ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

লাল ইটের দ্বীপগ্রাম (ভিডিওসহ)

আসিফ আজিজ ও শুভ্রনীল সাগর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৬
লাল ইটের দ্বীপগ্রাম (ভিডিওসহ) ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খোলাবাড়িয়া, হালতি বিল (নাটোর) থেকে ফিরে: লাল কেশরওয়ালা মোরগের আত্মবিশ্বাসী কক্কক..কক্কক..কোটাককক... ঘুম ভাঙানি ডাকে প্রতিদিন জেগে ওঠে দ্বীপগ্রাম খোলাবাড়িয়া। শীতের সকালে আলো ফুটতেই গৃহিণীরা গায়ে চাদর জড়িয়ে চোখ-মুখ অনেকটা ঢেকে বের হন বাইরে।

যে জাগালো তাকে আদর-আপ্যায়নে শুরু হয় দিনের কাজ।

লাল ইটের দ্বীপগ্রাম তো বলাই যায়! মাটি থেকে অন্তত আট থেকে ১০ ফুট উঁচুতে প্রতিটি বাড়ি। লাল পোড়া ইটের। বর্ষার ছ’সাত মাস চারপাশে থাকে শুধু অথৈ পানি। শুকনোর সময়ও প্রথম দেখায় দ্বীপ ছাড়া অন্য কিছু মনে হবে না। নাটোর শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে বিল হালতির ঠিক মাঝের গ্রাম খোলাবাড়িয়া।

সাড়ে তিন হাজারের মতো মানুষের বাস এ গ্রামে। বাড়ির সামনে আঙিনা রাখার সুযোগ নেই। গায়ে গা ঘেঁষে প্রতিটি বাড়ি। পানির সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয় তাদের। তবে পুরো এলাকাজুড়ে রয়েছে অনাবিল বিশুদ্ধতা। মানুষগুলো ভীষণ রকম সরল, অতিথিপরায়ণ। গ্রামে ঢুকেই নেওয়া যায় বুকভরা নির্ভেজাল নিশ্বাস। প্রকৃতি এখানে আপন আলোয় ভরাতে ব্যস্ত প্রতিটি মুহূর্ত।

বঙ্কিম, শরৎ যে কেনো হাওয়া বদলের জন্য তাদের চরিত্রগুলোকে গ্রামে পাঠাতেন তা এ গ্রামে এলে বুঝে যাবে যে কেউ। মানুষগুলোর মতো প্রকৃতিও মন ভরাবে, শরীর সতেজ করবে যে কারও।

সম্পূর্ণ বিলের জমি নির্ভর অর্থনীতির এ গ্রামের মানুষের সকালটা শুরু হয় ‘সাত সকালে’। আলো ফুটলেই গৃহিণীরা হাঁস-মুরগিকে বের করেন তাদের ঘর থেকে। তারপর কেউ ছাড়া পায়, কেউ আবার ঝাঁপিবন্দি। হাঁসের জন্যে এটা স্বর্গরাজ্য। মুরগির জন্য দ্বীপটাই ভরসা। প্রতি বাড়িতেই পোষা হয় হাঁস-মুরগি। গরুও একেবারে কম নেই।

কুয়াশাভেজা সকালে বের হলে বাড়ির আশপাশে গরুর গোবরের মশাল নাড়া, গোয়ালের চানার গন্ধ। ভেজা পলগাদা আর কচি লাউয়ের ডগার মিষ্টি গন্ধ তাতে যেনো এনেছে ভারসাম্য। একটু রোদের দেখা মিললেই গরুর শরীর থেকে খুলে দেওয়া হয় শীতের পোশাক। সারারাত আটকে রাখা বাছুরটির এবার মুক্তির পালা। দুধ দহনও শুরু হবে শিগগিরই।

দ্বীপে ওঠা-নামার জন্য রয়েছে কিছু ঢাল, কোথাও কোথাও সিঁড়ি। ফাঁকে ফাঁকে শুকনোয় জেগে ওঠা পুকুর। পুকুরগুলো এখন হাঁসের দখলে। যেগুলোতে পানি বেশি সেগুলোতে চলছে মাছ ছাড়া। বর্ষার আগেই ধরে নেওয়া হবে।

ঢাল বেয়ে নেমে রাস্তার সমতলে বসেছে অস্থায়ী বাজার, দোকান-পাট। এগুলো বর্ষায় আবার চলে যাবে পাড়ায়। এ বিলের জমি সব একফসলি। তাই চারদিকে ধান, গম, ভুট্ট, আলু, পিঁয়াজফুল, কুমড়া খেতে সবুজ। মসুর ডাল, হলুদ সরিষা ফুলও চোখে পড়ার মতো।

পরিবারের পুরুষ সদস্যরা সকালের খাবার খেয়ে দুপুরের খাবার নিয়ে ছুটছেন মাঠে। ফসলে সার পানি দিতে থাকতে হবে দীর্ঘ সময়। দুপুর গড়িয়ে বিকেলে বাড়ি ফেরা। সন্ধ্যায় ঘরে যখন টিভি চলে তারা তখন বাজারে আড্ডায় মশগুল।

বিলের মাঝের এ দ্বীপগ্রামেও বৈদ্যুতিক আলো আছে। উন্নয়নের বিশ্বগ্রামে ক্যাবল লাইনও এসে পৌঁছেছে। অন্দরের নারীদের তাই এখন ‍আর গল্প-গুজব করে কাটাতে হয় না।

শিক্ষায় কিন্তু পিছিয়ে নেই গ্রামবাসী। ৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হাইস্কুল রয়েছে এখানে। এছাড়া একটি প্রাইমারি স্কুল, একটি মাদ্রাসা। চিকিৎসার জন্য একমাত্র সম্বল ছোট একটি কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র। শিক্ষার্থীরা পিটি প্যারেড করেই শুরু করে দিনের পড়াশুনা। মাদ্রাসা, স্কুল দুটি আবার আলাদা ছোট দুটি দ্বীপ। এর মধ্যে প্রতিবছর আবার ভাঙা-গড়ার খেলা তো চলেই।

বিকেলে এখানকার শিশু-কিশোররা মাঠে খেলে। ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল। তবে চাষের সময় পরিবারের সবারই কিছু বেশি সময় দিতে হয়। তাই পড়া-খেলা দুটিতেই বিঘ্ন ঘটে কিছুটা।

গ্রামে সন্ধ্যা নামে একটু আগে। শিক্ষার্থীরা ৮টা সাড়ে আটটার মধ্যেই পড়ালেখা শেষ করে খেয়েদেয়ে চলে যায় ঘুমের দেশে। সকালে আবার স্কুল।

নিজেদের তৈরি ফসলেই তাদের মাস-বছর চলে। কিছু সবজি কিনতে হয়। মাছ কিনতে হয় খুবই কম। তবে চলনবিলের মাছ তারা বাজার থেকে কিনতে পান না। সব চলে যায় অন্য জায়গায়। দিন শেষে ট্যাংরা-পুঁটি ধরা কিংবা সকালে বোয়াল শোল ধরে নিয়ে বাজারে বিক্রির মধ্যে গ্রামের সাধারণ মানুষের আগ্রহ তাই কম। তারা চাইলেও কিনতে পান না। তাদের ভাষ্য এমনই।

গ্রামে সচেতন মানুষও যে আছেন তা বোঝা যায় বাজারের চায়ের দোকানে সান্ধ্য আড্ডায়। এই গ্রাম নিয়ে তাদের ভাবনা কম নয়। তাদের ভাবনার জন্যই হয়তো ডুবো সড়ক তাদের জুড়েছে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, উপজেলা সদরে।

গ্রামের ইউপি সদস্য একাব্বর প্রামাণিক, মাদ্রাসার সভাপতি ও যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন, চাষি ভুট্টর দাবি, রাস্তা হয়েছে, এবার বর্ষায় মিনি কক্সবাজার খ্যাতি পাওয়া তাদের এ বিলে পর্যটনের ব্যবস্থা করা হোক। পর্যটকরা এসে যেনো আরও বেশি ঘুরতে পারেন, থাকতে পারেন।

তাদের আশা একদিন সে স্বপ্ন তাদের বাস্তবায়ন হবে। আরও উন্নত হবে গ্রাম। যে বর্ষায় তাদের কোনো কাজ থাকে না, সেই বর্ষাই হবে তাদের জীবন-জীবিকার অন্যতম উৎস।



বাংলাদেশ সময়: ০৭৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৬
এসএস/এএ/জেডএম

** চলনবিলের শুটকিতে নারীর হাতের জাদু
** ‘পাকিস্তানিরাও সালাম দিতে বাধ্য হতো’
** মহিষের পিঠে নাটোর!
** চাঁপাইয়ের কালাই রুটিতে বুঁদ নাটোর
** উষ্ণতম লালপুরে শীতে কাবু পশু-পাখিও!
** পানি নেই মিনি কক্সবাজারে!
** টিনের চালে বৃষ্টি নুপুর (অডিওসহ)
** চলনবিলের রোদচকচকে মাছ শিকার (ভিডিওসহ)
** ঘরে সিরিয়াল, বাজারে তুমুল আড্ডা
** বৃষ্টিতে কনকনে শীত, প্যান্ট-লুঙ্গি একসঙ্গে!
** ভরদুপুরে কাকভোর!
** ডুবো রাস্তায় চৌচির হালতি
** হঠাৎ বৃষ্টিতে শীতের দাপট
** ঝুড়ি পাতলেই টেংরা-পুঁটি (ভিডিওসহ)
** শহীদ সাগরে আজও রক্তের চোরা স্রোত
** ‘অলৌকিক’ কুয়া, বট ও নারিকেল গাছের গল্প
** মানবতার ভাববিশ্বে পরিভ্রমণ
** সুধীরের সন্দেশ-ছানার জিলাপির টানে
** নতুন বইয়ে নতুন উদ্যম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ