ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপার মহিমার রমজান

রমজানে মালয়েশিয়ার মসজিদগুলো ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৯ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৬
রমজানে মালয়েশিয়ার মসজিদগুলো ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে

বহু সংস্কৃতির দেশ মালয়েশিয়ার মুসলমানরা মসজিদ ও ঘর-বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সাজ-সজ্জা করার মাধ্যমে পবিত্র রমজান মাসকে স্বাগত জানায়। এ উপলক্ষে মহিলারা ঘরের ব্যবহার্য্য আসবাবপত্র কেনার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

শাবান মাসের ২৯ তারিখে অধির আগ্রহে রমজানের চাঁদ দেখার চেষ্টা করতে দেখা যায় অনেককে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চাঁদ দেখার ব্যবস্থাপনা থাকে। চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে ঘোষণা দেওয়া হয় এবং রোজা রাখার আহ্বান জানানো হয়। সমুদয় মুসলমান যেন এই একটি ঘোষণার জন্য অপেক্ষোয় থাকেন। ঘোষণা শুনে তারা ভীষণ আনন্দিত হন।

রমজান উপলক্ষে সেখানকার মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের সংস্কৃতি বেশ পুরনো। অভিবাদনস্বরূপ তারা ‘শাহরুন মুবারাকুন’, রমজান ও রোজার আয়াত বা হাদিস সম্বলিত খামসমেত প্রীতিকার্ড বিনিময়ের মাধ্যমে খুশি ও আনন্দ প্রকাশ করে থাকেন। যা অধিকাংশই লেখা থাকে আরবি ভাষায়। এ ছাড়াও গ্রামে মসজিদে মসজিদে পবিত্র রমজানের আগমন উপলক্ষে বিশেষ আলোচনা সভা ও ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।

সারা রাত এবং দিনের অধিকাংশ সময় মালয়েশিয়ার মসজিদগুলোর দরজা থাকে উন্মুক্ত। বছরের অন্য সময়ের বিপরীতে রমজান মাসে কোনো মসজিদই তালাবদ্ধ থাকে না। কোরআন অবতীর্ণের মাসে মালয়েশিয়ান মুসলমানরা কোরআন তেলাওয়াতের প্রতি গভীর মনোনিবেশ করে। অভিভাবকরা অধীনস্থ তথা স্ত্রী-সন্তানদের এ ব্যাপারে বিশেষ তাগিদ দিয়ে থাকেন। এতে মসজিদের পাশাপাশি প্রতিটি ঘরেই গুণগুণ শব্দে কোরআন তেলাওয়াতের সুমধুর ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়। ছোট ছোট ছেলেরা এ মাসে স্বদেশি নতুন পোশাক পরে। মাথায় পরে বড় আকারের টুপি। আর মেয়েরা গোড়ালিসমেত আবৃত লম্বা কামিজ পরিধান করে, মাথায় থাকে শরয়ি হিজাব।


ভাত বা চাউল মালয়েশিয়ার প্রধান খাবার। তাই ইফতারেও এর প্রতিফলন হয়। বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরিতে চাউল প্রধান উপরকণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ভাত-চাউলের ইফতারি ছাড়াও বাজারে রমজানে নানা ধরনের নুডলস পাওযা যায়।

দেশটির সমৃদ্ধ সেলানগর রাজ্যে দেখা যায়, এক অভিনব চিত্র। সেখানকার অনেক বাজারে এমন লেখা স্টলও দেখা যায়- ‘বিনামূল্যে খাবার। প্লিজ, আসুন, বিনা পয়সায় ইফতার নিন। ’

এখানকার মুসলমানদের আরেকটি অভ্যাস হচ্ছে- তারা সাহরি খাওয়ার পর ‘কোলাক’ নামীয় এক ধরনের পানীয় পান করে। এতে পিপাসা নিবারণ হয়, দিনে শরীরের ক্লান্তি দূর হয় এবং রোজা মৌসুমে নামাজ ও অন্যান্য ইবাদতে শক্তি সঞ্চারিত হয়।

মালয়েশিয়ান সরকার রমজান উপলক্ষে রোজাসম্পৃক্ত সব স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। অসহায়, গরিব ও দুঃস্থদের জন্য থাকে বিশেষ সহায়তা। সাহরি, ইফতার ও রোজাসংশ্লিষ্ট অন্যান্য আমলে দুর্ভোগ বা সমস্যা চিহ্নিতকরণে সরকারি মনিটরিং ব্যবস্থা থাকায় সেখানকার অধিবাসীরা পরম শান্তিতে সিয়াম পালন করতে পারেন। সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও নিত্যপণ্যে মূল্যহ্রাস বা বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করে থাকে।

বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে দেশব্যাপী রমজান সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সামগ্রী বিতরণ করা হয়। আয়োজন করা হয় হিফজ ও কেরাত প্রতিযোগিতাসহ ধর্মীয় শিক্ষামূলক নানা প্রতিযোগিতার। এতে থাকে আকর্ষণীয় পুরস্কার। এতে থাকে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনী, সাহাবাদের জীবনী, ফিকাহ, আহকাম ও তাফসিরসহ রমজান ও রোজাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফাজায়েল ও মাসায়েল ইত্যাদি বিষয়ের বৈচিত্রময় সমাহার। এর মাধ্যমে জনসাধারণের মাঝে জ্ঞানের অভূতপূর্ব অনুশীলন হয়ে থাকে। মালয়েশিয়ান মুসলমানরা শহরে ও গ্রামে পহেলা রমজান থেকেই এলাকাভিত্তিক নৈশপ্রহরী নিয়োগ দিয়ে থাকেন। সে রাতে সারা মহল্লা চক্কর দিতে থাকে। সাহরির সময় হলে সবাইকে জাগিয়ে তোলে। প্রতিদিনই ফজরের আগ পর্যন্ত সবাইকে সে ডেকে যায়।

এ মাসে মালয়েশিয়ান মসজিদগুলো মুসল্লিতে কানায় কানায় ভরপুর থাকে। বিশেষ করে এশা ও ফজরে থাকে লক্ষণীয় ভীড়। বাংলাদেশে আমরা যেখানে ফজরের পরপরই ঘুমের বিছানায় নুইয়ে পড়ি, মালয়েশিয়ান মুসলমানরা সেখানে ফজরের পর অনুষ্ঠিত বিশেষ ধর্মীয় আলোচনা সভায় সানন্দে অংশ নেয়। সূর্যোদয় পযন্ত চলতে থাকে এ আলোচনা। এরপর তারা নিজ নিজ কাজে বেরিয়ে পড়েন। অধিকাংশ মানুষ বিশেষ করে যারা দ্বীনদার তারা ফজরের পর কখনও ঘুমান না।


মালয়েশিয়ার অধিকাংশ মসজিদে ২০ রাকাত তারাবি পড়া হয়। পুরুষ-মহিলা, যুবক-বৃদ্ধ, ছোট-বড় সকলে জামাতে নামাজ আদায় করে থাকে। তারাবি শেষে ধর্মীয় শিক্ষামূলক আসর অনুষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে চলে কোরআন শিক্ষা কার্যক্রম। সব মুসল্লি এ দু’টি আসরে স্বতস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়ে থাকেন। ধর্মীয় বিদ্বানদের মুখনিসৃত কথামালায় স্বীয় জ্ঞানের পরিধি প্রশস্ত করার প্রয়াস পান। ইলমে দ্বীন শিক্ষা করার সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগান। এ সব আসরের মাধ্যমে জ্ঞানসিক্ত হয়ে তারা অর্ধরাত কাটিয়ে দেন। এরপর ঘরে ফেরেন। এদের মধ্যে অনেকে আবার মসজিদে তেলাওয়াত, তাহাজ্জুদ ও অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগিতে লিপ্ত হয়ে যান। মহান প্রভুর অপার দয়ায় মাগফিরাত ও নাজাত লাভের জন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করেন।

রমজান উপলক্ষে মালয়েশিয়াজুড়ে বিরাজ করে তাকওয়ার অপার্থিব পরিবেশ। প্রতিটি মসজিদে কোরআন, তাফসির, হাদিস, ফিকাহ, আকাইদ ও মাসাইলসহ ধর্মীয় নানা বিষয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন হয় চোখে পড়ার মতো, তাতে উপস্থিতির হারও অনেক বেশি। থাকে পুরস্কার ও সম্মাননার ব্যবস্থা।

শেষ দশকে মসজিদগুলো হয়ে উঠে আরো জীবন্ত। কেউ নামাজ পড়ছে, কেউ কোরআন তেলাওয়াতে মগ্ন, কিছু লোক জিকির করছে, কেউবা ইতেকাফে- এভাবেই এক জান্নাতি পরিবেশ বিরাত করে সেদেশে।

মালয়েশিয়ায় ৪০ শতাংশ অমুসলিম বসবাস করেন। তারাও এ মাসে রোজাদারের সম্মানার্থে দিনের বেলা প্রকাশ্যে পানাহার করেন না। ধর্ম পালনে ব্যঘাত ঘটে- এমন কোনো কর্মকাণ্ডে তারা জড়িত বলে খবর পাওয়া যায় না। বরং অনেকেই মুসলমানদের সঙ্গে উপবাসব্রত পালন করেন। কেউ কেউ ইসলামের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে শান্তির ছায়াতলে আশ্রয় নিতে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন।

সদকায়ে ফিতর ও জাকাত আদায়ে মালয়েশিয়ান মুসলমানরা বেশ তৎপর ও অগ্রগামী। শুধু স্বদেশি নয়; ভিনদেশি অনেক প্রতিনিধির মাধ্যমে তারা বিশ্বের গরিব, অসহায় ও দুঃস্থদের মাঝে অকাতরে দান-দক্ষিণার হস্ত প্রসারিত রাখেন- যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৮ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৬
এমএইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।