয়ের মিশ্রণ এখানে চোখে পড়ার মতো। মোহনীয় এ দৃশ্য দেখতে সারাদেশ থেকে প্রায়ই পর্যটকের আগমন ঘটে শাহপরীর দ্বীপের এ পাড়ায়।

তবে দমওয়ালা পর্যটক ছাড়া ওখানে পৌঁছানো সবার পক্ষে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। শত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে কেউ সে পর্যন্ত পৌঁছুতে পারলে শাহপরীর দ্বীপ তার জন্য মেলে ধরবে অকৃত্রিম ঐশ্বর্য ভাণ্ডার। আর আপনি যদি সেই পরিশ্রমী পর্যটক হন, তাহলে ভাগ্যবান। দ্বীপের যেদিকেই আপনার চোখ যাবে, অবাক হবেন।
 
অপরূপ এ দ্বীপে একবার আসলে কেনো কেউ আর আসতে চান না এ দ্বীপে, তা ভুক্তভোগী ছাড়া উপলব্ধি করা প্রায় অসম্ভব। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের একটি দ্বীপ ‘শাহপরীর দ্বীপ’। এখানে গ্রাম বা পাড়ার সংখ্যা ১৪টির ওপরে। ১২ বর্গ কিলোমিটারের এ জনপদের জনসংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার।

এক সময় টেকনাফ থেকে শাহপরীর দ্বীপের সড়ক পথে দূরত্ব ছিল ৭ মাইল বা ১১ কিলোমিটার। জোয়ারের পানিতে সে পথ হারিয়ে যাওয়ায়, বর্তমানে ওই পথ পেরুতে কেবল অতিরিক্ত পথই পাড়ি দিতে হয় ১৪ কিলোমিটার। তাও আবার অতিরিক্ত পথের প্রায় পুরোটাই কাঁচা। আঠালো মাটির এ পথের গড়ন ঠিক যেনো কোনো মাছের ঘেরের পাড়ের মতো। তাই মে থেকে নভেম্বর এ সময়টাতে ৪০ হাজার মানুষের তিন চতুর্থাংশ পথ পায়ে হেঁটে, কাদা-জলে গড়াগড়ি দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। এ মাটির পথটিই বর্তমানে ৪০ হাজার মানুষের চলাচলের একমাত্র পথ। স্থানীয়দের ভাষায় ‘লাইফ লাইন’।

টেকনাফ থেকে ভাড়ার অটোতে করে এ পথ পাড়ি দিতে ‍ গুনতে হয় জনপ্রতি ১০০ টাকা। আগে যা ছিল ৩০ টাকা। আর খানাখন্দে ভরা পথে একবার ভ্রমণ করলে দ্বিতীয়বার ভ্রমণের চিন্তা মাথায়ও আসেনা কারো।

শাহপরীর দ্বীপের মানুষের প্রধান জীবিকাই হলো সাগরে মাছ ধরা। অনেকে বিদেশে থাকেন। দ্বীপে যে কৃষি কাজ হয়, তা নগণ্যই। কিন্তু মাটি উর্বর। তবে ১২ কিলোমিটারের এ ভূখণ্ডে ৪০ হাজার মানুষকে ঠাঁই দিতে গিয়ে কৃষি জমি আর নেই বললেই চলে। এর বাইরের জমিটুকু গিলে নিয়েছে সাগরের লবণ পানি। ফলে ৪০ হাজার মানুষের চাল, ডাল, সদাইপাতি, ওষুধ দ্বীপে আনতে ও দ্বীপের জেলেদের ধরা মাছ টেকনাফে নেওয়া নির্ভর করে এ লাইফ লাইনের ওপর। কিন্তু তা দেখে আপনার কিছুতেই বিশ্বাস হবেনা। এমন ‘গণ্ডগোলে’ ভরা ‘লাইফ লাইনে’ জীবন থাকে কি করে!

যোগাযোগের এ প্রতিকূলতার কারণে দেশের সেরা অপরাধ প্রবণ এলাকাও শাহপরীর দ্বীপ। নাফপাড়ের মায়ানমার সীমান্তবর্তী এ জনপদ। হুণ্ডি ব্যবসা, সার, তেল, ওষুধ, স্বর্ণ, ডলার ও টাকা পাচারের এ জনপদ কয়েক বছরেই হয়ে উঠেছে ইয়াবা পাচারের বড় রুট। এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় মানব ও মাদক পাচারের ডজন ডজন গডফাদারের বাড়িও এখানে।

স্থানীয় সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ মোজাম্মেল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, শাহপরীর দ্বীপের সমুদ্র সৌন্দর্যকে একমাত্র তুলনা করা যায় সেন্টমার্টিনের সঙ্গে। জেলে পল্লী, মাছ ধরা, প্রান্তিক জীবন, বদর মোকাম, প্রশস্ত বিচ, ঝাউবন, নাফ নদী, এক কিলোমিটারের জেটি, লবণ খেত, ম্যানগ্রোভ সবই দেশ সেরা পর্যটনের জন্য যথেষ্ট।

তিনি বলেন, কিন্তু স্থানীয় রাজনীতির বলি শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দারা। এ রাজনীতির কারণেই আজ চার বছরের বেশি হলো মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দারা। কোনোরকম একটি মাটির রাস্তায় ১০ মাইলের মতো বেশি পথ ঘুরে সাময়িক শ্বাস-প্রশ্বাস চালানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটাই বর্তমানে দ্বীপের লাইফ লাইন। তার অবস্থাও ভালো নয়, সারাক্ষণ গণ্ডগোল লেগে আছে। আমরা অমাবস্যা, পূর্ণিমায় আতঙ্কে থাকি। কখন আবার জোয়ারে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়!
স্থানীয় অটো চালক মোহাম্মদ আলি বাংলানিউজকে বলেন, ২০১২ সালের ২২ জুলাই বঙ্গোপসাগরের প্রবল জোয়ারে শাহপরীর দ্বীপের দক্ষিণ ও পশ্চিমপাড়া এলাকার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়। তীব্র স্রোতে টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ সড়কের ৫০ গজ ভেসে যায়। সেই থেকে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে টেকনাফের সঙ্গে শাহপরীর দ্বীপের। জোয়ার-ভাটায় সেই ভাঙ্গা অংশ বাড়তে বাড়তে এখন ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত প্রশস্ত হয়েছে। ভেঙ্গে যাচ্ছে সড়কের আরো নতুন নতুন অংশ।
 
কক্সবাজার সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী কামরুজ্জামান জানান, আগে টেকনাফ-কক্সবাজারের সঙ্গে সরাসরি বাস সার্ভিস চালু ছিল শাহপরীর দ্বীপের। টেকনাফ থেকে শাপপরীর দ্বীপের দূরত্ব মাত্র ১৩ কিলোমিটার হলেও বিধ্বস্ত ৩ কিলোমিটার ভাঙ্গা অংশের কারণে বর্তমানে অতিরিক্ত ১৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি কয়েক ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে।
 
তিনি বলেন, এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করা কেবল মানসিক দৈন্যতা পরিহারের ব্যাপার। স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির জেটি কেন্দ্রিক রাজনীতি ও ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা, শাহপরীর দ্বীপের জেটি জোট সরকারের তৎকালীন প্রতিমন্ত্র সালাহউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বদির বিরোধ ও ইয়াহিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্বের ফলাফল ভোগ করতে হচ্ছে শাহপরীবাসীকে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৬, ২০১৬
আরএম/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ