ঢাকা, বুধবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

শঙ্খ নদী পেরিয়ে মেঘের দেশে

রিয়াদ আরিফ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৬
শঙ্খ নদী পেরিয়ে মেঘের দেশে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সাংগু নদীর ‘আদুরে’ নাম শঙ্খ। জন্ম তার বান্দরবানের মদক অঞ্চলে।

  দু’পাশে আদিগন্ত সবুজ পাহাড় আর তারই মাঝখানে শঙ্খ। দূর থেকে দেখলে মনে হয় পাহাড় যেন মিশে গেছে মেঘের সঙ্গে। আমাদের নৌকা চলছিল এই শঙ্খের বুক চিরে। ইঞ্জিনের নৌকা, মানুষ আর মাল বোঝাই।

এরমধ্যে হয়তো কারও মনে বাজে আঞ্চলিক গানের মুকুটহীন সম্রজ্ঞী শিল্পী শেফালী ঘোষের ...
‘পালে কী রং লাগাইলরে মাঝি
সাম্পানে কী রং লাগাইল
শঙ্খ খালর সাম্পানওয়ালা আঁরে
পাগল বানাইল...’

মনে মনে সাম্পান খুঁজতে থাকি নিজের অজান্তেই। এক সময় এই শঙ্খ দিয়েই ছুটে যেত বুঝি রঙ্গিলা মাঝির সাম্পান। রূপবতী শঙ্খ দু’ধারে সবুজের পাহারা। সবার চোখ আটকে যায় পাহাড়ের র‍ূপে।

অবশ্য চট্টগ্রাম পার হবার পর থেকেই বাসের জানালা দিয়ে ছোট ছোট পাহাড় দেখা যাছিলো। ঠিক সকাল হবার আগেই ভোরের হালকা আলোতেই দেখছিলাম সাপের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া রাস্তার দু’ধার দিয়ে সবুজ পাহাড়। মাঝে মাঝে উঁচু টিলার উপর ছোট ছোট ঘর, গিরি খাদ আর পাহাড়ি ঢলের নমুনা ।

যাবার সময় কিছু দূর পরপর পাহাড়ের উঁচু টিলার উপর আদিবাসী পাড়া চোখে পড়ছিল। এমন অপার সবুজের মাঝে শত শত বছর ধরে তারা এভাবেই বসবাস করে আসছে।

প্রকৃতির সঙ্গে যেন তাদের একটা নিবিড় বোঝাপড়া। শঙ্খে জোয়ার-ভাটা হয় নিয়মিত। প্রচণ্ড রোদ্দুর। এর মাঝেই নদীর বুকে মাছ ধরছিল পাহাড়ি কিশোরীরা। কেউ কেউ দূর থেকে এসেছে জল নিতে। ঝর্নার স্বচ্ছ জল কাঁধে পাহাড়ি তরুণীকে প্রকৃতি ভেবে মানুষ ভুল করতেই পারে!

আমরা যখন রুমা বাজার পৌঁছে যাই ঘড়ির কাঁটায় তখন সাড়ে তিনটা। রাতে দীর্ঘ জার্নির পর আগুন মাখা রোদে পাঁচ ঘণ্টা নৌকা ভ্রমনের পর দলের সবাই ক্লান্ত। পেটও একেবারে ক্ষুধায় চোঁ চোঁ করছে।

তাই হোটেলে ওঠার আগেই খাবারের দোকানের খোঁজ করা চাই ,সবচেয়ে বেশি দরকার ঠাণ্ডা পানি। রুমা বাজারে আমরা যে হোটেলে উঠেছি তার জান‍ালা দিয়ে পাহাড় দেখা যায়। সন্ধ্যার আলো নিভে যাওয়া মাত্র সে পাহাড় অন্ধকারে হারিয়ে যায়।

তার সঙ্গে মিল রেখে রাত বাড়ার আগে আমরাও হারিয়ে যাই গভীর ঘুমে। পরদিন সকালেই আমাদের গন্তব্য বগা লেক। রুমা বাজার থেকে বগার পথ সহজ না, দূরত্ব ২১ কিলোমিটার।

বর্ষা মৌসুমে রাস্তা ঠিক থাকে না বলে গাড়িতে করে যাওয়া যায় অল্প কিছুটা। বাকি পথ হাঁটতে হয়। দুর্গম আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে হাঁটা কঠিন কর্ম।

আমাদের গাইড মিশুক একটা ল্যান্ড ক্রজারের ব্যবস্থা করেছিল বলে রক্ষা। এটাতে করে ১১ কিলোমিটার পথ যাওয়া যাবে। এই রাস্তায় ল্যান্ড ক্রুজারে যাওয়া মানে জীবনকে একেবারে হাতের মুঠোর নিয়ে ঘোরা। সরু পাহাড়ি পথ, উঁচু নিচু আর আঁকাবাঁকা। কোনোভাবে পড়ে গেলে অন্তত দুই হাজার ফিট নিচের খাদে গিয়ে পড়তে হবে।

 ল্যান্ড ক্রজারের চালক ফয়সালের হাতে কেবল স্টিয়ারিং নয় ,ওর হাতে তাই আমাদের জীবনও। পথের দু পাশে কেবল সবুজ আর সবুজ।

একেই বুঝি বলে অন্তহীন সবুজ। সারা জীবন মিলেও এতো সবুজ দেখা হয়নি। এতোগুলো সবুজ কিভাবে যেন একসঙ্গে বাসা বেঁধেছে এই পাহাড় কন্যার দেশে!

এদের মধ্য থেকে একটা পাহাড় কিনতে পারলে মন্দ হতো না! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিশ্চয় এমন একটা পাহাড়ই কিনতে চেয়েছিলেন, তার নদীটার বদলে। আচ্ছা নদীর বদলে পাহাড় কেন? পাহাড় কি নদীটার চেয়ে সুন্দর ছিল?

পাহাড়ের পথ ধরে হাঁটছি। মাঝে মাঝে শান্ত ঝিরির জলে পা ভেজাচ্ছি। সারা শরীরে ক্লান্তির  ছাপ ,তবুও অন্তহীন সবুজের মহা সমুদ্র দেখে সেই ক্লান্তি মুখ লুকোতে বাধ্য।

কিছুদূর গিয়ে ছোট্ট একটা পাহাড়ি গ্রাম, নাম শইরাতং। সেখানে একটু জিরিয়ে নেয়া সঙ্গে জল আর কলা ভোজন। পাহাড়ের পুরো শরীর জুড়েই অফুরন্ত কলার গাছ। তাই এখানকার দোকানগুলোতে কলা বেশ সস্তা দামে পাওয়া যায়।

আমাদের শরীর আর চলছে না। এমন পাহাড়িয়া রাস্তায় হাঁটার অভিজ্ঞতা দলের কারও নেই। গাইড আশ্বাস দেয় সামনেই কমলার বাজার।

কমলার বাজার থেকে মিনিট বিশেক হাঁটলেই বগা লেক। সেই শান্তনাকে পুঁজি করে তবুও নিথর দেহ হাঁটতে থাকে বগা লেকের পথে। লেকে যখন পৌঁছাই তখন মধ্য দুপুর।

পা গুলো ততক্ষণে অবশ হয়ে গেছে তবুও একটা কেমন জানি প্রশান্তি। এতো উঁচুতে একটা পাহাড় তার মাঝে একটা লেক।

বগা লেকে এসে লাল জিক বমের কটেজে দুপুর বেলা ডিম আর লাউ দিয়ে দিয়েই চলে আমাদের আতিথেয়তা। আর সন্ধ্যে বেলা মারমাদের গ্রাম থেকে মুরগী ধরে এনে সেটার বারবিকিউ দিয়ে চলে আমাদের রাতের ভোজন।

রাতের বগা লেকের দৃশ্য অসাধারণ। স্বচ্ছ নীল আকাশ,পাশে উঁচু পাহাড়। দূর থেকে মিশুকের গলায় পাহাড়ি গান শোনা যায়। চমৎকার গলা ছেলেটার। গাইড হিসেবে কাজ করছে অনেক দিন হলো।

পরদিন সকালেই আমাদের কেওক্রাডং যাত্রা। অন্যরকম এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। সে অনুভূতিকে অস্বীকার করে ঘুমের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া অসাধ্য। সকালে ঘুম থেকে উঠেই লাঠি হাতে হাঁটছি কেওক্রাডং এর পথে। পাহাড়ি রাস্তায় লাঠি ফেলে ফেলে পা এগুতে হয়। সাথে জোঁকের ভয় তো আছেই সেই সঙ্গে ভোরে এক পশলা বেশ বৃষ্টি হয়েছে। পথ ঘাট সব পিচ্ছিল। ফলে হাঁটতে হবে বেশ সাবধানে।

সঙ্গীরা বারবার এগিয়ে যাচ্ছে। খানিকটা মোটা হবার কারণে বারবার পিছনে পড়তে হচ্ছে আমাকে, পায়ে অসহ্য ব্যথা। পাহাড়ি রাস্তায় কষ্টের কোনো শেষ নেই, মাঝে মাঝে মনে হয় থেমে যাই।

তবে এর মাঝে  দুই একটা শান্ত ঝর্নার সঙ্গে দেখা হলে মন্দ লাগে না। মনে হয় সব কষ্ট সার্থক। পাথরের উপর দিয়ে পাহাড় থেকে চুইয়ে পড়ছে স্বচ্ছ শীতল জল। সেই জলে চলে আমাদের জলস্নান। কিছুদূর এগুতেই চিংড়ি ঝর্ণা। এ পথের সবচেয়ে বড় ঝর্ণা এটা। জলের সঙ্গে অসংখ্য চিংড়ি পাওয়া যায় বলেই এর এমন নাম।

পথে চোখে পড়ে অসংখ্য জুম চাষ। উঁচু নিচু টিলার উপর চাষ হয়েছে সারি সারি আদা আর ধান। টানা তিন ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা দারজেলিং পাড়ায় পৌঁছাই। এখানে কয়েকটা বম পরিবারের বাস। সেখানকার এক তরুণী আমাদের চা বানিয়ে দিলেন। চায়ের সঙ্গে কলা আর বিস্কুট  খেয়ে আমরা আবার হাঁটা শুরু করি। এটাই আমাদের শেষ স্টপেজ। হাঁটতে হবে দ্রুত। বৃষ্টির ভয় আছে। অনেক খাড়া রাস্তা। বৃষ্টি হলেই শেষ। শরীরে কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই।

তবু কেওক্রাডং ছোঁয়ার বাসনা নিয়ে এগুতে থাকি। পথ শেষ হয় না। এর মধ্যে শরীরের মধ্যে রক্ত চোষা শুরু করেছে বেশ কয়েকটা জোঁক।
ওই যে কেওক্রাডাং দেখা যায়!

সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৩১৭২ ফিট উপরে। চারপাশটা তাকিয়ে কেন জানি বিশ্বাস হয় না! অবিশ্বাসের চোখে তাকাতে থাকি নিচে ও চারদিকে। অদ্ভুত রকম সুন্দর, ভয়ঙ্কর রকম সুন্দর। মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে মেঘ।

এমন আলিঙ্গনের জন্যই বুঝি মানুষ এতো পথ পাড়ি দেয়। দুর্গম পথ সে পথ। এমন সুন্দরের জন্য হাজার বছর ধরে পথ হাঁটা যায় অনায়াসে।

বাংলাদেশ সময়: ০০৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৬
আরএইচএস/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।