ঢাকা, বুধবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

স্বপ্নময় সুনামগঞ্জ: জাদুকাটা টু সিরাজ লেক

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০১৯
স্বপ্নময় সুনামগঞ্জ: জাদুকাটা টু সিরাজ লেক

সুনামগঞ্জ: আধো ঘুম আধো জাগরণে স্বপ্ন দেখছিলাম বাসের জানালা গলে আসা প্রথম সূর্যের আলোয় চোখটা মেলবো। সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে ঘুমটা যখন ভাঙলো দেখি আকাশের মুখ ভার। শেষ মাঘের এই সকালে তো আকাশের এমন মুখ কালো থাকার কথা না। কিছুক্ষণ আগে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হয়েছে তাও টের পাওয়া গেলো। 

মাঘ নয় যেন কোনো শ্রাবণ প্রভাতে চলেছি সুনামগঞ্জের ট্রেডমার্ক দিগন্ত বিস্তৃত খোলা প্রান্তরের মধ্যেখান দিয়ে যাওয়া পাকা সড়ক ধরে। মনকে আশা দিলাম।

 দুপুরে নিশ্চয়ই প্রকৃতির মতিগতি পরিবর্তন হবে। পৌনে ৭টায় বাস নামিয়ে দিলো স্ট্যান্ডে। এখানে কিছুদিন ধরে চমৎকার একটি খাওয়ার দোকান হয়েছে, পানসী। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে ইদানীং এই হয়েছে সমস্যা। নতুন যে কোনো খাবার হোটেলের নাম হতে হবে পাঁচ ভাই অথবা পানসী।

অনুকরণের একটি বাজে প্রবণতা।  হাওর-বাওড় নদী জল জোৎস্নার দেশে কি সুন্দর নামের অভাব আছে। উদ্যোক্তারা ভেবে দেখতে পারেন। তবে পানসী হোটেলের খাবার মেন্যু বেশ লম্বা।  সাতকড়া গরুর মাংসের দিকে চোখ আটকে গেলো। সাতকড়া সিলেট অঞ্চলের খাবার হলেও এটি আগে খুব বেশি খাবার হোটেলে পাওয়া যেতো না। ইদানীং অনেক জায়গাতেই মিলছে। যাক অন্তত চট্টগ্রামের মেজবানীর মাংসের মতো এই খাবারটিও একটি আঞ্চলিক ব্র্যান্ডিং পেতে যাচ্ছে।  .সাতকড়া গরুর মাংস আর ঝরঝরে খিচুড়ি দিয়ে জম্পেশ একটি নাস্তা সারা হলো। সঙ্গী নাফিজা আপাকে কখনোই আমার ভোজনরসিক মনে হয়নি। তিনি সারা বছর প্রায় ডায়েটে থাকেন!! অবশ্য ডায়েট চার্টে কিন্তু ভাত থাকা চাই-ই।  তার বিপরীত মুস্তাফিজ ভাই। ভোজনরসিকতার গুণপনার ষোলআনা তার মধ্যে উপস্থিত। যে কোনো নতুন খাবার তিনি তা চেখে দেখবেন-ই।  

খাদ্য নিয়ে কোনো সংস্কার তার মধ্যে নেই। এরই মধ্যে চলে এলেন জাকির ভাই। বলা চলে এবারের ট্যুরে তিনিই আমাদের পথ নির্দেশক। সুনামগঞ্জের খুব পরিচিত একজন সংবাদকর্মী। এখানকার প্রত্যেকটি দর্শনীয় জায়গা তার নখদর্পণে। দু’বছর আগে তার ব্যবস্থপনায় একবার টাঙ্গুয়ার হাওরে এসেছিলাম।  এবার সে লোভেই এসেছি, জানি জাকির ভাই সব ব্যবস্থা করে রাখবেন।  

জাকির ভাই তার কথা রেখেছেন। তিনি এসেছেন, সঙ্গে একটি সিএনজি অটোরিকশা। এটি থাকবে সারাদিন আমাদের সঙ্গে। আমাদের পাঁচজনকে নিয়ে যন্ত্রযান ছুটলো তাহিরপুর উপজেলার উদ্যেশ্যে। আকাশের তখনও মন ভার।  খবর পাওয়া গেছে ঢাকাতেও নাকি ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হয়েছে। মনকে প্রবোধ দিলাম নিশ্চয়ই বেলা গড়ালে এমনটা থাকবে না।
.জাদুকাটার মায়াজাল ছিন্ন করে ঘাট থেকে একটু উঠলেই পাশেই বারিক্কা টিলা। এখানে দাঁড়ালে দিগন্তবিস্তারি মেঘালয়ের পাহাড় সারির পটভূমিতে জাদুকাটার আসল সৌন্দর্য বোঝা যায়। বিকেলের জন্য সেটি তুলে রেখে আমরা ছুটলাম শিমুল বাগানের পথে। এখান থেকে একশো টাকা প্রতিজন মোটরসাইকেলে।  রাস্তার বেহাল দশার কারণে মোটরসাইকেল অথবা পায়ে হাঁটা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।  

হালের ক্রেজ এই শিমুল বাগান। সুনামগঞ্জে তাহিরপুর উপজেলা উত্তর বাদাঘাট ইউনিয়নের মানিগাঁও গ্রামে। ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন প্রায় একশো বিঘা জমির উপর রোপণ করেছিলেন শিমুল গাছের চারা। কালে সেটিই হয়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় শিমুল বাগান। ফাল্গুনের প্রথমার্ধে এর শাখায় শাখায় রক্তরঙা ফুল ফুটলে সুন্দর লীলা ক্ষেত্র হয়ে উঠে স্থানটি। আর তার রূপ সুধা পান করতে প্রচুর মানুষ আসে। সেই হুজুগে মেতে আমরাও চলেছি শিমুল বাগানে।  

মিনিট বিশেকের মধ্যেই চলে এলাম বাগানের সামনে। রীতিমতো দোকান বসে গেছে। চালু হয়ে গেছে দশ টাকা করে টিকিট। যদিও ব্যক্তিমালিকানাধীন এই ভূমিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে টিকিট ব্যবস্থায় মালিকপক্ষ জড়িত কিনা তা জানা গেলো না। যদি না হয় তা নিশ্চিতভাবেই চাঁদাবাজি। দূর-দুরান্ত থেকে আসা মানুষের তাতে থোড়াই কেয়ার। অবাক হলাম শহর থেকে এতটা বেহাল রাস্তা ঠেলে এমন ধুলোর মধ্যেও প্রচুর কোট-টাই পরা মানুষজনের আগমনে। তাদের সঙ্গে আসা দামি শাড়ি আর গহনার বাহারে শোভিত নারীকুলের রূপের ছটায় এই বুঝি ম্লান হয় শিমুল ফুলের প্রাকৃতিক লাল।  .আমরা চড়ে বসলাম বাগানের মধ্যিখানে পানির টাংকির মাথায়। এখান থেকে বাগান বিশাল অংশ নজরে আসে। এক দিকে জাদুকাটা নদী আরেকদিকে পাহাড়কে পাশে রেখে এই শিমুল বাগান নিশ্চিতভাবেই তার রূপে রঙে যে কোনো সৌন্দর্যপিয়াসীকে পাগল করে তুলবে।

ঘণ্টাখানেক শিমুল বাগান অ্যাডভেঞ্চারের পর আবার ছুটলাম টেকেরঘাটের উদ্দেশ্যে। এই পথেও মোটরসাইকেল ছাড়া গত্যন্তর নেই। বারিক্কা টিলা হয়ে বেশ ভালো একটি রাস্তা হয়েছে। তবে শিমুল বাগান থেকে ভাঙাচোরা গ্রাম্যপথ ধরেই ছুটলো আমাদের যান্ত্রিক দ্বিচক্রযান। এই পথে অবারিত প্রকৃতি আপনাকে সঙ্গে দেবে প্রতিক্ষণ। রাস্তার একেবারে পাশ ঘেষেই ভারত সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া। পাহাড় উঠে গেছে আকাশের পানে। আর আমরা চলেছি বাংলাদেশের সবুজ সমতলের পথ ধরে।  

সীমান্তের পাশেই লোকালয় বাজার ঘাট। কোথাও কোথাও ক্ষেতের উপর দিয়েও ছুটলো মোটরসাইকেল। বর্ষায় এ পথে চলা অসম্ভব। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর আমরা এসে পৌঁছালাম অসাধারণ সুন্দর এক জলাশয়ের সামনে। এর রঙিন পানির রূপে মুগ্ধ হয়ে কোনো কবি হয়তো নাম রেখেছিলন নীলাদ্রি। কিন্তু এর চেয়েও মহান ব্যাপার জড়িয়ে আছে লেকটির সঙ্গে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এখানেই শহীদ হয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট সিরাজ। তার নামেই এই লেকের নাম রাখা হয় শহীদ সিরাজ লেক।  .আমার ব্যক্তিগত অভিমত এই নামেই ডাকা উচিত লেকটিকে। চুনা পাথরের ভূমিস্তরের কারণে শীত বসন্তের সময়টিতে পানির রং হয়ে ওঠে পান্না সবুজ। কিন্তু তারচেয়েও সুন্দর বোধহয় পাশের টিলাময় জায়গাগুলো ছেয়ে থাকা মখমল সদৃশ সবুজ ঘাস। বর্ষায় এ পুরো এলাকা সবুজে সবুজময় হয়ে যায়। লেকের পার থেকে শুরু হয়েছে সীমান্ত। তবে এখানে কোনো ভীতি নেই। স্থানীয় মানুষ পর্যটকেরা স্বাচ্ছন্দ্যে লেকের জলে নৌকা নিয়ে ঘুরছে।  

বর্ষায় টাঙ্গুয়ার হাওরের বিস্তৃতি লেকের প্রায় পার পর্যন্ত এসে ঠেকে। তখন নৌকা নিয়েও আসা যায়। আমরা নৌকায় করে লেকে ঘুরে বেড়ালাম। মধ্যদুপুরে এমন পান্না সবুজ জল দেখে স্নানের লোভ সামলানো কঠিন। সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাপড় নেই, আবার খিদেও লেগেছে প্রচুর। টেকেরঘাটের জয় বাংলা বাজারে গিয়ে পাওয়া গেলো বেশ দারুণ এক খাবার হোটেল।  

আসবাবের বাহুল্য নেই। কিন্তু খাবারের পদে প্রাচুর্য আছে। প্রায় দশ রকমের ভর্তা ভাজি, হাওরের বোয়াল মাছ আর হাঁসের মাংস নিয়ে জম্পেশ খাওয়া হলো। শেষে দারুণ স্বাদের মিষ্টি দই। এত মজাদার মিষ্টান্ন বহুদিন খাইনি।  .কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর সীমান্ত ঘেষা পাকা সড়ক ধরে চললাম বারিক্কা টিলার উদ্দেশ্যে। এখানে প্রচুর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের বাস। গারো জনগোষ্ঠীর এসব মানুষ খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। মোটাসাইকেল চালক আলমগীর গারো রাজার বাড়ির সামনে থামতে চাইলো। তবে মোস্তাফিজ ভাইয়ের অনাগ্রহে আর রাজদর্শন হলো না। সমতলের শেষে বিশাল এক চড়াই অতিক্রমের পর বারিক্কা টিলার শীর্ষে পৌঁছে গেলাম মোটরসাইকেল নিয়েই।  

এখানকার লাল মাটির ভূমি গঠন থেকে বোঝা গেলো ফেলে আসা সমতল মাঠও এক সময় এই বারিক্কা টিলার অংশ ছিল। শেষ বিকেলে সূর্য যখন পাটে বসছে তখন আমরা বারিক্কা টিলার শীর্ষে। এখান থেকে জাদুকাটা আর মেঘালয়ের খাসিয়া জয়িন্তিয়া পাহাড় সারির অপার্থিব যুগলবন্দি যে কাউকে আপ্লুত করবে, দৃশ্যপট চোখে লেগে থাকবে অনেকদিন। সেই মুগ্ধতা নিয়েই আমরা ফিরে এলাম সুনামগঞ্জ শহরে। কথায় আছে শেষ ভালো যার সব ভালো তার। শহরের পুরনো শিল্পকলা একাডেমিতে তাসকীর আলি বাউল এবং সেবুল বাউলের দরাজ গলার গান সারাদিনের সব মুগ্ধতার পূর্ণতা দিলো। সুনামগঞ্জে আবার ফিরে আসার রসদ পেয়ে গেলাম।    

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০১৯
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।