ঢাকা, বুধবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পর্যটন

‘হাল ছাড়া সহজ, লেগে থাকা কঠিন, কিপ প্যাডেলিং’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৯
‘হাল ছাড়া সহজ, লেগে থাকা কঠিন, কিপ প্যাডেলিং’

ঢাকা: খেলাধুলা আর ভ্রমণ বিষয়ক বই থেকেই জেঁকে বসে ভ্রমণের নেশা। এছাড়া বাংলাদেশ যুব পর্যটক ক্লাবের সদস্য হওয়ার সুবাদে সুযোগ হয় দেশ-বিদেশ ঘুরে আসা প্রায় সমবয়সী পর্যটকদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা শোনার। এরপর প্রথমবার ভারত ভ্রমণে গিয়ে নেশা চড়ে বসে পুরোটাই। সে থেকেই শুরু। ১৯৯৭ সালে সাইকেল নিয়েই বেরিয়ে পড়েন বিশ্ব ভ্রমণে। বলা হচ্ছে, পর্যটক, ভ্রমণ বিষয়ক লেখক ও প্রকাশক এবং ব্লগার আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বলের কথা। সম্প্রতি বাংলানিউজের সঙ্গে ভ্রমণের রোমাঞ্চকর সেসব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন উজ্জ্বল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট শাওন সোলায়মান।

বাংলানিউজ: খুব অল্প বয়স থেকেই ভ্রমণ করছেন। এই ঝোঁকটা আসল কীভাবে?
উজ্জ্বল: ছোটবেলা থেকেই বেশ দুরন্ত ছিলাম।

বাবার একটি ফনিক্স সাইকেল ছিল, সেটাই এক পায়ে চালাতাম। এছাড়া ছোটববেলায় বাবাই পড়ার জন্য দিলেন সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে-বিদেশে’। সেসময় এর সাহিত্যরস না বুঝলেও ভ্রমণ যে একটা রোমাঞ্চকর কিছু, সেটা বুঝতে পারি। একদিন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখে বাংলাদেশ যুব পর্যটক ক্লাবের সদস্য হই। সেখানে আরও ভ্রমণকারীদের সাহচর্যে আসি। তাদের ভ্রমণের গল্প শুনি। তাদের বেশিরভাগই ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী। এরপর প্রথমবার সুযোগ হয় ভারত যাবার। সেখানে গিয়ে দেখি বহির্বিশ্বের চেয়ে কতটা পিছিয়ে আছি আমরা। কতকিছু আমরা জানি না। সেসব জানার নেশা থেকেও বলতে পারেন ভ্রমণে আরও আগ্রহী হয়ে উঠি।
পর্যটক, ভ্রমণ বিষয়ক লেখক ও প্রকাশক আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল, ছবি: সংগৃহীতবাংলানিউজ: সাইকেল নিয়ে বিশ্বভ্রমণ করেছেন। আপনার সাইকেলে সবসময় বাংলাদেশের পতাকা থাকে?
উজ্জ্বল: হ্যাঁ। আমার সাইকেলের সঙ্গে দেশের পতাকা থাকত। বলতে পারেন বিশ্বের ছয়টি মহাদেশের প্রায় ৫৮টি দেশে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি আমি। শহরের হিসেব করলে তো অগণিত।
 
বাংলানিউজ: আমরা শুনেছি ৯৫০ ডলার নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছেন, ফিরে এসেছেন ১১০০ ডলার নিয়ে, কীভাবে?
উজ্জ্বল: প্রথমত, এর জন্য পুরো কৃতিত্ব দিতে হয় প্রবাসে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে থাকা আমাদের দেশের মানুষদের। বলতে পারেন, আমি বাংলাদেশি বলেই এমনটা করতে পেরেছি। কারণ প্রবাসীরা আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছেন। সঙ্গে দুইটি টি-শার্ট আর প্যান্ট থাকত। দেখা গেছে, কেউ আমাকে খাবার দিয়েছেন। আবার কেউ জামাকাপড় বা জুতাও দিয়েছেন। এছাড়া কোনো শহরে একটু বেশিদিন থাকলে আর টাকা খরচ হয়ে গেলে ছোটখাটো কিছু কাজেরও সুযোগ করে দিয়েছেন। সেখানে যা পেয়েছি, তা দিয়ে বেড়িয়ে এসেছি। আমার পুরো সাইকেলের ভ্রমণে মাত্র তিনদিন হোটেলে থেকেছি। বেশিরভাগ সময় প্রবাসীদের আশ্রয়ে বা ইরানের মসজিদে, এমনকি টেলিফোন বুথেও ঘুমিয়েছি।
পর্যটক, ভ্রমণ বিষয়ক লেখক ও প্রকাশক আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল, ছবি: সংগৃহীতবাংলানিউজ: একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। পর্যটন খাতে উন্নত দেশগুলোর পর্যটন ব্যবস্থা খুব কাছে থেকে দেখেছেন। আমরা পর্যটন শিল্পে এখনও পিছিয়ে আছি। তাদের সঙ্গে আমাদের মূল পার্থক্যটা কোথায়?
উজ্জ্বল: মূল পার্থক্যটা হচ্ছে, সেসব দেশের সরকার ও বেসরকারি কর্তৃপক্ষ একত্রে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে তাদের পর্যটন খাতের বিকাশ করেছে। আমার মনে হয়, আমাদের এখানে সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে এখনও একটা দূরত্ব আছে এবং বিভিন্ন মেয়াদে এমন পরিকল্পনা নেই। বাইরের দেশগুলোর কাছে আমরা আমাদের যা যা আছে সেগুলোর সঠিক ব্র্যান্ডিং করতে পারছি না। যেমন ধরেন, বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তার খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। আমরা এটাকেও ব্র্যান্ডিং করতে পারি। এখানে আসা কোনো পর্যটক যখন স্থানীয়দের বাড়িতে থাকবে, খাবে, তখন তার মাঝে যে আত্মীক ভালো লাগা আসবে, সেটা আর কোনো কিছুতে আসবে না।

সমাধান:
প্রথমত, আমাদের পরিকল্পনা করতে হবে। তবে পরিকল্পনা আগেও হয়েছে। কিন্তু কাজ করেনি। এর অর্থ হচ্ছে, হয় পরিকল্পনায় ভুল ছিল, আর নয় বাস্তবায়নে ভুল ছিল। সেই ভুলগুলো বাদ দিয়ে সঠিক পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন করতে হবে। এরপরের বিষয়টি হচ্ছে, সঠিক ব্র্যান্ডিং। আমাদের যা আছে, সেটিকে তুলে ধরতে হবে। আমরা সবসময় সেই বিষয় নিয়ে কথা বলি, আমাদের যা নেই। কিন্তু আমাদের অনেককিছু আছে। সেগুলো নিয়ে কথা বলতে হবে। তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, ইউনিক ট্যুরিজম আইডিয়া বের করতে হবে। ধরেন রিলিজিয়াস ট্যুরিজম হবে। ইসলাম, হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মের বেশকিছু ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে আমাদের দেশে। দেশ-বিদেশ থেকে এসব ধর্মের অনুসারীদের এখানে আনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এটা একটা উদাহরণ দিলাম। এ রকম ইউনিক কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে। সাগর, পাহাড়, বন পৃথিবীর আরও দেশে আছে। আমাদের দেশে কেন আসবে? বাইরের পর্যটকদের আমাদের এখানকার সংস্কৃতির স্বাদ দিতে হবে। ইউরোপের একজন কক্সবাজার এসে চাকচিক্য চাইবে না। তাকে আমাদের গ্রাম বাংলার মাটির ঘরে একদিন রাখুন।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং মানুষদের সচেতন হতে হবে। একটা হিসেব বলছে, বিমানবন্দর থেকে শহরের দূরত্ব যদি ২৫ থেকে ৩০ মিনিটের হয়, তাহলে বুঝতে হবে সেই দেশ পর্যটনবান্ধব। একইসঙ্গে পথে-ঘাটে স্থানীয়দের আচরণ ও গতি প্রকৃতি বলে দেবে সেই জাতি কেমন। এই দুটিকে যদি আমরা আরও উন্নত করতে পারি, আর ব্র্যান্ডিং করতে পারি, তাহলে আমাদের পর্যটন শিল্প আরও বিকশিত হবে।

বাংলানিউজ: অনেক পর্যটকই বলেন, দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘোরার চেয়ে প্বার্শবর্তী কোনো দেশ ভ্রমণ সস্তা। আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?

উজ্জ্বল: এটা একেবারে অসত্য না। আমাদের এখানে কখনও কখনও বেড়ানোতে যে খরচ হয়, সে টাকায় আমাদের আশেপাশের ভারতের কিছু রাজ্যে ঘুরে আসা যায়। এর জন্য আমাদের এখানকার উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীদের আন্তরিক হতে হবে। তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তারা নির্দিষ্ট শ্রেণির কয়েকজনের কাছ থেকে বেশি আয় করতে চান, না-কি অনেকজনের কাছ থেকে অল্প অল্প করে বেশি আয় করতে চান।

বাংলানিউজ: আবার আপনার ভ্রমণ বিষয়ে ফিরে আসি। দীর্ঘপথ সাইকেল চালিয়েছেন। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়েছেন। পুরো স্মৃতি যদি স্মরণ করেন, চিত্রটা কেমন দেখেন?
উজ্জ্বল: ১৯৯৭ সালে প্রথম সাইকেলে চড়ে বিদেশ ভ্রমণে বের হই। আর ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শেষ সাইকেল সফর করি। শেষের ঘটনা দিয়েই বলি। সেখানে ট্যান্ডেম সাইকেল করে একধরনের সাইকেল চালাই আমি। এটা চালানো খুবই কষ্ট। কারণ এটা দুই বা তিনজন মিলে চালাতে হয়। এক্ষেত্রে পেছনে যারা বসেন, তাদের সামনের জনের সঙ্গে মিলে প্যাডেলিং করতে হয়। এটা খুবই কষ্টের এবং অস্বস্তিজনক। সেবারও মনে হচ্ছিল থেমে যাই। কিন্তু থেমে গেলে তো থেমেই গেলাম। সহজ কাজ হচ্ছে, কোনো কিছু থেকে ‘গিভ আপ’ করা। চালিয়ে যাওয়াটাই কঠিন। নিজেকে সফল করতে হলে চালিয়ে যাওয়ার তাগিদ থেকেই সাইকেল চালিয়ে গিয়েছি। শুরুতে অনেক মানুষ অনেক টিটকারি দিয়েছিলেন, সাইকেল চালিয়ে ভ্রমণে বের হতে পারব না। আবার পরিবার এবং বন্ধুমহল সাহস যুগিয়েছে। এমনকি বিদেশ বিভূইয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাশাপাশি বিদেশিরাও আমাকে মোরাল সাপোর্ট দিয়েছেন। সেসবের জোরেই এই পথ পাড়ি দিতে পেরেছি।
পর্যটক, ভ্রমণ বিষয়ক লেখক ও প্রকাশক আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল, ছবি: সংগৃহীতবাংলানিউজ: তরুণ পর্যটক বা তরুণদের উদ্দেশে সার্বিকভাবে আপনি কী পরামর্শ দেবেন?
উজ্জ্বল: আমার একটা নিজের উদাহরণ দিয়ে এর উত্তরটা দিই। একবার যুক্তরাষ্ট্রের এক রাজ্য থেকে অনেক দূরের আরেকটি রাজ্যে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলাম। পথে একদল সাইক্লিস্টের সঙ্গে দেখা হলো, যারা আরেকটি দূরের রাজ্য থেকে আমাদের রাজ্যে এসেছিল। তাদের একজনকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কীভাবে এতটা পথ তিনি পাড়ি দিয়েছেন আর আমি কীভাবে দেব? তিনি উত্তরে শুধু বললেন, কিপ প্যাডেলিং অর্থ্যাৎ প্যাডেল চালিয়ে যাও।

এই কথা শুধু ভ্রমণ না, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যে যাই করছেন, সেটি ভালোলাগা নিয়ে করবেন। আর সেটি থামানো যাবে না। লেগে থাকতে হবে। আর যদি শুধু ভ্রমণের কথা বলেন, তাহলে বলব কোথাও যাওয়ার আগে সেই জায়গা, সেখানকার জীবন প্রকৃতি এবং বিধিনিষেধ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জেনে যাবেন। এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে অবাধ তথ্য পাওয়া যায়। এর সঙ্গে ভ্রমণ বিষয়ক বই পড়তে হবে। ২০ টাকার বই না পড়ে জ্ঞানের যে অপূর্ণতা থাকে, দেখা যায় অজ্ঞতার কারণে পর্যটকের আরও আর্থিক ক্ষতি হয়।

বাংলানিউজ: সবশেষ প্রশ্ন, আর কোথায় কোথায় আপনি বেড়াতে চান?
উজ্জ্বল: এক কথায় বললে, বলব যে, পৃথিবীর যেখানে এখনও বেড়ানোর সুযোগ হয়নি, সে জায়গাতেই আমি যেতে চাই। নির্দিষ্ট করে বললে, অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে পা রাখা হয়নি। ওশেনিয়া অঞ্চলে যেতে চাই। মধ্য ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়ায় যেতে চাই। লাতিন আমেরিকার কিছু দেশে গিয়েছি, তবে সুযোগ পেলে আবার যেতে চাই। আর হ্যাঁ, মধ্য আমেরিকাতেও।

ব্যক্তি আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল বর্তমানে কাজ করছেন একজন ট্যুর অপারেটর হিসেবে। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় উজ্জল ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন নিজের ট্রাভেল এজেন্সি ‘ডেল্টা আউটডোরস’। দুই পুত্র সন্তানের জনক উজ্জ্বল।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০১৯
এসএইচএস/টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।