ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপার মহিমার রমজান

আমানত রক্ষায় উন্নতি আর খেয়ানতে দারিদ্র্যতার কথা আজ তারাবির পাঠে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫১ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৬
আমানত রক্ষায় উন্নতি আর খেয়ানতে দারিদ্র্যতার কথা আজ তারাবির পাঠে

চলতি রমজান মাসের ১৫তম খতমে তারাবি অনুষ্ঠিত হবে আজ। আজতের খতমে তারাবিতে পবিত্র কোরআনে কারিমের তেলাওয়াতকৃত অংশের বিশেষ উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হচ্ছে, আমানত রক্ষা করার গুরুত্ব।

এ প্রসঙ্গে সূরা মুমিনুনের ৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘সফল মুমিন তারা ... যারা আমানত ও কথা রক্ষা করে। ... তার জান্নাতের অধিকারী হবে। সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। ’

আমানত রক্ষা করা একটি নৈতিক ও মানবিক গুণ। সকল নবী-রাসুল এ মহৎ গুণে আলোকিত মানুষ ছিলেন। সমাজ ও পরিবারের সুখ, শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা অনেকাংশেই এ গুণের ওপর নির্ভরশীল। কোনো সমাজ বা পরিবারের মানুষগুলো যদি এ নৈতিক গুণ হারিয়ে ফেলে তবে সে সমাজ ও পরিবারের শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া অবধারিত। অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতার দাবানল সে সমাজকে জ্বালিয়ে ছাই করে দেবে। পবিত্র কোরআনে কারিমের আরও কয়েক স্থানে এ নৈতিক গুণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন- ‘যারা আমানত ও কথা রক্ষা করবে ... তারা জান্নাতের সম্মানিত অতিথি হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবে। ’ –সূরা আল মায়ারিজ: ৩৪

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, তোমরা আমানতকে তার যথাযথ প্রাপকের কাছে পৌঁছে দেও। ’ –সূরা আন নিসা: ৫৮

আমানত রক্ষার গুরুত্ব বুঝাতে যেয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমানত রক্ষা করে না, তার কোনো ঈমান নেই। যে ব্যক্তি কথা রক্ষা করে না তার কোনো দ্বীন নেই। ’ -সুনানুল বায়হাকি কুবরা: ১২৪৭০

‘যে ব্যক্তি কাউকে কিছু বলার সময় এদিক-সেদিক তাকায় (লক্ষ্য করে, অন্য কেউ শোনল কি-না) সে কথাও আমানত। ’ –সুনানে তিরমিজি: ১৯৫৯

‘পরামর্শও একটি আমানত। ’ –সুনানে আবু দাউদ: ৫১৩০

কারো কাছে কোনো বস্তু গচ্ছিত রাখলে তাকে বলা হয় আমানত। আমানতের বস্তু মালিকের সানন্দনুমতি ব্যতীত ব্যবহার করলে বা ভোগ করলে তা হবে খেয়ানত। খেয়ানত করা হারাম। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেয়ানতকে বলেছেন মুনাফিকের লক্ষণ। হাদিসে বর্ণিত কিয়ামতের আলামতগুলোর মধ্যে একটি হলো, মানুষ আমানতের বস্তুকে গনিমতের বস্তুর মতো ব্যবহার করবে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সমাজের মানুষের কাছে এতটাই বিশ্বস্ত আমানতদার ছিলেন যে, তার জানের দুশমনরাও তার কাছে মাল আমানত রাখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করত ও নিরাপদ মনে করত।

কোরআন ও হাদিস অধ্যয়ন করলে বুঝে আসে শুধু বস্তু আমনত নয়। অর্পিত দায়িত্বও আমানত। একজন শিক্ষক যখন শিক্ষাদানের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন তখন শিক্ষাদান করা তার জন্য পবিত্র আমানত। নিজের মেধা, যোগ্যতা ও সামর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে শিক্ষার্থীকে পাঠদান করা শিক্ষকের দায়িত্ব। এভাবে বিচারকের কাছে মামলার রায়, শাসকের কাছে দেশ শাসন আমানত। স্ত্রীর কাছে স্বামীর সম্পদ, সন্তান আমানত।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা থেকে যে প্রত্যয়নপত্র, প্রশংসাপত্র, সনদপত্র দেওয়া হয় তা-ও আমানত। কর্তৃপক্ষ যদি জেনে বুঝে ভুল প্রত্যয়ন করে, ভুল সনদ দেয় তবে সে আমানতের খেয়ানত করল। আখেরাতে এ জন্য তাকে বিচার ও শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। বিভিন্ন সনদের অনুলিপি সত্যায়ন করাও একটি আমানত। মূলকপির সঙ্গে না মিলিয়ে বা অমিল রেখেই যদি কোনো কর্মকর্তা সত্যায়ন করে দেয়- তবে সে আমানতের খেয়ানত করল। নির্বাচনে ভোট প্রদান করাও আমানতের অন্তর্ভুক্ত। দলের টানে, বংশের দুর্বলতায়, এলাকার খাতিরে বা কোনো বখশিশ নিয়ে কেউ যদি তুলনামূলক অযোগ্য ও অসৎ প্রার্থীকে ভোট দেয় তবে সেও আমানতের খেয়ানত করল। কোনো বিক্রেতা যদি তার পণ্য সম্পর্কে ক্রেতাকে ভুল তথ্য দেয় সেও আমানতের খেয়ানত করল।
বিশিষ্ট তাফসিরবিদ আল্লামা কুরতুবি (রহ.)-এর দৃষ্টিতে আমানতদারির বিষয়টি অত্যন্ত ব্যাপক। ইসলামি জীবনপদ্ধতির সব কিছুর সঙ্গে আমানতদারির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনা, সরকারি ও বেসরকারি দাফতরিক কাজকর্ম, শিক্ষকতা, সমাজের নেতৃত্ব, ব্যবসা-বাণিজ্য, মজুরি, শ্রম-মেহনত, দেশপ্রেম ইত্যাদি সবই আমানত।

সুতরাং আমানত শব্দটি ব্যাপকার্থে ব্যবহৃত হয়। অনেকে অর্থ সম্পদের মধ্যে আমানতটি সীমিত রাখে, যা সম্পূর্ণ ভুল। বরং মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের সাথে আমানত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই প্রতিটি ব্যক্তি একজন আমানতদার। আমানতদার ব্যক্তি সমাজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রশংসনীয় ও সুখ্যাত। আমানতদারি এমন এক মহৎ গুণ, যার ওপর জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধি নির্ভরশীল।

এরই বিপরীত হলো খেয়ানত। কোনো দেশ যা জাতীয় অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নৈরাজ্য, দেউলিয়াপনা, অকার্যকরতা সৃষ্টি হয় আমানতকারীর অভাবে এবং খেয়ানতের কারণে। মানুষ যখন আমানতদারিকে বিসর্জন দিতে থাকে এবং খেয়ানতকে আসল সম্বল হিসেবে গ্রহণ করে তখন তার বিপর্যয় ঘটতে থাকে।

এ আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা চলে, আমানত রক্ষার ওপর নির্ভর করে দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের উন্নতি। সম্ভাবনাময় জাতির জন্য আমানত একটি অপরিহার্য ব্যাপার। আমানতদারি না থাকলে জাতির বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। বর্তমানে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ধ্বংসের একমাত্র কারণ আমানতের খেয়ানত, আত্মসাৎ, লুটতরাজ, অবৈধ উপার্জন ইত্যাদি।

সমাজের মধ্যে ঐক্য, সংহতি, হৃদ্যতা, আন্তরিকতা, সহমর্মিতা, স্নেহ-মমতা, ভালোবাসা সৃষ্টির মূল হলো আমানতদারি। পরস্পরের আস্থা প্রতিষ্ঠার একটি মাত্র উপায় হলো আমানতদারি।

পারিবারিক জীবন হোক অথবা ব্যক্তিগত জীবন, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানা, হাটবাজার, ব্যবসায়-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রে আমানতদারি বিশেষ প্রয়োজন। বিষয়টি আজকের তারাবিতে অংশ নেওয়া মুসল্লি ও রোজাদাররা হৃদয় থেকে বুঝে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলেই মঙ্গল। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৬
এমএইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।